Published : 24 Feb 2013, 12:12 AM
এ কথা সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের পর এভাবে বাংলাদেশ আর কখনও জেগে উঠেনি। প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ যেভাবে পুরো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে সেটা অতীতে দেখা যায়নি। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও দেশবিরোধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সন্ত্রাসী বাহিনি ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবিতে চত্বরটি হয়ে উঠেছে দৃপ্ত ও সাহসী শ্লোগানে ভাস্বর। সতেরো দিনের অহোরাত্রি কর্মসূচির পর এখন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সমাবেশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রজন্ম চত্বরের স্ফুলিঙ্গ সারা বাংলায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিতে চাই আমরা। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশ থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে, পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত গণজাগরণ মঞ্চ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যাবে; যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান ও জামায়াত-শিবিরের মতো বর্বর সংগঠন নিষিদ্ধের গণদাবির সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের জনসাধারণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষ্যেই এ কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ঢাকা বিভাগের পর দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও ধীরে ধীরে জেলা শহরগুলোতেও আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
গণজাগরণ মঞ্চের এ আন্দোলন থেকে বেশ কয়েকটি সফলতা এসেছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ছয় দফা দাবির মধ্যে দুই নম্বর দফা, অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন এবং যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানে যেকোনো প্রকারের আইনি জটিলতা নিরসন করা হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে কেবল রাষ্ট্রপক্ষ নয়, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিও আপিল করতে পারবেন। অন্যদিকে দেশবিরোধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সন্ত্রাসী বাহিনি ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে সংসদে আলোচনা হয়েছে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি যে, আন্দোলনটি সুনির্দিষ্টভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য দুটো ধারাকেই মূল্য দিতে হবে। প্রথমত, আইনের যে প্রক্রিয়া রয়েছে, তাতে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে; দ্বিতীয়ত, সাংস্কৃতিক বোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। আমরা ঠুনকো বা তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত চাই না, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি সুসংহত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন, যা এই বর্বর গোষ্ঠীকে চিরতরে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে। এ কারণেই গণজাগরণ মঞ্চ একদিকে যেমন আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ কক্ষ জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে, তেমনি সারা বাংলায় আবহমান বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনাপ্রসূত বোধের উদ্বোধনে উদ্যোগী হয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প মোকাবেলা করার জন্য এর বিরুদ্ধে বাঙালি সংস্কৃতির আকাশমুখী চেতনাকে দাঁড় করাতে হবে।
একটি বিষয় এখানে আলোচনা খুব জরুরি। ২২ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবির ও তাদের সমমনা বর্বর দলগুলো ধর্মের নামে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে, তা নজিরবিহীন। তারা গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে ধর্ম-অবমাননার যে মিথ্যে অভিযোগ এনেছে, সে দোষে আসলে তারা নিজেরাই দুষ্ট। ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে যে আন্দোলন আমরা শুরু করেছি, তা সকল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা ও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শ্লোগান ছিল এ ইস্যুকেন্দ্রিক। যে কয়টি ঘোষণা, যে স্মারকলিপি কিংবা যতগুলো পোস্টার গণজাগরণ মঞ্চ থেকে এসেছে, সেসবের কোথাও কোনো ধর্মকে অবমাননা করা হয়নি।
আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, এ আন্দোলন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য, জামায়াত-শিবিরের মতো ঘৃণ্য, দেশদ্রোহী, অপপ্রচারকারী, বর্বর সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার জন্য, তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করার জন্য। ধর্মকে নিয়ে এখানে কোনো বিবৃতি বা ঘোষণা কখনওই দেওয়া হয়নি, দেওয়া হবেও না। কারণ আন্দোলনটি কোনোভাবেই কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয়।
বস্তুত এ কারণেই, শুরুর দিন থেকেই সারা বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এখানে এসেছেন, সংহতি প্রকাশ করেছেন। আলেম, ইসলামি চিন্তাবিদ ও ইসলাম নিয়ে গবেষণা করছেন, কাজ করছেন এমন মানুষও এসেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন, আমাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। আন্দোলনের শুরু থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আমি দেখেছি, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষেরা কীভাবে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখানে এসেছেন, জয় বাংলা শ্লোগান দিয়েছেন, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধকরণের পক্ষে তাদের মতামত জানিয়েছেন।
আজকের দিনে তাই একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে, যাদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে এ আন্দোলনের আগুন আজ ছড়িয়ে গেছে সবখানে, যারা দিনরাত অবস্থান করেছেন আমাদের সঙ্গে, তারা তো একবারও এ প্রশ্নটি তুললেন না। মনে রাখতে হবে, ধর্মকে আশ্রয় করে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তারাই সে বাহিনি, যারা একাত্তরে ধর্মের নামে গণহত্যা চালিয়েছে, নারী নির্যাতন করেছে।
জামায়াত-শিবির দেশদ্রোহী আর দেশদ্রোহীরা কখনওই ধার্মিক নয়, কারণ ধর্মেই বলা আছে দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। যে বর্বর বরাহরা দেশের জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করে, শহিদ মিনারের মতো ইতিহাসের উজ্জ্বল স্মারক ভেঙে চুরমার করে দেয়, তারা কোনোভাবেই ধার্মিক নয়, হতে পারে না। তারা কেবল নিজেদের হীন স্বার্থ বাস্তবায়নে ধর্মকে ব্যবহার করে, সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতি অবলম্বন করে নানা কূটকৌশলে দেশবিরোধী তৎপরতা চালায়। এরা সকল ধর্মের শত্রু।
গণজাগরণ মঞ্চ ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সকল জনসাধারণের মঞ্চ, যারা সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে, যারা মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই, এ আন্দোলন তাদের। কেননা এ রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এ বর্বররা ছিল এর বিরোধিতাকারী। গণজাগরণ মঞ্চ ছয় দফার মাধ্যমেই তাদের দাবি ও চেতনাকে সুস্পষ্ট করেছে। এখানে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। আমাদের প্রতিপক্ষ যুদ্ধাপরাধী ও দেশবিরোধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সন্ত্রাসী বাহিনি ইসলামী ছাত্র শিবির। তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছি আমরা। আমাদের অনুপ্রেরণা একাত্তরের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের দাঢ্য চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের সূর্যমুখী চেতনা আর স্বাধীনতার পক্ষের সকল বাঙালির মিলিত কণ্ঠস্বর গণজাগরণ মঞ্চের গণতরঙ্গ।
এ গণতরঙ্গ রুধিবে সাধ্য কার?
মারুফ রসূল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী।