ডালিম কুমার সবসময় রূপকথার নায়ক। পরের জন সম্পর্কে আপনার মন্তব্যই সঠিক। তিনি খুনি না ‘শরীফ’ সেই সিদ্ধান্ত আমরা এই মুহূর্তে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছি না!
Published : 08 Jan 2025, 11:32 AM
আমার শৈশবকালটা ছিল ডালিমময়।
বাবা যে জুট মিলে চাকরি করতেন সেখানেই আমরা থাকতাম। পাশের বাসায় থাকতেন মান্নান চাচা। তার তিন ছেলে। আঙুর, জামরুল ও আপেল। আপেল সবার ছোট এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, লোকজন আপেলকে ডাকত ডালিম!
বাবার আরেক সহকর্মী জব্বার চাচার স্ত্রী সেলাই কর্মে খুব ভালো ছিলেন। তিনি সূচিকর্মের মাধ্যমে দুই লাইন লিখেছিলেন যা বাঁধাই করে দেয়ালে টানিয়েও রেখেছিলেন। আজও মনে থাকা সেই দুই লাইন হচ্ছে– ‘ডালিম পাকিলে এমনি ফাটিয়া যায়/ ছোটলোক বড় হলে বন্ধুরে কাঁদায়!’
পল্লীকবি জসীম উদদীনের ‘কবর’ কবিতার প্রথম দুই লাইন হচ্ছে– ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে/ তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’
খুলনায় আমরা যে কলোনিতে থাকতাম সেখানে ডালিম গাছের আধিক্য ছিল। ছিল সবার অগোচরে ডালিম চুরির রেওয়াজও। ছোটকালে ডালিম কুমারের রূপকথার গল্প বহুবার শুনেছি। ডালিম কুমারের প্রতি সেই ভালোবাসা হয়তো এখনও অনেকেরই আছে। খুলনার খালিশপুর-দৌলতপুর এলাকার একজন সংসদ সদস্য ছিলেন যার নাম কাজী সেকান্দার আলি ডালিম। একদা তিনি বিএনপি করতেন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য হন। যদিও আড়ালে আবডালে কেউ কেউ তাকে বলত ‘ডিগবাজি ডালিম’। কথায় কথায় শ্রদ্ধেয় ডালিম ভাইয়ের নাম চলে আসল। আমরা বরং কথা না বাড়িয়ে শুধু ডালিম নিয়েই থাকি।
আনার, বেদানা বা ডালিমের বৈজ্ঞানিক নাম punica granatum, ডালিম আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি চিকিৎসায় পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডায়াবেটিস রোগীরা ডালিমকে প্রাকৃতিক ইনসুলিন বলে থাকেন। কেটে গেলে বা নাক দিয়ে রক্ত বের হলে ডালিম পাতা বা ফুল বেটে লাগালে উপশম পাওয়া যায়। রাস্তার পাশের ক্যানভাসাররা যে কৃমির ওষুধ বিক্রি করেন সেখানেও আছে ডালিমের ব্যবহার। ক্যানভাসাররা কাব্য করে বলেন– ‘রাইতের বেলা আম্বিয়ার বাপ চিৎকার কইরা কয় ধরছি ধরছি। আম্বিয়ার মা হারিকেন বাত্তি জ্বালাইয়া দেখে আম্বিয়ার বাপ কিছুই ধরতে পারে নাই। জনাব গুড়া কিরমি ধরা যায় না গুড়া কিরমি মারতে হয়। গুড়া কিরমি মারার জন্য দরকার ডালিম গাছের শেকড় দিয়ে বানানো এই ওষুধ।’
ডালিমের আরও বহুগুণ আছে। আমাশয় ও শিশুদের পেটের রোগ নিরাময়ে ডালিম কাজে লাগে। কিন্তু আমরা জানি প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। অ্যালার্জির সমস্যা থাকলে ডালিম খেতে নেই। ডালিম রক্ত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে বিধায় শরীরে লাল লাল ছোপ পড়তে পারে। গ্যাস, অ্যাসিডিটি ও নিম্ন রক্তচাপ থাকলে ডালিম খাওয়া উচিত নয়। ডালিমে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে বলে কিডনি রোগীদের এটা খেতে মানা করা হয়। যারা মানসিক রোগে ভোগার কারণে ওষুধ খান ডালিম হতে পারে তাদের জন্য বিষের সমান।
আরবিতে ডালিমকে বলা হয় ‘রুম্মান’। এর আদি নিবাস নাকি পারস্য অঞ্চলে। এটাকে জান্নাতি ফলও বলা হয় কারণ পবিত্র কোরানের তিন স্থানে রুম্মান বা ডালিমের কথা আছে। খেজুরকে বলা হয় খাবার ফল কিন্তু আনার বা ডালিমকে বলা হচ্ছে ফল ও ওষুধ। ইংরেজিতে ডালিমকে বলা হয় সুপার ফ্রুট। আসলে ডালিমের গুণাগুণ বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়।
