গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে যে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, ওই সংবিধানের অনেক বিধান ‘সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের’ পথ সুগম করেছে।
Published : 21 Oct 2024, 06:03 PM
সংবিধানের কোনো বিধান চিরকাল একইরকম থাকার বিষয় নয়। সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনযোগ্য। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের কয়েক মাসের মধ্যে খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের কমিটি বাংলাদেশের জন্য যে সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করেন এবং ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে যে সংবিধান গৃহীত হয়, তাতে এখন পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে কয়টি সংশোধনী সত্যিই দেশ ও মানুষের কল্যাণে আর কয়টি ক্ষমতাসীন দলগুলো নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এনেছে, সেটি বিরাট তর্কের বিষয়।
ওই তর্ক মেনে নিয়ে এবং যারা ১৯৭২ সালে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করলেন, তাদের যোগ্যতা, মেধা ও পরিশ্রমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই এ কথা স্বীকার করা বাঞ্ছনীয় যে, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে যে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, ওই সংবিধানের অনেক বিধান ‘সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের’ পথ সুগম করেছে। বিভিন্ন সময়ে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, তারা নিজেদের মতো করে সংবিধানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন অথবা নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে এখানে নানাবিধ কাটাছেঁড়া করেছেন। ফলে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে দেশ যে একটি বিরাট রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে গেল— সেখানে সংবিধানের ওই সীমাবদ্ধতাও কম দায়ী নয়। সম্ভবত এ কারণেই গত ৫ অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি নিয়ে নানা ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। কিছুটা বিতর্কও।
কেন বিতর্ক?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান সংশোধন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও বাংলাদেশে এই ইস্যুতে সাম্প্রতিক বিতর্কের মূল কারণ বোধহয় দুটি। ১. সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজের একটি বক্তব্য এবং ২. অন্তর্বর্তী সরকার বা কমিশনের সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার।
কমিশনের প্রধান হওয়ার আগে অধ্যাপক আলী রীয়াজ রাজধানী ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘বর্তমান সংবিধান সংশোধনের উপায় সীমিত। কারণ, সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ এমনভাবে লেখা যে তাতে হাতই দেওয়া যাবে না। এর মধ্যে এমন সব বিষয় আছে, যেগুলো না সরালে কোনো কিছুই করতে পারবেন না। এ কারণে পুনর্লিখন শব্দটা আসছে।’ তবে সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য গণপরিষদ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার বা কমিশনের সংবিধান সংশোধনের আর কোনো পথ খোলা আছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আর কোনো পথ আছে কি না আমি জানি না।’
কেন সংবিধান পুনর্লিখনের কথা উঠছে?
অধ্যাপক আলী রীয়াজের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করে আমার মনে হয়েছে, পুনর্লিখন বলতে তিনি বিদ্যমান সংবিধানের সব অনুচ্ছেদ বাতিল করে নতুন করে লেখার কথা বলেননি। বরং এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো শুধু দুয়েকটি শব্দ পরিবর্তন করে হবে না। নতুন করে লিখতে হবে। সেই অর্থে তিনি ‘পুনর্লিখন’ কথাটি বলেছেন।
গণপরিষদ গঠনের কথাও তিনি বলেছেন বৃহত্তর অর্থে। অর্থাৎ যেহেতু একটি বড় রাজনৈতিক অভ্যুত্থান হয়ে গেল এবং সবকিছু নতুন করে শুরু করার একটা দাবি নানা ফোরাম থেকেই উঠেছে, ফলে সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য গণপরিষদ গঠন করা যেতে পারে। তবে গণপরিষদ গঠন করার মতো বাস্তবতা বা প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, সেটি অন্য তর্ক। সুতরাং সংবিধান সংস্কার কমিশনকে দ্বিতীয় বিকল্প গ্রহণ করতে হবে। সেটি হলো, তারা বিদ্যমান সংবিধানের ত্রুটি বা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলোর জন্য কিছু বিকল্প প্রস্তাবসহ একটি প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারকে দেবে। সরকার ওই প্রতিবেদনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিতে পারে। এমনকি প্রতিবেদনের ওপর মতামত দেওয়ার জন্য ওয়েবসাইটেও দেওয়া যেতে পারে— যাতে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ সংবিধান নিয়ে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পান। ওইসব মতামত বিচার-বিশ্লেষণ করে কমিশন একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে। তবে পরবর্তী সংসদই ঠিক করবে যে, ওই সংশোধনীগুলো গৃহীত হবে কি না? অর্থাৎ এই ইস্যুতে একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে।
কোথায় কী পরিবর্তন প্রয়োজন?
