বিবেকানন্দের পুনঃপাঠ জরুরি

সন্ন্যাসীর উদাসীন ভক্তিভাব নয় বরং এক কর্মীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, প্রজ্ঞা ফুটে ওঠে তার প্রতিটি বক্তৃতায়, লেখায়।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 17 Jan 2023, 06:02 AM
Updated : 17 Jan 2023, 06:02 AM

সারা বিশ্বেই এখন একটা আদর্শিক সংকট চলছে। সবরকম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিকতাকে তুলে ধরার মতো ব্যক্তিত্ব পৃথিবীতে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। যে যার স্বার্থ ও সুবিধা অনুযায়ী কথা বলছেন, পথ চলছেন। এমন বাস্তবতায় সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বামী বিবেকানন্দ পাঠ মানবজাতির জন্য জরুরি কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্বামী বিবেকানন্দকে আমরা আধ্যাত্মিক চিন্তার একজন মহাপুরুষ হিসেবেই দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু সমাজের জাতিভেদ প্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, জাতীয় জীবনে যুব ও নারীদের স্বতন্ত্র গুরুত্বের প্রশ্নে, দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির প্রসঙ্গে তার গভীর অবদানের কথা কখনও অনুধাবন করি না।

বিবেকানন্দের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ডাকনাম ছিল বীরেশ্বর এবং নরেন্দ্র বা নরেন। তিনি ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি ভারতের উত্তর কলকাতার ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটের এক উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

স্বামী বিবেকানন্দ মানে একজন আধ্যাত্মিক সাধকের ধ্যান নয়। ১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ সালের ঐতিহাসিক শিকাগো ভাষণ, এই ভাষণের পর কয়েক মিনিটের করতালি নয়। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়ে জগৎকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি একইসঙ্গে ছিলেন একজন সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অন্যতম সমন্বয়বাদী সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য। তার প্রদীপ হয়ে ওঠার পেছনে ছিল সুগভীর দর্শনের নিশ্ছিদ্র নির্মাণ ও তীক্ষ্ণ যুক্তিবাদ।

বিবেকানন্দ রাজনীতিবিদ ছিলেন না। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল অহিংস ও সশস্ত্র সংগ্রামের দুটো ধারাই। সামাজিক সংস্কার আন্দোলন ছাড়া রাজনৈতিক আন্দোলন সফল হয় না। বিবেকানন্দ সেই পথটা তৈরি করে রেখেছিলেন, যে পথে হেঁটেছেন গান্ধীজি। সারা ভারতের সর্বত্রই আধ্যাত্মিক পুরুষেরা তামসিক ভাবাপন্ন ভারতবাসীকে জাগানোর জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন, যা পরিপূর্ণতা পায় স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে। ওই আধ্যাত্মিক আন্দোলনই সম্ভবপর করে তুলেছিল দেশ ও জাতির নবজাগরণ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে তা চৈতন্যময় করে বেগবান করে দেয়।

বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ইংরেজ সভ্যতার তিনটি উপাদান হল তিনটি ‘ব’– বাইবেল, বেয়োনেট ও ব্র্যান্ডি। আমাদের দেশের গ্রামে গ্রামে যখন মানুষ দুর্ভিক্ষে মরছে, তখন ইংরেজরা আমাদের গলায় পা দিয়ে পিষছে, নিজেদের তৃপ্তির জন্য আমাদের শেষ রক্তবিন্দুটি শুষে নিয়েছে আর কোটি কোটি টাকা নিজেদের দেশে চালান করেছে। ইংরেজদের কৃতকর্মের প্রতিশোধ ইতিহাস একদিন নেবেই নেবে। (আমেরিকা বক্তৃতা: অগাস্ট ১৮৯৫) এই অগ্নিময় ভাষাই যথেষ্ট ছিল একটা স্থবির, তমসাচ্ছন্ন জাতিকে শতাব্দীর মোহনিদ্রা থেকে জাগ্রত করতে। ১৯০১ সালের ১৩ এবং ১৪ এপ্রিল স্বামী বিবেকানন্দ তরুণ বিপ্লবীদের স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, আমাদের প্রথম দরকার স্বাধীনতা, তাই সর্বপ্রথম ইংরেজদের এ-দেশ থেকে তাড়াতে হবে। জননীর শৃঙ্খলমোচনের জন্য যা প্রয়োজন মনে হবে, তোমরা তা-ই করবে।

