“নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ-বণ্টন মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামের এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমি এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙ্গে যায়। কিছু দিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।”
কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মনে এমন একটা প্রশ্নসূত্র কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে? এটি বোঝার জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হবার দরকার পড়ে না। সেদিকে না গিয়ে আমি প্রশ্নটির মোটিভ এবং তার ভেতরকার কদর্য বিষয়গুলো নিয়ে বলতে চাই। ইতোমধ্যে আমরা জেনে গেছি ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে, বিতর্কিত প্রশ্নপত্রটি প্রণয়ন করেছিলেন ঝিনাইদহের মহেশপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পাল। প্রশ্নপত্রটির মডারেটর ছিলেন নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তাজউদ্দীন শাওন, সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. শফিকুর রহমান, নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা আদর্শ কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।
এ সংবাদটি প্রকাশ্যে আসার পর অনেক মানুষ স্বস্তির ভান করছেন। কারণ এর মূল প্রণেতা প্রশান্ত কুমার পাল। যার নাম বলছে তিনি একজন হিন্দু। কিন্তু এরা ভুলে যাচ্ছেন মডারেটার ছিলেন আরও কয়েকজন। যাদের তিনজন অন্তত মুসলিম। তারা কেউ এ নিয়ে কথা বলেননি বা বলার দরকার বোধ করেন নি। আর সবচেয়ে বড় কথা প্রশান্ত কুমার হিন্দু বা মুসলিম যেই ধর্মীয় পরিচয়ই বহন করেন না কেন, দেশের শিক্ষা ও সমাজ অশান্ত করার কোনও অধিকার তার নাই। প্রশ্নে কতগুলো বিষয় ঘোর উস্কানিমূলক। প্রথমত, আব্দুলকে দিয়ে হিন্দুর জমিতে গরু জবাই করানো। যা দেশের সংখ্যাগুরু মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি উস্কানিমূলক কথা। অতঃপর ভারতে চলে যাওয়ার গল্প। এখানে প্রশান্ত বাবু ও তার সহযোগী মডারেটার বা সংশ্লিষ্টজনেরা স্পষ্টতই স্বীকার করে নিলেন যে, হিন্দুরা জায়গাজমি বা কোনও বিষয়ে বনিবনা না হলেই ভারতে চলে যায়? এই অভিযোগ যদি একটি প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়ানো হয় তাহলে তো এটাই সত্য প্রমাণ হলো যে ও দেশের বিজেপি যা বলে তাই সত্য। তারা সবসময় বলে আসছে, বাংলাদেশ থেকে দলে দলে হিন্দু বা অমুসলিমেরা দেশ ত্যাগ করে। প্রশান্ত বাবু এই সত্যকেই অনুমোদন দিলেন কি? মডারেটর বা অন্যদের বেলায় ও এ কথা প্রযোজ্য।
একটা বিষয় এখানে পরিষ্কার, কেউ আসলে কারো ধার ধারে না। সাম্প্রদায়িকতা যে কিভাবে আমাদের সমাজকে গিলে খেয়েছে এটা তার একটা বড় প্রমাণ। বাংলাদেশের সমাজ ও সামাজিকতা কতটা পরিবর্তিত হয়েছে সেটা সহজেই বোঝা যায়। আমি পড়াশোনা করেছি দেশে, আমাদের পরিবারের সবাই পড়াশোনা করে বড় হয়েছেন বাংলাদেশে। আমাদের সবার বেলায় এটা সত্য। ভেবে দেখুনতো এক দশক আগেও কি এমন কোন প্রশ্ন তৈরী করার কথা ভাবতো কেউ? এমন কি পাকিস্তান আমলেও এমন করে ভাবেনি কেউ। আমরা কথায় কথায় পাকিস্তানের নিন্দা করি। মনে করি বা বলি যে সে আমলই ছিল সবচেয়ে খারাপ ও সাম্প্রদায়িক। এটা সত্য ও বাস্তব বলেই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু আপনি যদি সতর্কতার সাথে স্মৃতি হাতড়ান দেখবেন, পাকিস্তান আমলেও এমন ভাবনা ছিল না সমাজের সাধারণ স্তরে। আজকের বাংলাদেশে এই বাস্তবতার মূল কারণগুলো আমরা সবাই জানি। কিন্তু মানতে চাই না ।
