পাকিস্তানে চারজন সাবালক পুরুষ মুসলমান চাক্ষুষ সাক্ষী আনতে না পারায় ধর্ষণের শিকার হাজার হাজার নারী আদালতে শাস্তি পেয়েছেন বেত্রাঘাতের এবং বহুবছর কারাদণ্ডের।
Published : 18 Mar 2025, 04:58 PM
ধর্ষক ও নারী-নিগ্রহকারীদের অপ্রতিহত দাপটে আতঙ্কিত ও কলঙ্কিত বাংলাদেশ। মারাত্মকভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে নারীরা এমনকি শিশুরাও। দাবি উঠেছে শারিয়া আইন প্রয়োগের। শারিয়া আইন দিয়ে ধর্ষণ-ব্যভিচার উচ্ছেদ সম্ভব হলে আমি সেটা সমর্থন করি। তবে কিছু বিষয় আলেমদের নজরে আনা দরকার।
এ নিবন্ধে কোরান ও অন্যান্য শারিয়া কেতাবের সাথে ‘বিইআ’ হলো প্রয়াত আলেম শাহ আবদুল হান্নানসহ ছয়জন আলেমের কমিটি দ্বারা সংকলিত ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রকাশিত তিন খণ্ডের ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’, প্রধানত হানাফী আইনের সংকলন। কারও কোনো প্রশ্ন থাকলে যোগাযোগ করতে পারেন— কমিটির সভাপতি একুশে পদকপ্রাপ্ত আইন বিশেষজ্ঞ গাজী শামসুর রহমান, সদস্য আ. জ. ম. শামসুল আলম, মাওলানা ওবায়দুল হক, মাওলানা মোহাম্মদ মুসা ও মাওলানা মো. মোজাম্মেল হক।
১. ধর্ষণ কাকে বলে?
বিইআ ১ম খণ্ড, ধারা ১৩৪ ক ও খ: “কোনো পুরুষ বা নারী বলপ্রয়োগ করিয়া পর্যায়ক্রমে কোনো নারী বা পুরুষের সহিত সঙ্গম করিলে তাহা জেনা হিসেবে গণ্য হইবে” ও “বলপ্রয়োগকারী জেনার শাস্তি ভোগ করিবে যদি বলপ্রয়োগ প্রমাণিত হয়”।
সুস্পষ্ট আইন– বলপ্রয়োগকারী, অর্থাৎ ধর্ষক “জেনার শাস্তি ভোগ করিবে”। বিশ্ববিখ্যাত শারিয়াবিদ ড. আব্দুর রহমান ডোই-এর ‘শারিয়া দ্য ইসলামিক ল’ পৃষ্ঠা ২২৫– শাস্তির তালিকায় নাম্বার তিন ৩– অবিবাহিত জেনাকারীর শাস্তি একশ চাবুক। অর্থাৎ ধর্ষক অবিবাহিত হলে শারিয়া আইন মোতাবেক তার শাস্তি হবে একশ চাবুক, মৃত্যুদণ্ড নয়।
২. ধর্ষণ কী ধরনের অপরাধ? কোরান ও হাদিস অনুসারে
হুদুদ কী? হুদুদ হলো সেই সাত রকম মামলা যার শাস্তি কেউ তিলমাত্র বদলাতে পারবে না। ক) খুন বা জখম, খ) চুরি, গ) জেনা, ঘ) মানহানি, ঙ) ইসলাম ত্যাগ, চ) মদ্যপান এবং ছ) হাইওয়ে রবারি— যাকে অনেক আলেম বলেন রাষ্ট্রদ্রোহিতা। জেনার শাস্তি বিবাহিতদের জন্য প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড এবং অবিবাহিত জেনাকারীর শাস্তি একশ চাবুক।
ধর্ষণ হুদুদ অপরাধ কারণ, নবীজি (সা.) ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন:
আবু দাউদ https://sunnah.com/
কোরানে প্রত্যক্ষভাবে ‘ধর্ষণ’ শব্দে ধর্ষণের উল্লেখ নেই। শারিয়াতে ‘শারিয়াতে সূরা মায়েদা ৩৩’-এর ভিত্তিতে ধর্ষণকে ‘হিরাবা’ অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিইআ ১ম খণ্ড ধারা ১৩– “হিরাবাহ্ বলিতে সংঘবদ্ধ শক্তির জোরে আক্রমণ চালাইয়া আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাইয়া জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা বোঝায়। সম্পদ লুন্ঠন, শ্লীলতাহানি, হত্যা ও রক্তপাত ইহাতে অন্তর্ভুক্ত”।