এটি স্বীকার করতে হবে যে, বিদ্যমান সংবিধানে এমন অনেক কিছুই আছে যেগুলো দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়। বিশেষ করে ১৯৭২ সালে গণপরিষদে গৃহীত হওয়ার পরে বিভিন্ন সময়ে সংবিধানে এমন সব সংশোধন ও পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করেছে। ফলে ওইসব বিধান নিয়ে এখন নতুন করে চিন্তা করা উচিত। সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিবেচনার জন্য বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের কোথায় কোথায় পরিবর্তন ও সংশোধন প্রয়োজন, ওই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
১. বাংলাদেশের সংবিধান লিখিত হয়েছে সাধু ভাষায়। ১৯৭২ সালের বাস্তবতায় এটি হয়তো অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এখন মনে হয় সংবিধানটি এমনভাবে চলিত ভাষায় লেখা উচিত, যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। জটিল ও কঠিন শব্দগুলো বাদ দেওয়া উচিত।
২. ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত বাংলাদেশের প্রথম সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে তিনটি বিষয় (সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার) নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সেগুলোই সংবিধানের মূলনীতি হওয়া উচিত।
৩. সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বদলে বর্তমান সংবিধানে যে চারটি মূলনীতি (গণতন্ত্র, (সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা) রয়েছে, সেগুলো বহাল রাখার প্রয়োজন হলে শুধু ‘গণতন্ত্র’ থাকলেই চলে। তবে বাকি তিনটি (সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা) বহাল রাখা হলে এগুলো পরিষ্কার করা উচিত। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র বদলে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ লেখা উচিত। বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে এই দেশে বসবাসরত অন্য জাতি-গোষ্ঠীগুলো, যারা সংখ্যায় কম, তাদের আপত্তিও বিবেচনায় নেয়া উচিত। ১৯৭২ সালে যে বাস্তবতায় জাতীয়তাবাদের ধারণাটি মূলনীতিতে যুক্ত করা হয়েছিল, ২০২৪ সালে এসে সেটি আর প্রয়োজন কি না— তা পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
৪. বাহাত্তরের মূল সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের কোনো বিধান ছিল না। সামরিক শাসক এরশাদ এটি তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার জন্য অষ্টম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে যুক্ত করেছিলেন।
৫. সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির পিতার প্রতিকৃতি প্রদর্শনের বিধান করা হয়। ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই জাতির পিতার কনসেপ্ট আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে জাতির পিতা ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। কেন এই ঐকমত্য গড়ে তোলা গেল না— সেটি বিরাট বিতর্ক। সংবিধান সংস্কার কমিশন এই ইস্যুতে কী অবস্থান নেবে, সেটি আন্দাজ করা যায়। কিন্তু এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সংসদকেই নিতে হবে।
৬. অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এই অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য হিসেবে ঘোষণা করা উচিত এবং রাষ্ট্র যদি এগুলো নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে এর প্রতিকারের জন্য সংক্ষুব্ধ নাগরিকের আদালতে যাওয়ার বিধানও রাখা দরকার। সেইসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির এই দুনিয়ায় ইন্টারনেট সেবা পাওয়াকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
৭. সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ এই তিনটি পদে তিনজন আলাদা ব্যক্তি থাকবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান যদি প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ নেতা হন, তাহলে তিনি দলীয় প্রধানের পদ ছেড়ে দেবেন। তখন দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হয় ভারপ্রাপ্ত হিসেবে অথবা পূর্ণ দায়িত্বে দলীয় প্রধানের ভূমিকা রাখবেন। দলগুলোর গঠনতন্ত্রেও বিষয়টি উল্লেখ থাকবে। একইভাবে সংসদ নেতাও নির্বাচিত হবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের এমন একজন, যিনি প্রধানমন্ত্রী বা দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
৮. পরপর হোক বা না হোক, একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির মতোই দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
৯. প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকার কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী তার পদে বহাল থাকবেন। এই বিধানটি বাতিল করা উচিত।
