Published : 03 Mar 2013, 11:03 AM
শাহবাগ মঞ্চের তিনটি দাবির প্রথমটি আংশিক বিজয় লাভ করে যখন সরকার ঘোষণা করেন যে, কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে শুধু আসামীপক্ষ নয়, বাদীপক্ষ অর্থাৎ সরকারও উচ্চতর আদালতে আপিল করতে পারবেন। কার্যত, এতে কাদের মোল্লার লঘুদণ্ডের বিরুদ্ধে নতুন করে আপিল করার সুযোগ তৈরি হল।
কিন্তু ইতোমধ্যে সাঈদীর রায় ঘোষণার দিনটি চলে এল। যারা খবর রাখেন তারা জানেন যে, এক্ষেত্রে বাজারে একটি খবর বিস্তৃতভাবে চালু ছিল; সেটি হল কাদের মোল্লার মামলার মতোই সাঈদীর মামলায়ও প্রসিকিউশনের দুর্বলতা আছে, এবং সে ফাঁক দিয়ে এ বিচারের রায়ও কিছুটা লঘু হয়ে যেতে পারে। এমন একটি গুজবও শোনা গেছে যে, সাঈদীর বিরুদ্ধে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের পিতাকে হত্যার যে অভিযোগটি ছিল- সে অভিযোগে জাফর ইকবালের সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য জাফর ইকবাল পত্র-পত্রিকায় জানিয়েছেন যে, তাঁকে আসলে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে ডাকাই হয়নি!
যা হোক, এসব দুর্বলতার কারণে জাতি কিছুটা আশঙ্কা নিয়েই সাঈদীর বিচারের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। কাগজে-কলমে রায়ের যেটুকু অংশ দেখলাম তাতে বোঝা যায়, সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা উনিশটি অভিযোগের এগারোটি সত্য প্রমাণিত হয়নি। অর্থাৎ এগারোটি অভিযোগ বাদীপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু স্বস্তির বিষয় হচ্ছে যে, অন্তত আটটি অভিযোগ, বিচারকদের ভাষায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
স্বয়ং সাঈদীর পুত্র এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, পিরোজপুরের মতো এত বড় একটি এলাকায় সকল রাজাকারি ক্রিয়াকাণ্ড পরিচালনা করা একজন ব্যক্তির পক্ষে কখনওই সম্ভব নয়। কিন্তু এ কথার মধ্য দিযে তিনি এটাও পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, সে সময় পিরোজপুরের রাজাকাররা সাধারণ মানুষের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছিল তা ইসলামসম্মত ছিল না, ভালোও ছিল না। তিনি শুধু এটুকু বোঝাতে চেয়েছেন যে, একজন ব্যক্তির পক্ষে এতগুলো অপারেশনে থাকা সম্ভব নয়!
এ যুক্তি সত্য ধরে নিলেও, আমার সাধারণ বুদ্ধিতে বলে যে, তারপরও সাঈদীকে ক্ষমা করার কোনো যুক্তি থাকে না। কারণ আপনারা জানেন, নতুন সংশোধিত আইনে যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তিবিশেষের পাশাপাশি, যুদ্ধাপরাধী সংগঠনকেও বিচারের কাঠগড়ায দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত হযেছে। সাঈদী পিরোজপুরের ঘাতক রাজাকার বাহিনির সংগঠক, পরিচালক ও নেতৃত্বদানকারী হিসেবেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন। এমন কী তিনি প্রত্যক্ষভাবে কোনো অপারেশনের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও, সংগঠক ও হুকুমদাতা হিসেবে তার বিচার হতে পারে।
তবে প্রকাশিত রায়ের অংশ থেকে আমরা জেনেছি যে, অন্তত দুটি হত্যার ঘটনায় তার প্রত্যক্ষ যোগ প্রমাণিত হওয়ার ফলে, ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। বাকি ছয়টি প্রমাণিত অভিযোগের জন্য আরও দণ্ড প্রাপ্য থাকলেও ট্রা্ইব্যুনাল সেগুলো নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি।
আমরা জানি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত ছিল ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল। এটির বিচারপ্রণালী থেকে এ শিক্ষাই পাওয়া যায় যে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে এধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সংগঠন ও এর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াই সঙ্গত এবং ইউরোপের নাজি পার্টির মতো জামায়াতকে নিষিদ্ধ করাও সমীচিন হবে| বিশেষত, নাজি পার্টির মতো জামায়াতে ইসলামীও তাদের কৃতকর্মের জন্য আজ পর্যন্ত কোথাও কোনো অনুতাপ প্রকাশ করেনি, তাদের নেতৃবৃন্দ কখনও কোনো শহীদ পরিবারের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাননি। তাই তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র ফিরে এসেছে এ কথা বিশ্বাস করা যায় না।