এ অপরাধের শাস্তি: “হিরাবার অপরাধ ব্যতীত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী তওবা করিলেও শাস্তি হইতে রেহাই পাইবে না– হিরাবার অপরাধের শাস্তি ব্যতীত তওবা অন্য কোন শাস্তি বাতিল করে না”, “হিরাবার অপরাধের শাস্তি ব্যতীত তওবা অন্য কোন শাস্তি বাতিল করে না”— আইন নং ১৩, বিইআ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৮ ও ২২২। অর্থাৎ তওবা করলে ধর্ষকের কোনো শাস্তি হবে না।
৩. ধর্ষণের শাস্তি
আমরা দেখেছি হাদিসে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
৪. প্রমাণ
“বলপ্রয়োগকারী জেনার শাস্তি ভোগ করিবে যদি বলপ্রয়োগ প্রমাণিত হয়”, ও “জেনা ও ধর্ষণ সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ না হইলে জেনাকারীর শাস্তি হইবে না যদি সে অস্বীকার করে”– বিইআ ১ম খণ্ড ধারা ১৩৪ খ ও পৃষ্ঠা ৩০১।
· জেনার প্রমাণ- উদ্ধৃতি: “চারিজন বালেগ, বুদ্ধিমান, বাকশক্তি সম্পন্ন ও ন্যায়পরায়ণ মুসলিম পুরুষ যদি যুগপৎভাবে বাচনিক সাক্ষী দেয় যে, তাহারা একত্রে একই সময়ে ও একই স্থানে স্বচক্ষে অভিযুক্ত পুরুষকে জেনা করতে দেখেছে” — বিইআ ১ম খণ্ড, ধারা ১৪৯।
· জেনার প্রমাণ- পাকিস্তানের হুদুদ আইন, নং ৭-১৯৭৯, সংশোধনী ২০, ৮খ – ১৯৮০: “জেনা ও ধর্ষণের প্রমাণ অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি অথবা চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য” — ‘ক্রিমিনাল ল ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড – এ কমপ্যারেটিভ পার্সপেক্টিভ’, ড. তাহির মাহমুদ, পৃষ্ঠা ৪৪৫।
৫. নারীর জীবনে এই আইনের প্রভাব
পাকিস্তানে চারজন সাবালক পুরুষ মুসলমান চাক্ষুষ সাক্ষী আনতে না পারায় হাজার হাজার ধর্ষণের শিকার নারী আদালতে শাস্তি পেয়েছেন বেত্রাঘাতের এবং বহুবছর কারাদণ্ডের। ‘ইতিহাসের সাক্ষী: পাকিস্তানের যে আইনে ধর্ষিত নারীদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হতো’, বিবিসি নিউজ।
ধর্ষিতারা জেনার শাস্তি ছাড়াও আরেক মামলায় শাস্তি পেত। ‘প্রমাণের অভাবে’ খালাস পাবার পর ধর্ষকরা ধর্ষিতাদের বিরুদ্ধে এই দাবি করে মামলা করত যে, ধর্ষিতা তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে সমাজে তার সম্মানহানি করেছে। ওই মানহানির মামলায় ধর্ষিতারা কারাদণ্ড পেত। থানা ও জেলখানাতেও ধর্ষিতারা অত্যাচারিত হতো। ইসলামী রাষ্ট্রের পুলিশ নারী নিগ্রহের জন্য বিশ্বখ্যাত। ‘পলিস অ্যাবিউজ অব ওমেন ইন পাকিস্তান’, হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্ট।
অগণিত নারীর জীবন ধ্বংস হয়েছে, অগণিত শিশু আজীবন ট্রমায় ভুগেছে কিন্তু কোনো মুসলিম দেশ, কোনো আলেম এই বর্বরতার প্রতিবাদ করেছেন বলে জানি না। এই উদ্ভট ও হিংস্র আইন বিশ্বসভায় পাকিস্তানের মুখে চুনকালি লেপে দিয়েছিল। কিন্তু বারবার সংসদে এ আইন বাতিলের প্রস্তাব উঠলেও জামায়াতের বিরোধিতার জন্য ২০০৬ সাল পর্যন্ত সেটা সফল হয়নি। টিভি সাক্ষাৎকারে জামায়াতের আমির মুনাওয়ার হাসান জোর গলায় এই নৃশংস শারিয়া আইন সমর্থন করেছেন।
এবারের সংশ্লিষ্ট কিছু আইন দেখিয়ে আলেমদেরকে বলব যদি এতে সমস্যা দেখেন তাহলে সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা করতে পারেন।