এ প্রশ্নপত্রটি আসলে দেশ ও সমাজের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। যেখানে বিকৃত মানসিকতা ফুটে বেরিয়েছে । যে হিন্দু নামধারী ভদ্রলোক এটির জন্মদাতা তিনিও আসলে এই বিকৃতির শিকার। তার হয়তো মনে সুপ্ত বাসনা ছিল এসব প্রশ্ন করে সংখ্যাগুরুদের মন জয় করা। নিজেকে নিরাপদ রাখা। আসলে এই একটা বিষয় এখন সমাজে চোখ রাখলেই দেখা যায়। যেমন ধরুন ক্রিকেট খেলা। ভারতের সাথে খেলা হলেই অমুসলিমদের একটি বড় অংশের আচরণ ও কথাবার্তায় মনে হবে তাদের মতো দেশপ্রেমিক আর কেউ না। এই যে প্রমাণ করার উদগ্র বাসনা এর কারণও আমরা জানি। ভেতরে ভেতরে কেউ ভারত, কেউ শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের সমর্থক। অথচ বাইরে দেশপ্রেমী। এই হিপোক্রেসির কারণেই এমন প্রশ্ন বানানোর সাহস হয়।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনিতেই ভঙ্গুর। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি একজন সজ্জন নেত্রী, আধুনিকও। তার ডেপুটি আমাদের চট্টগ্রামের নওফেলও আধুনিক মানুষ, বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশের রাজনীতিতে। কিন্তু তারা কি বা কতটা করতে পারবেন? দেখে শুনে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা?’ শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের দোষারোপ করে কী লাভ? মূলত আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই হুমকির মুখে। মুফতি ইব্রাহিম নামের এক জনপ্রিয় বক্তা তার ভাষণে- আইনস্টাইনকে বলছেন চোর। নিউটনও চোর। আর গ্যালিলিও নাকি সব থেকে বড় চোর। এদের কথা বার্তা বন্ধ করার কোন আয়োজন বা ব্যবস্থা নাই। তারা সমানে বলছে আর তাদের কথা গিলছে কূপমণ্ডুক বাঙালি। সে সূত্র ধরে বেড়ে উঠছে অদ্ভুত এক প্রজন্ম। যার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে এমন কতগুলো প্রশ্নপত্র প্রণয়নই যথেষ্ট।
হুজুগের সমাজে এটাও বুদবুদ। যেমন জেগে উঠেছে তেমনি মিলিয়েও যাবে। কিন্তু রেখে যাবে গভীর ক্ষত। এটা একা কারো দ্বারা হবার কথা না। এর পেছনে কোনও শক্তি বা অপশক্তি আছে তা বের করা দরকার হলেও, বের হবে না। কারণ সেই সময় নাই কারো। আমি মনে করি, এজাতীয় প্রশ্ন মূলত বিভেদ আর দূরত্ব বাড়িয়ে দেশের মানুষের জীবন ও সমাজ ধ্বংস করার এক চক্রান্ত। যার শেকড় অনেকদূর গভীরে প্রোথিত। এর মাধ্যমে এতাই প্রমাণ হয়েছে, আমাদের দেশের কোনও কিছুই আর অসাম্প্রদায়িক বা অবিকৃত নাই। এমন কি আওয়ামী লীগের আমলেও অনিরাপদ সমাজ আর চেতনা। এই হাঁটুভাঙ্গা বিকৃত মানসিকতা নিয়ে আর যাই হোক সামনে যাওয়া অসম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গন্তব্য আমাদের পথ দেখিয়েছিল আজ তা অদৃশ্য। অনিশ্চিত এক ভয়াবহ গন্তব্যই যেন হাতছানি দিচ্ছে, প্ররোচিত করছে জাতি ও সমাজকে।