ভোট নাকি ভাত, ভাত নাকি ভোট

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এদেশে ভোট আর ভাতের অধিকার একই সূত্রে গাঁথা।

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
Published : 10 Nov 2023, 06:48 AM
Updated : 10 Nov 2023, 06:48 AM

গ্রামের দুপুর, ঘরের দাওয়ায় বসে গোগ্রাসে গামলা ভরে ভাত খাচ্ছেন একজন ক্ষেতমজুর। এটা আমাদের ছোটবেলার দৈনন্দিন স্মৃতি। আজাহার ভাই (৬৫) আমার নানাবাড়ির বারো মাসের কামলা (মজুর) ছিলেন, যিনি অসুরের মতো কাজ করতেন আর খাবারও খেতেন বুভুক্ষুর মতো। তিনি ছিলেন মেদহীন (আধুনিক সিক্সপ্যাকওয়ালা) কিংবা শিল্পী সুলতানের আঁকা বাংলার শ্রমজীবী মানুষের প্রতিমূর্তি।

একসময় সামান্য একটু আলু ভর্তা, মরিচ-রসুনের বেনুন দিয়েই গ্রামের মানুষ তাদের নিত্যদিনের ক্ষুধা নিবারণ করত। আজকে গ্রাম পাল্টেছে, গ্রামের মানুষের জীবন এবং তাদের খাদ্যাভ্যাসও পাল্টেছে। গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ এখন শহরে আসে কাজের সন্ধানে, শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজনে। আজাহার ভাইয়ের চার ছেলের মধ্যে একজন এই শহরেই জীবন চালাতে এসে নির্মম মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিল। গ্রামের সেই অভাবী জীবন আগের মতো নেই কিন্তু দ্রব্যমূল্যের মারাত্মক প্রভাব সেই গ্রামের জীবনেও পৌঁছে গেছে। কারণ গ্রামীণ কৃষিব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে খোদ গ্রামীণ কৃষকও দ্রব্যমূল্যের প্রভাবে নাস্তানুবাদ হয়ে আছে।

অন্যদিকে রমজান আলী (৫০) ঢাকার মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানের এক বস্তিতে বসবাস করেন একযুগের অধিক সময় ধরে। ৪ মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। একসময় বুড়িগঙ্গায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন কিন্তু সেটাও এখন দুরূহ। সব এলাকায় মাছ ধরা যায় না, নানা বাস্তবতায় এই পেশার লোকজনকে টিকে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। কখনও জাল রেখে দেয় বা কখনও মেরে তাড়িয়ে দেয়। আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না। রমজানের পরিবারের থাকার ভাড়াটা মালিকপক্ষ নেয় না, কারণ তার স্ত্রী আসমানী মালিকপক্ষের হয়ে ম্যানেজারের কাজ করে দেয়। কিন্তু বস্তিতে তাদের জীবন এখন দুর্বিষহ। কোনোভাবেই আর সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। একসময় অল্প টাকায় সংসারের যাবতীয় খাবার খরচ হয়ে যেত, কিন্তু এখন তাদের মাস কোনোভাবেই চলতে চায় না। কম টাকায় একসময় শাক-সবজি পাওয়া গেলেও এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের আয়ের সব টাকা দিয়েও এখন তিনবেলার আহার জোটানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে তাদেরকে জানানো হয়েছে, বস্তিটি উচ্ছেদ করা হবে। বস্তিটি বিক্রি হয়ে গেছে কোনো এক হাউজিংয়ের কাছে। এ সংবাদে তাদের চোখে ঘুম নেই, সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে তারা জানেন না।

একটা আবাসিক হাউজিংয়ে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করেন তালেব আলী (৫৮)। বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন। পরিবার গ্রামে থাকে। ঢাকা শহরে চাকরি করে গ্রামে সংসার চালান প্রায় ২৫ বছর ধরে। কিন্তু বর্তমান সময়ে তার আয় দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। প্রতিমাসেই গ্রাম থেকে ফোন আসে, সামান্য টাকায় আর সংসার চলতে চায় না।