১০. প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তার কর্তৃত্বে এই সংবিধান-অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে বলে যে বিধানে (৫৫ অনুচ্ছেদ) প্রধানমন্ত্রীকে একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, এখানে ভারসাম্য আনা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য সুস্পষ্ট বিধান করা দরকার।
১১. প্রধানমন্ত্রী যেরকম চাইবেন, সেরকম সংখ্যক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন বলে বিধান থাকলেও এখানেও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা কমানো দরকার।
১২. সংসদ-সদস্যগণের বাইরে সর্বোচ্চ এক-দশমাংশ ব্যক্তিকে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী বানানোর বিধান রয়েছে। এটি বাতিল করা উচিত। কেননা সংসদ সদস্যের বাইরে কাউকেই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী বানানো উচিত নয়। তবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা গেলে সংসদ সদস্য নন— এমন যোগ্য ব্যক্তি, বিশেষ করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানিত ব্যক্তিগণকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত করা সম্ভব।
১৩. সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ-সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে অব্যবহিত পূর্বে যারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, তারা সদস্যরূপে বহাল রয়েছেন বলে বিধানটি বাতিল করা দরকার। অর্থাৎ সংসদ ভেঙে গেলে কেউই আর সংসদ সদস্য থাকবেন না। কেননা এর মধ্য দিয়ে একসঙ্গে ছয়শ বা সাড়ে ছয়শ লোক সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল থাকেন— যা বাস্তবসম্মত নয়।
১৪. সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় যেকোনো সময়ে কোনো মন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল করার বিধান বাতিল করা উচিত। অবশ্য নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হলে এই বিধানটি এমনিতেই বাতিল হয়ে যাবে।
১৫. কোনো পরিস্থিতিতে যদি প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভা না থাকে, সেরকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাটি কেমন হবে— সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান থাকা উচিত। কেননা গত ৫ অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নটি এখনও আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতি যে আর হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। সুতরাং এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান থাকা দরকার।
১৬. রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। কিন্তু তিনি হবেন নির্দলীয় ব্যক্তি। অর্থাৎ কোনো দলের প্রতি তার সমর্থন থাকলেও কোনো দলীয় পদে আসীন ছিলেন বা আছেন, এমন কেউ রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না।
১৭. রাষ্ট্রপতিকে সব কাজ করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে। কিন্তু বিধান রয়েছে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন কিংবা সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেবেন। প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী কি এই পরামর্শ রাষ্ট্রপতিকে দেবেন? দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী শারীরিক অসুস্থতা, মৃত্যু বা অভ্যুত্থানের মুখে পলায়ন করলে কী হবে— সে বিষয়ে নির্দেশনা থাকতে হবে।
১৮. রাষ্ট্রপতি সকল সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে করবেন এবং তিনি পরামর্শ দিলেন কি দিলেন না— তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে যে বিধান রয়েছে, সেটি বাতিল করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা দিতে হবে এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করতে হবে।
১৯. সংসদ না থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে বা মারা গেলে কিংবা অন্য কোনো কারণে তিনি দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্পিকার এবং স্পিকার না থাকলে ডেপুটি স্পিকার দায়িত্ব পালন করবেন বলে বিধান রয়েছে। কিন্তু স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারও যদি না থাকেন (বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি চলছে) তখন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, অসুস্থতা, মৃত্যু কিংবা পলায়নের মতো ঘটনা ঘটলে কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত/মনোনীত করা হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান থাকা দরকার।