শুধু মুখের কথা নয়, জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন– এ জীবন শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় সুখের জন্য নয়। এ জীবন পরহিতার্থে ব্যয় করাই মানুষের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সে জন্য তার সাবধান বাণী 'Be and make' আগে নিজে তৈরি হও, তারপর অপরকে তৈরি করো। 

তিনি বারবার বলেছেন– ‘‘নিজেকে কর্ম করার যোগ্য যন্ত্র করে তোলো।... হৃদয় ও মস্তিষ্কের যদি বিরোধ দেখ, তবে হৃদয়কেই অনুসরণ করো।’’ মানুষের এই দুটি যন্ত্রই তাকে মানুষ করেছে। এক মস্তিষ্ক, যা দিয়ে সে বিচার করে আর দ্বিতীয়টি: হৃদয় যা তাকে বিবেচনা দেয়। এই দুটির একটিও বাদ গেলে চলবে না। মস্তিষ্কসর্বস্ব মানুষের কোনও প্রয়োজন নেই। হৃদয়বান মানুষও তার কাছে অপ্রয়োজনীয়। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে– Three H ফর্মুলা। ‘Head, Heart and Hand'– স্বামীজি চেয়েছেন মস্তিষ্ক জোগাবে বুদ্ধি, হৃদয় যোগাবে বোধ আর হাত অর্থাৎ দুটি হাত কর্মে উদ্বুদ্ধ করবে। শুধু বক্তৃতাসর্বস্ব হলে চলবে না। মানবিক বোধ দ্বারা কাজ, করতে হবে। কাজ কাজ আর কাজ। অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা দূর করতে হবে সমাজের পাপ। সেই পাপ, যা মানুষকে পশ্চাদপদ করে রাখে, অন্ধ কুসংস্কারছন্ন করে রাখে, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে।

স্বামীজি যুবকদের এই কাজে অগ্রসর হতে আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ যুবকেরাই দেশের মূল চালিকা শক্তি। তাদের সঠিক পথে চালিত করলে কী-ই না হতে পারে! স্বামীজি বিশ্বাস করেন, প্রত্যেকটি মানুষ পরমাত্মার অংশ, দেবত্ব তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি। সে তার এই অসমান্য শক্তির কথা জানে না। তাই অমন অলস, সংকুচিত। তাকে জানতে হবে তার ভেতরে অসীম শক্তি বিদ্যমান। যখন এই উপলব্ধিতে পৌঁছবে যে সে নিজেই অসীম ব্রহ্মশক্তির অধিকারী, তখন সে নিজের শক্তিতেই চারপাশের পাপ, অনাচার, অন্ধবিশ্বাস, অশিক্ষার মতো জঞ্জাল সাফ করতে শুরু করবে। যুবকদের উদ্দেশে তার স্পষ্ট বক্তব্য “হৃদয়ে ক্রমে ক্রমে বল আনতে হবে। একটা ‘মানুষ’ যদি তৈরি হয়, তো লাখ বক্তৃতার ফল হবে।” 

ঈশ্বর দর্শনের অন্তর্নিহিত ভাব অনুধাবন করে তিনি বলেছেন, “বহুরূপে সন্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/ জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” অর্থাৎ মানুষের সেবা যেন জীবনের মূল মন্ত্র হয়। স্বামীজি দিয়েছেন ত্যাগ ও সেবার মন্ত্র। নিছক কথার কথা নয়, নিজের সমস্ত ভাব তিনি জীবন দিয়ে পালন করে দেখিয়েছেন।

ধর্মের সারকথা যে সহিষ্ণুতা এবং গ্রহিষ্ণুতা, তা বার বার তিনি উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, আমি সেই ধর্মের প্রতিনিধি, যে ধর্ম অন্য ধর্মকে শুধু শ্রদ্ধাই করে না, সব ধর্মকে সমান এবং সত্য বলে মনে করে। এ যেন ‘যত মত তত পথ’-এর সরল ব্যাখ্যা। স্বামীজি কুয়োর ব্যাঙের প্রসঙ্গ টেনে সঙ্কীর্ণ ধর্মাচারণের সমালোচনা করেছেন। সাগরের ব্যাঙ হওয়ার যে আহ্বান তিনি পাশ্চাত্যে প্রচার করেন, তারই মর্মবাণী হিসেবে এদেশের মানুষকে জানিয়েছেন– প্রসারণই জীবন, সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু। অর্থাৎ, আমাদের ধর্ম উদার এবং বিনত হতে শেখায়। উদ্ধত-সঙ্কীর্ণ সংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব ধর্মরক্ষার পরিপন্থী। 