· জেনা-ধর্ষণসহ যেকোনো অপরাধ আদালতে প্রমাণের আগে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না— বিইআ তৃতীয় খণ্ড ধারা ১২৮২। অর্থাৎ খুন ধর্ষণ ব্যাংক ডাকাতিসহ যেকোনো অপরাধের পরিকল্পনার সময় কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না— অপরাধ ঘটবার পর তদন্ত হবে, আদালতে প্রমাণ হবে তারপর অপরাধীকে গ্রেফতার করা যাবে।
· ব্যভিচারের মামলায় নারীসাক্ষী অবৈধ— মুহিউদ্দীন খান অনূদিত বাংলা কোরান, পৃষ্ঠা ২৩৯ আর ৯২৮।
আইনটাকে মেরামত করার চেষ্টা হয়েছে। যেমন: ১১ শতাব্দীতে স্পেনের ইমাম ইবনে হাজম প্রস্তাব করেছিলেন, জেনা প্রমাণের ক্ষেত্রে চারজন ন্যায়পরায়ণ মুসলমান পুরুষ সাক্ষী অথবা প্রতিজন পুরুষের পরিবর্তে দুজন মুসলিম ন্যায়পরায়ণ মহিলা হলেও চলবে– বিইআ ৩য় খণ্ড, ৮৮৮ পৃষ্ঠা।
অর্থাৎ সাতজন মেয়ের সামনে যদি জেনা বা ধর্ষণ হয় তবে অপরাধীরা পার হয়ে যাবে, আর ‘ন্যায়পরায়ণ মহিলা’ কাহাকে বলে কত প্রকার ও কী কী তা নিয়ে উকিলদের হুলুস্থুল তর্কবিতর্ক কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।
· ধর্ষণ হুদুদ মামলা এবং "হুদুদ মামলায় নারী বিচারক অবৈধ”– বিইআ ২য় খণ্ড, ধারা ৫৫৪।
· “কোনো কারণে শাস্তি মওকুফ হইলে ধর্ষক ধর্ষিতাকে মোহরের সমান টাকা দিবে” — বিইআ ১ম খণ্ড, ৩০১ পৃষ্ঠা, শফি আইন m.8.10. ধর্ষণের মত মারাত্মক অপরাধের শাস্তি কেন মওকুফ হবে?
· “চাক্ষুষ সাক্ষ্য না থাকলে শুধু আলামতের ভিত্তিতে খুনি-ডাকাতের শাস্তি হবে না” — বিইআ, ধারা ৬০০-এর বিশ্লেষণ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯২।
· “বোবার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়”— 'বিইআ ১ম খণ্ড, ধারা ১৪৯।
· “দাস-দাসী, গায়িকা এবং সমাজের নিচু ব্যক্তির (রাস্তা পরিষ্কারকারী বা শৌচাগারের প্রহরী ইত্যাদি) সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়” — বিইআ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৩; হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ৩৬১; শফি আইন o.24.3; পেনাল ল’ অব ইসলাম, পৃষ্ঠা ৪৬।
· “হুদুদ মামলায় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ চলিবে না।” (অর্থাৎ আঙ্গুলের ছাপ ইত্যাদি পরোক্ষ প্রমাণ চলবে না, চাক্ষুষ সাক্ষী থাকতে হবে) — বিইআ ২য় খণ্ড, ধারা ৬০০।
· সাধারণভাবে বলতে হলে চুরি-ডাকাতি-মদ্যপান-খুন-জখম-মানহানি-জেনা-ধর্ষণের প্রমাণ শুধু পুরুষ সাক্ষী, এসব মামলায় নারী-সাক্ষ্য অবৈধ, হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ৩৫৩; দ্য পেনাল ল অব ইসলাম পৃষ্ঠা ৪৪; বিইআ ১ম খণ্ড ধারা ১৩৩; শাফি আইন, উমদাত আল সালিক (আল আজহার ইউনিভার্সিটি দ্বারা সত্যায়িত) আইন নং 0.13.1, 0.24.9; ‘ক্রিমিন্যাল ল ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড’, পৃষ্ঠা ২৫১।
এসব কারণে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শরিয়া বিশেষজ্ঞ ড. হাশিম কামালি ব্যাকুল হয়ে বলেছেন, “শরিয়াকে এ যুগে চালাইতে হইলে অবশ্যই যে প্রচণ্ড ঘষামাজা করিতে হইবে সে ব্যাপারে আমি সবাইকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি… সেই যুগে যে উদ্দেশ্যে শরিয়ার উসুল বানানো হইয়াছিল অনেক কারণেই এখন উহা সেই উদ্দেশ্য অর্জন করিতে সক্ষম নহে…”। —‘প্রিন্সিপালস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স', পৃষ্ঠা ১৩, ৫০০, ৫০৪।