২০. রাষ্ট্রপতির কাছে বিল পেশ করার বিধান (৮০ অনুচ্ছেদ) সংশোধন করা উচিত। বর্তমানে এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির কাছে বিল পেশ করার ১৫ দিনের মধ্যে তিনি তাতে সম্মতি দেবেন এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি না দিলে বা সংশোধনের অনুরোধ করে বিলটি ফেরত না পাঠালে ১৫ দিন পরে তিনি বিলটিতে সম্মতি দিয়েছেন বলে গণ্য হবে। অর্থবিলে রাষ্ট্রপতি কোনো সংশোধনীর সুপারিশ করতে পারবেন না বলেও বিধান রয়েছে। এখানে সংশোধন আনা উচিত। অর্থাৎ অর্থবিল ফেরত পাঠানো বা সংশোধনের সুপারিশের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকা উচিত। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো বিলই পাশ হবে না— এমন বিধান করা গেলে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং রাষ্ট্রপতি কেবল একটি আলঙ্করিক পদে পরিণত হবে না।
২১. রাষ্ট্রপতিকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে ৫১ অনুচ্ছেদে। এর মধ্য দিয়ে মনে হতে পারে যে, রাষ্ট্রপতি যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে এরকম দায়মুক্তির বিধান বেমানান।
২২. ডেপুটি স্পিকার, সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি এবং সংসদের মোট স্থায়ী কমিটির এক তৃতীয়াংশের সভাপতি বিরোধী দল থেকে নিয়োগের বিধান করা উচিত। সেইসঙ্গে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত রয়েছে, এমন কাউকে স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা যাবে না।
২৩. অ্যাটর্নি জেনারেলের পদের মেয়াদ নির্ধারণ করে সর্বোচ্চ ৫ বছর এবং একই ব্যক্তি দুইবারের বেশি অ্যাটর্নি-জেনারেল হতে পারবেন না— এমন বিধান করা উচিত।
২৪. ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান রয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত এই পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। এখানে বিধান করা উচিত যে, ন্যায়পাল হবেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং তাকে এমনভাবে ক্ষমতাবান করতে হবে যাতে তিনি প্রজাতন্ত্রের যেকোনো ব্যক্তির (রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি, স্পিকার, বিচারপতি ব্যতিরেকে) বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
২৫. সংসদ সদস্যদের পদ বাতিলসম্পর্কিত বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে উল্লেখ থাকতে হবে যে, কেবলমাত্র আস্থা ভোট ও অর্থ বিল (বাজেট) ছাড়া অন্য যেকোনো বিলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া যাবে— তাতে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হবে না।
২৬. সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বাতিল করে প্রতিটি দলকে জাতীয় নির্বাচনে এক তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনীত করার বিধান করা উচিত যাতে নারীরা যেকোনো লিঙ্গের প্রার্থীর সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
২৭. সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত থাকা উচিত।
২৮. বাহাত্তর সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। তখন যে বাস্তবতায় সংসদের আসন ছিল ৩০০, সেটি এখন নেই। এখন দেশের জনসংখ্যা সেই তুলনায় বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। অতএব সংসদের আসন সংখ্যা বাড়ানো উচিত এবং জনসংখ্যা অনুযায়ী আসন বিন্যাস করা উচিত।
২৯. সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে একজন ব্যক্তির একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিধান বাতিল করা উচিত।
৩০. বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তথা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট যেহেতু তীব্র এবং ক্ষমতাসীন দলের অধীনে যেহেতু বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদাহরণ নেই, ফলে ৫৮ক অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করা দরকার। সেইসঙ্গে এই সরকারে যারা থাকবেন তাদের যোগ্যতা ও তাদের মেয়াদও নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার। নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যে এই সরকার নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে এবং রাষ্ট্রপতি নতুন আরেকটি সরকার গঠন করবেন— এমন বিধান যুক্ত করা উচিত।
৩১. প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার— সব ধরনের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা দরকার।
৩২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আলাদা সচিবালয়ের বিধান থাকা উচিত— যেটি পরিচালিত হবে প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে। অর্থাৎ বিচার বিভাগের আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো খবরদারি থাকবে না।