লিমা আক্তার (৩৩) একটা এনজিওতে কমিউনিটি ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে কাজ করেন। তার পরিবার থাকে মিরপুর এলাকায়। মা-বাবা অসুস্থ, দুই বোনসহ তাদের অভাবের সংসার। তার একার রোজগারে বর্তমান সময়ে দিনাতিপাত করাটাই কঠিন। আয়ের পুরো টাকা দিয়ে এই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে খেয়েপরে বাঁচতে পারছেন না। ধার-দেনা লেগেই থাকছে।

সৈকত দাশ (৪৫) একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। মাসিক আয় প্রায় লক্ষাধিক টাকা। বছর আট আগে এর প্রায় অর্ধেক আয় করতেন। কিন্তু তার এই আয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়েনি, দ্রব্যমূল্য আরও দ্রুতলয়ে এগিয়ে গেছে। ইদানিং বাজারে গেলেই অসুস্থবোধ করেন তিনি। কয়েক হাজার টাকা নিয়ে গেলেও বাজার শেষ হয় না। লিস্ট অনুযায়ী বাজার আনতে গেলেই তার হাতে টান পড়ছে। বিগত আট বছরে প্রতিটি সেক্টরে ব্যয় বেড়েছে মারাত্মক গতিতে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ যাবতীয় বিল বেড়েছে, বেড়েছে লন্ড্রি খরচ কিংবা মোবাইল বিল। এছাড়া বছর বছর চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয়ও বাড়ছে। একজন উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের আয় দিয়েও বর্তমান সময়ে জীবন চালাতে হচ্ছে খুব সংগ্রাম করে।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়াটা একটা দারুণ ব্যাপার। এজন্য সরকারকে হাজার বার অভিবাদন জানাই। ১৮ কোটির ওপর মানুষের প্রতিদিনকার খাদ্যের যোগান দেয়ার সংগ্রামটাই অনেক বড় ব্যাপার। সরকার তার কৃষি ও উৎপাদন খাতকে গতিশীল করতে পেরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আজকে যে আলুর দাম ৬০/৭০ টাকা কেজি তার দায় কে নেবে? আলুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে আলু রপ্তানি করা হলো আর অন্যদিকে তা সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দেয়া হলো। কেন বাজার সিন্ডিকেটের হাতে সরকার বন্দি থাকবে? সরকারের মন্ত্রীরা কেন বারবার অসহায় আত্মসমর্পণ করেন। সহজ কথায় আসি, এই বাজার সিন্ডিকেট হলো রাজনৈতিক লুটেরা শ্রেণি। তারা দেশের সকল সেক্টরকে একইভাবে ভাগবাটোয়ারাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটে পরিণত করেছে। খাদ্যগুদাম কিংবা কোল্ড স্টোরেজ একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে যারা ক্ষমতায় আছে তাদের নীতিনিষ্ঠ অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে আগে। দেশে পেঁয়াজ, মরিচ, ডাল, তেল, লবণসহ সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়েই এই বাজার সিন্ডিকেট সক্রিয়। একেকসময় একেক গোষ্ঠী যারা খুবই চিহ্নিত তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে সরকার কী করছে সেটাই বড় প্রশ্ন!

রাজনৈতিক মিথ্যাচার ও ১০ টাকা কেজি চাল!

‘১০ টাকা কেজি চাল খাব, অমুক মার্কায় ভোট দেব’ এটা একটি রাজনৈতিক মিথ্যাচার ব্যতীত কিছু নয়। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির কথা বিবেচনা করলে সেটা হয়তো সম্ভবও না। তাহলে এই যে রাজনৈতিক মিথ্যাচার দিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেয়া, সেটা কবে বন্ধ হবে? নির্বাচনকেন্দ্রিক এক ভয়াবহ মিথ্যাচারের ইশতেহার আমরা বরাবরই খেয়াল করি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে। যেটা সে কখনোই করবে না তা দিয়ে মানুষকে মিথ্যা প্রবোধ দেয়াটাই তাদের লক্ষ্য। এই মিথ্যাচারের দখলেই আজকের দ্রব্যমূল্য। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের খাওয়া-পরার নিশ্চয়তা বিধান করা একটি রাজনৈতিক দায়িত্ব। আমাদের সংবিধানেও সে বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা আছে। কিন্তু আমরা কতটা সেই পথে হাঁটছি?