সুতরাং শুধু সাঈদী নয়, আরও যে কজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলছে তাদের বিচারও যাতে ন্যায়সঙ্গতভাবে হয় সে অপেক্ষায় জাতি সজাগ রয়েছে। পাশাপাশি এটাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, জামায়াতে ইসলামী এখন মরণ কামড় বসাতে উদ্যত হয়েছে। অহিংস গণতান্ত্রিক পথ ছেড়ে তারা চোরাগোপ্তা হামলা, বোমাবাজি, চাপাতি দিয়ে প্রতিপক্ষকে হত্যা, রগ কাটা, পুলিশ-হত্যা, মন্দির ও প্রতিমা ভেঙ্গে দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা শুরু থেকেই 'গৃহযুদ্ধের' যে হুমকি দিচ্ছিল, এখন তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হাতে-কলমে বাস্তবায়ন করছে।
অবশ্য উইকিলিকসের সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য থেকে এটা আমরা আগেই জেনেছি যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টিকে জামায়াতের অন্যতম নেতা এবং যুদ্ধাপরাধী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যরিস্টার আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছিলেন যে, বর্তমান সরকার জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি ঘোষণা করতে পারে। তিনি একথাও বলেছিলেন যে, সে রকমটি হলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ ওয়ান ইলেভেনের পথ ধরতে পারে। একথা বলে তিনি জামায়াতে ইসলামী যাতে বেআইনি ঘোষিত না হয় সে জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে হাসিনা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে বলেছিলেন। তার বক্তব্য, সেটা করতে হবে আমেরিকার নিজের স্বার্থেই।
এ প্রচ্ছন্ন হুমকি বা ব্ল্যাকমেইলের পাশাপাশি একথাও তিনি বলেছিলেন, যদি শেষ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি ঘোষণা করাই হয়, তবে দলটির সামনে খোলা থাকবে তিনটি রাস্তা- তারা তাদের গড়ে তোলা সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঢুকে যেতে পারে, বিদ্যমান ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঢুকে কাজ করবে, অথবা নতুন ইসলামী নাম নিয়ে পুনরায় আবির্ভূত হবে।
বোঝাই যাচ্ছে যে, জামায়াতে ইসলামী খরগোশ নয়, কচ্ছপের রণকৌশল গ্রহণ করে এগুবে। বন্ধুবর মশিউল আলমের কথাটি খুবই সত্য। সুতরাং শাহবাগ প্রজন্মের আন্দোলনের এ প্রাথমিক বিজয়কে ধৈর্যের সঙ্গে, দৃঢ়তার সঙ্গে, আরও ব্যাপকভাবে সমাজে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত করে দিতে হবে।
তিন দফা দাবির অন্য দুটি দফা, যেমন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ এবং তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বয়কট করা- সে কর্তব্যেরই ইঙ্গিত বহন করে। সরকারকে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নতুন আইনের অধীনে অভিযোগ দায়ের করতে হবে, এবং সে অভিযোগের শাস্তি হিসেবে জামায়াত ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করতে হবে। একই সূত্র ধরে, আরও অগ্রসর হয়ে একটি জাতীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে যারা জামায়াতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পদ ও আয়ের উৎসগুলো চিহ্নিত করবে, এবং তা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিবে।
অবশ্য ব্যরিস্টার রাজ্জাক মরিয়ার্টিকে জানিয়েছিলেন যে, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হলে দলটির ব্যাংক-ব্যালেন্স এবং দলটির কার্যালয়ে রক্ষিত সম্পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে; কিন্তু তাতেও তাদের অসুবিধা হবে না। তিলে তিলে গড়ে তোলা বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সেবা প্রতিষ্ঠানে তারা তখন ছড়িয়ে পড়বে এবং সেখান থেকেই কাজ শুরু করবে।
সুতরাং শাহবাগ প্রজন্মকে আজ বুঝতে হবে যে, লড়াইটা শুধু ফাঁসির লড়াই নয়- এটা হচ্ছে অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির জগতে ধর্মের অপব্যবহার রোধ করে, একটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলার আন্দোলন। অপহৃত বাংলাদেশকে অপহরণকারীর হাত থেকে মুক্ত করা দরকার। এ লড়াইয়ে বাংলাদেশকে জিততেই হবে। না হলে ত্রিশ লাখ শহীদের কাছে আমাদের ঋণ পরিশোধে আমরা ব্যর্থ হব।
শাহবাগ চত্বর থেকে ঘরে ফেরার পরও এ লড়াই চলবে; এবং এ লড়াই দীর্ঘমেয়াদী। নতুন প্রজন্মের এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য শেখ হাসিনার হাত সবল করা বা খালেদা জিয়ার হাত দুর্বল করা নয়, এ আন্দোলন অবশ্যই কোনো ধর্মের বিরদ্ধে নয়। এটি হচ্ছে অতীত ইতিহাসের দায়-পরিশোধ ও ন্যায়বিচারের আন্দোলন।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাম-ডান-মধ্যপন্থী যে-ই এ আন্দোলনের সঙ্গে থাকবেন না তাকে ভবিষ্যতে ইতিহাসের নির্মম শা্স্তি ভোগ করতে হবে। কারণ এটা হচ্ছে জাতীয় শত্রুর বিরুদ্ধে সমগ্র জাতির লড়াই।
ড. এম এম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।