ডালিম সব দেশেই কম বেশি পাওয়া যায়। তবে ফল হিসেবে ডালিম কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্ডার রেটেডও। গানে লাউ বা জাম্বুরা থাকলেও ডালিম নেই বললেই চলে। যেমন ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’ কিংবা আমার লাউয়ের পিছে লাগছে বৈরাগী’। আইটেম গানের কথায় আছে– ‘ও ছেড়ি তোর গাছে পাকা জাম্বুরা ফল কে খাবে?’ কিন্তু ডালিমের কথা নেই বললেই চলে, যা দুয়েকটা আছে তা বড় বেশি অশ্লীল। বিটিভিতে প্রচারিত একটা নাটকের নাম ছিল ‘রূপবান ও ডালিমকুমার’। ডালিমকুমার এবং পঙ্খিরাজও আছে নাটকে।
তবে ডালিম নিয়ে বিভাজনও আছে। ধরুন কিছু ডালিম ধরেছে পশ্চিমবঙ্গের জোড়াসাঁকোতে আর কিছু ডালিম ধরেছে চুরুলিয়ায়। জোড়াসাঁকোর ডালিমের নাম ঠাকুর ডালিম আর চুরুলিয়ারটা কাজী পেয়ারার মতো কাজী ডালিম। আপনি কোনটা ভালোবাসবেন? উত্তর সহজ। হয়তো কাজী নামটা মুসলিম ধর্মের সঙ্গে যায়। তাহলে কী কাজী ডালিমকে বাংলাদেশীয় ডালিম বলা যাবে? যদিও গানে আছে– ‘একচোখে চুরুলিয়া, একচোখে জোড়াসাঁকো/ এক চোখ বুজে থেকো না বাঙালি, দু’চোখ দিয়েই দেখো।’ জানি না গীতিকার ও সুরকার ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানের গানের কথাটা ঠিক লিখলাম কি না সংশয় আছে, ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী।
ডালিম নিয়ে রাজনীতিও আছে। যেমন ধরুন ডালিমের খোসা ছাড়ানোর ট্রিকস। যদি এক সঙ্গে প্রায় সব ডালিমের খোসা ছাড়াতে পারেন, তবে সেটা হয়ে যেতে পারে পলাতক ডালিম। সব দানা একসঙ্গে পাল্লায় বা উঠে আসে! আর যদি খোসা ছাড়াতে কষ্ট হয়, তবে সেটা হতে পারে সামরিক ডালিম। আমরা আবারও ডালিমে ফিরি। সামরিক বা পলাতক ডালিমে না যাই। তার চেয়ে বরং কয়েকটা প্রশ্ন ও উত্তর শুনে বিদায় নেই।
প্রশ্ন: ২০২৫-এ এসে ফল হিসেবে ডালিম কী আরো জনপ্রিয় হবে?
উত্তর: জান্নাতি ফল হিসেবে ডালিম এমনিতেই জনপ্রিয়। তবে কিডনি ও মানসিক রোগী এবং যারা রাজনীতির গ্যাসট্রিক সমস্যায় ভুগছেন তারা নতুন প্রজাতির খুনি ডালিম চেখে দেখতে পারেন!
প্রশ্ন: উন্নয়ন ডালিম বা সংস্কার ডালিমের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে?
উত্তর: নাই। ২০০৯ থেকে ২০২৪-এর অগাস্ট পর্যন্ত যা উন্নয়ন ডালিম অগাস্টের পর থেকে তা সংস্কার ডালিম হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
প্রশ্ন: ডালিম কুমার আর মেজর ডালিমের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
উত্তর: ডালিম কুমার সবসময় রূপকথার নায়ক। পরের জন সম্পর্কে আপনার মন্তব্যই সঠিক। তিনি খুনি না ‘শরীফ’ সেই সিদ্ধান্ত আমরা এই মুহূর্তে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছি না!
প্রশ্ন: সাক্ষাৎকার দেয়া এই ডালিম কী সেই ডালিম?
উত্তর: জানি না। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একজন। যিনি দিয়েছেন তার অন্তত তিনটা পরিচয়ের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রথমজন রফিক। সাক্ষাৎকারের প্রথম ১২ মিনিট তার নাম এটাই লেখা ছিল। এরপর এক তুলনামূলক কমবয়সী লে. কর্নেল শরীফুল হক ডালিমকে দেখা যায়, যিনি শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি। পরে ফেইসবুক থেকে জানা যায়, ডালিম বলে যাকে চালানো হয়েছে তিনি নাকি অরিজিনাল ডালিম, আনার বা বেদানা নন। তিনি একজন উবারচালক!