তিনি নিরলস ত্যাগ ও সেবা ধর্মে দীক্ষিত হয়ে সারা বিশ্বে ‘মানুষ’ গড়ার কাজে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। যুবকদের বলছেন, “Arise awake and stop not till the goal in reacted..।”

স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলি পাঠ করার পরে, সুভাষচন্দ্র অনুধাবন করেছিলেন যে, বিবেকানন্দের শিক্ষার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক উন্নতি, দেশাত্মবোধ, নারীদের প্রতি সম্মানবোধ এবং মানবসেবা। সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, “আমার জীবনে যখন বিবেকানন্দের আবির্ভাব ঘটে, তখন সবে পনেরয় পড়েছি। তারপর আমার মধ্যে শুরু হলো এক বিপ্লব। ... তার শিক্ষা থেকে বিবেকানন্দকে এক পূর্ণ বিকশিত ব্যক্তিত্ব বলেই আমার বোধ হয়েছিল। ... এখন বিবেকানন্দের প্রদর্শিত পথের কথাই ভাবতে লাগলাম।” বিবেকানন্দের প্রধান শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা বলেছিলেন যে, স্বামীজির আরাধ্যা দেবী ছিলেন তার মাতৃভূমি।

সুভাষচন্দ্র ১৯২৯ সালের ২১ জুলাই হুগলী জেলার ছাত্র সম্মেলনে সভাপতির বক্তৃতায় বলেছিলেন, “ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে স্বাধীনতার অখণ্ডরূপের আভাস রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের মধ্যে পাওয়া যায়। ‘Freedom, freedom is the song of the soul’, এই বাণী যখন স্বামীজির অন্তরের দুয়ার ভেদ করিয়া নির্গত হয়, তখন তাহা সমগ্র দেশবাসীকে মুগ্ধ... করিয়া তোলে। স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে যাবতীয় বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া খাঁটি মানুষ হইতে বলেন এবং অপরদিকে সর্বধর্ম সমন্বয় প্রচারের ভিত্তি স্থাপন করেন।” স্বামী বিবেকানন্দের অখণ্ডতার আদর্শই ছিল সুভাষচন্দ্রের আদর্শ, যে আদর্শ শুধু রাজনৈতিক বন্ধনমুক্তির কথা বলেনি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বন্ধনমুক্তির কথাও বলেছিল।

বিবেকানন্দের শিক্ষার একটি মূল কথা হলো চরিত্রগঠন ও খাঁটি মানুষ তৈরি করা। তার নিজের কথায়, “সামাজিক ও রাজনীতিক সর্ববিধ বিষয়ের সফলতার মূল ভিত্তি—মানুষের সাধুতা। দশটা মানুষ পেলে আমি ভারতবর্ষ উলটে দিতে পারি। কিন্তু মানুষ চাই, পশু নয়।”

স্বামী বিবেকানন্দ উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন “আমাদের এখনও জগতের সভ্যতার ভাণ্ডারে কিছু দেবার আছে। তাই আমরা বেঁচে আছি।” কর্মহীন সন্ন্যাসে বা পুরস্কারহীন অদৃষ্টবাদে তিনি বিশ্বাস করতেন না।

বিবেকানন্দ মনে করতেন আমাদের দুর্দশার একটি বড় কারণ নারীর প্রতি অবজ্ঞা। তিনি বলতেন মেয়েদের এমন শিক্ষা দিতে হবে ‘‘যাতে চরিত্র তৈরি হয়, মনের শক্তি বাড়ে, বুদ্ধির বিকাশ হয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে ... ঐ রকম শিক্ষা পেলে মেয়েদের সমস্যাগুলো মেয়েরা নিজেরাই সমাধান করবে।’’

সন্ন্যাসীর উদাসীন ভক্তিভাব নয় বরং এক কর্মীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, প্রজ্ঞা ফুটে ওঠে তার প্রতিটি বক্তৃতায়, লেখায়। আধুনিক সময়ে, ‘স্ক্রল’ করে এগিয়ে যাওয়ার যুগে, যখন ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এর ধারণাকেও পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা এক দিকে, আর অন্য দিকে সাম্প্রদায়িকতা আর রাজনীতির খেলায় টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছে দেশ ও মানুষ, এমন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দের পুনঃপাঠ প্রয়োজন– মানুষ, সমাজ ও নিজেকে নতুন ভাবে চিনতে।