ভাত দেয়ার মুরোদ নাই, কিল দেয়ার গোসাই

গার্মেন্টস শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করছে। গত অক্টোবরে একজন শ্রমিককে বুকে গুলি করে হত্যা করা হলো। গত ৮ নভেম্বর সরকারঘোষিত ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে গাজীপুরে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে এক নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। শ্রমিকদের দাবি ২৫ হাজার টাকা মজুরি দিতে হবে। এই দাবিতে বিক্ষোভ ও সমাবেশসহ নানান কর্মসূচি পালন করছিলেন তারা। কোথাও কোথাও ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। যদিও শ্রমিকরা এই সব ঘটনাকে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্ত বলে অভিহিত করেছেন। মূল প্রসঙ্গ হলো বর্তমান উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির সময়কালে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকসহ অন্যান্য শ্রমিকরা যে মজুরিতে কাজ করছেন তা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না। কিছু পরিসংখ্যান ঘাটলেই সেটা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু শ্রমিকরা যখন ন্যূনতম মজুরির আলাপটাও করতে যান তখনই তাদের ওপর জুলুম নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেই চলে। গত ২৮ অক্টোবরের রাজনৈতিক সমাবেশকে ঘিরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে প্রায় একই সময়ে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনও হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোসহ কারোরই এ নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। অথচ এই পোশাক শিল্পের ওপর দেশ ও দেশের রাজনীতি কতটা নির্ভরশীলতা তা আমরা সবাই জানি। সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যে চাপে রেখেছে তারও প্রধানতম লক্ষ্য কিন্তু ওই পোশাক খাত। কিন্তু এ খাতের শ্রমিকদেরও নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।

ভোট নাকি ভাত?

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ১৩টি দল সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে কিন্তু বাদবাকি দলগুলো আলোচনায় অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচন কমিশন যেকোনো সময় নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করবে, শোনা যাচ্ছে আগামী ৬ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সরকার যে কোনো মূল্যে এই নির্বাচন করবেই। নির্বাচন ছাড়া এ জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার এটাই সবদিক থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে।

এই যে টানা হরতাল-অবরোধ চলছে, প্রতিটি সবজির মূল্য প্রায় দ্বিগুণ-তিনগুণ। প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত পর্যন্ত এই আগুনসম দ্রব্যমূল্যে একদম নাজেহাল। সরকার মনে হয় বিষয়টি চোখেই দেখতে পাচ্ছে না। সব চোখ যেন ভোট আর ব্যালট পেপারের দিকে। এমনকি দুটি নিয়ম রক্ষার উপনির্বাচনও আমরা দেখছি কত ঢাকঢোল পিটিয়ে করা হলো। মানুষ দু-বেলা দু-মুঠো খাবারের নিশ্চয়তা চায়, কেবল মেগা প্রকল্প দেখতে চায় না।

শেষ কথা

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি ভয়াবহ বিষফোঁড়া। এই বিষফোঁড়া থেকে জাতি মুক্তি চায়, মানুষ ন্যূনতম অর্থে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা চায়। একসময় শুধু গরিবও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছিল খুব বড় একটা ইস্যু কিন্তু বর্তমান সময়ে মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চমধ্যবিত্তও এ সংকট থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এদেশে ভোট আর ভাতের অধিকার একইসূত্রে গাঁথা। জনগণ সেই ভাতের অধিকারের জন্য লড়াইটা জারি রাখবে, সঙ্গে ভোটেরও।