৩৩. বিচারকদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান পুনর্বহাল করা উচিত। অবশ্য সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে আর নেই এবং এর মধ্য দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়েছে বলে মনে করা হয়।
৩৪. রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় (১৫২ অনুচ্ছেদ) বলা হয়েছে সংসদ, সরকার ও সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ। এখানে রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় বিচার বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
৩৫. বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত সকল চুক্তি সংসদে পেশ করার বিধান (১৪৫ক অনুচ্ছেদ) রয়েছে। এটি আরও স্পষ্ট করে বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত সকল চুক্তি সংসদে আলোচনার বিধান করা উচিত। জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে ব্যতিক্রম থাকতে পারে।
৩৬. সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদে সম্পত্তির অধিকারের বিধানে ব্যক্তির সম্পত্তি অর্জন বিশেষ করে জমির মালিকানার সীমারেখা ঠিক করে দেওয়া দরকার— যাতে বৈধ/অবৈধ টাকাওয়ালারা নিজের ইচ্ছেমতো একরের পর একর জমির মালিক হতে না পারেন। ছোট্ট আয়তনের দেশে বিপুল জনসংখ্যার চাপে প্রতিনিয়তই যেভাবে ফসলের জমি ও জলাভূমি কমছে; আবাসন কোম্পানির দখলে যেভাবে জমি চলে যাচ্ছে— তাতে বিশ বছর পরে এই দেশে ভূমিহীনের সংখ্যা আরও বাড়বে। সুতরাং একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কত বিঘা জমির মালিক হতে পারবেন, সেটি ঠিক করে দেওয়া দরকার।
৩৭. কোনো শৃঙ্খলা-বাহিনীর সদস্যকে যে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে ৪৫ অনুচ্ছেদে, সেটি বাতিল করা উচিত। কেননা যেকোনো ধরনের দায়মুক্তি রাষ্ট্রে অপরাধ বাড়াতে সহায়তা করে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহির আওতায় রাখতে সব ধরনের দায়মুক্তির বিধান ও আইন বাতিল হওয়া উচিত।
৩৮. সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের সঙ্গে নদী সুরক্ষার বিষয়টি স্পষ্ট থাকতে হবে।
৩৯. সংবিধানের ১৯ (৩) অনুচ্ছেদে ‘মহিলা’র বদলে ‘নারী’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা উচিত।
৪০. নিবর্তনমূলক আটকের বিধান বাতিল করা উচিত।
৪১. বিদ্যমান সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা’র স্থলে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ লেখা ভালো। এর মধ্য দিয়ে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। সেইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলা ও লেখার স্বাধীনতার বিষয়টিও যুক্ত করা উচিত।
৪২. সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসনের পরিবর্তে স্থানীয় সরকার শব্দটি ব্যবহার করা উচিত।
৪৩. পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭খ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে সংবিধানের এক তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদকে সংশোধন অযোগ্য করা হয়েছে। এটি একটি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি। কেননা কোনো সংসদ পরবর্তী সংসদের কার্যক্রম সীমিত বা সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে না। অতএব এই বিধানটি বাতিল করে যেকোনো অনুচ্ছেদ সংশোধনযোগ্য রাখা উচিত— যদি সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্য সে ব্যাপারে একমত পোষণ করেন।
পরিশেষে, এই মতামতগুলো ব্যক্তিগত। শুধু সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিবেচনার জন্য পেশ করা হচ্ছে। কিন্তু দিনশেষে এটিও মানতে হবে যে, সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তনের এখতিয়ার কেবল জাতীয় সংসদের। সংবিধান সংস্কার কমিশন বিদ্যমান বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় সংশোধনের একটি প্রস্তাব অন্তর্বর্তী সরকারকে দিতে পারে। কিন্তু সেটি গ্রহণ করা বা না করার এখতিয়ার যে পরবর্তী জাতীয় সংসদের, এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছে, তার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখেই কাজটি করতে হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা (সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার) সমুন্নত রেখে যাতে সংবিধানকে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক করা যায়, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য যেমন জরুরি, তেমনি সাধারণ মানুষ ও একাডেমিশিয়ানদেরও পুরো কাজের সঙ্গে যুক্ত করা দরকার। সবার মতামত গ্রহণ করা সম্ভব নয়— এটা যেমন ঠিক, তেমনি জনগণের ম্যান্ডেটের বাইরে গিয়ে কিছু করলে সেটি যে টেকসই হবে না— সেটিও মনে রাখা দরকার।