Published : 14 Feb 2013, 10:05 PM
শাহবাগকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের চলমান জন-আন্দোলনের লক্ষ্য, গতিপথ এবং চূড়ান্ত বিচারে এর সাফল্যের পরিমাপ করার সময় এখনও আসেনি। কেননা আর দশটা আন্দোলনের সাফল্য বিচারের যে মাপকাঠি তা এ ক্ষেত্রে যথাযথ বলে আমার মনে হচ্ছে না। আন্দোলনটির সূত্রপাত থেকে আমরা এর আশু কারণ সহজেই চিহ্নিত করতে পারি; একটি মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষ একমত হতে পারেননি এবং অধিকাংশ মানুষই মনে করেছেন যে, আদালতে যে সব অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে এর সঙ্গে দেওয়া শাস্তি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
শুধু তাই নয়, এ আশঙ্কাও মানুষের মনে জেগেছে যে এ ধরনের রায়ের পেছনে রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ রয়েছে। অনেকেই এথানে সবার অজ্ঞাতে আপোষ-সমঝোতার একটা ছায়া দেখতে পেয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের কথা স্মরণে রেখে এ রকম আশঙ্কা অনেকেই প্রকাশ করেছেন যে, দণ্ডপ্রাপ্তরা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সু্যোগে শাস্তি ভোগ নাও করতে পারে, এমনকি তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ও অধিষ্ঠিত হতে পারে।
কিন্ত যে কোনো আন্দোলনই একটি গতিশীল বিষয়, একটি পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ঘটনা-পরম্পরায় তা বিভিন্ন পথে অগ্রসর হয়। একটি আন্দোলন এর নিজস্ব গতি ও সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারে তখন যখন এর আবেদন সীমিত দাবি-দাওয়ার মধ্যে না রেখে একে যুক্ত করা যায় বৃহত্তর চেতনার সঙ্গে। সব আন্দোলন তা করতে সক্ষম হয় না। কিন্ত যে আন্দোলনগুলো ইতিহাসে মোড়-ফেরানো বলে চিহ্নিত হয়, সময়ের ধারা বদলে দেয়, সেগুলো কেবল ঘটনা-পরম্পরা দিয়ে প্রভাবিত হয় না- সেক্ষেত্রে আন্দোলনই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে- কেবল সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহই নয়, এর পরবর্তী যুগের ঘটনাও।
শাহবাগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা সে বৃহত্তর চেতনার বিষয়টি দেখতে পাই যখন এটি হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের অপূরিত স্বপ্ন ধারণ করে গড়ে ওঠা তরুণদের একটি আন্দোলন; যখন তা গোটা জাতিকে আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শিক দিকগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সহজ করে বললে, এটি মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নকে দলীয় সীমারেখার বাইরে সম্প্রসারিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আবার জাতীয় আদর্শে পরিণত করে তোলার পথে অগ্রসর হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনটি কেবল একটি বিচারের বা ট্রাইব্যুনালের বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; আন্দোলনের জন্য তৈরি করেছে এক বৃহত্তর প্রেক্ষাপট। এটি কেবল এ আন্দোলনের বক্তব্যেই রয়েছে তা নয়, বরং রয়েছে এর নৈতিক ভিত্তির মধ্যে।
আমাদের মুক্তিসংগ্রামের নৈতিক ভিত্তি হল ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। সে ন্যায়বিচার কেবল ব্যক্তির ন্যায়বিচার নয়, গোটা জাতির। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে পটভূমি তৈরি ও এর প্রস্ততি একদিনে হয়নি। যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বিবেচনা করে এসেছেন তাঁরা মুক্তিসংগ্রামের মৌলিক বিষয়টি হয় বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা অস্বীকার করতে চেয়েছেন। প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের মানুষের বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম, আত্মদানের ধারাবাহিকতায় সে নৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে এ জন্যই পুরো পর্যায়টিকে 'মুক্তিযুদ্ধ' না বলে 'মুক্তিসংগ্রাম' বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের সামরিক শাসনের আওতায় আমরা তা সংবিধান থেকে অপসৃত হতে দেখি।
আমাদের এ নৈতিক ভিত্তির শক্তি কতটা দৃঢ় ছিল সেটা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ওই সংগ্রামের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে শেখ মুজিব যে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন এর কারণ এটাই যে তা দিয়ে একটি জাতি নৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারে। আমাদের নৈতিক শক্তি ছিল বলেই একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনি এবং এর সহযোগী শক্তিগুলো, যেমন রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ বেসামরিক প্রশাসনকে আমাদের পক্ষে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনির বিরুদ্ধে দেশের ভেতরে ঐক্য এবং দেশের বাইরে যে সমর্থন আমার অর্জন করেছিলাম এর কারণ ছিল এই যে, আমাদের সংগ্রামের নৈতিক ভিত্তি ছিল প্রশ্নাতীত। আমরা লড়াই করেছিলাম ব্যক্তির এবং সমষ্টির জন্য ন্যায়বিচার, সমতা ও মুক্তি নিশ্চিত করতে।
আজকের চলমান আন্দোলন সে নৈতিক ভিত্তিকে যত বেশি জোরদার করতে পারবে তত বেশি এর আবেদন প্রসারিত ও এর শক্তি বৃদ্ধি হবে। এ আন্দোলন প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকে তৈরি হয়নি। গত চার দশকে রাজনীতির কূটচালে গোটা জাতি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সেটি নিশ্চিত করার জন্য যে তরুণদের পথে নামতে হয়েছে সেটা বারবার স্মরণ করা দরকার এবং দেশে ও দেশের বাইরে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা দরকার। আন্দোলনের সংগঠক-কর্মীরা যত দৃঢ়তার সঙ্গে এটা বলবেন ততই তা শেকড়গামী হবে; ততই বেশি করে প্রমাণিত হবে যে আন্দোলনের লক্ষ্য সীমিত নয়। এটা কেবল এ জন্যই দরকার না যে তাতে সমর্থন বাড়বে; এটা বলা দরকার এ কারণেও যে মানবতার বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে তাদের অবস্থান যে কতটা দুর্বল, কতটা অনৈতিক সেটি প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজের সর্বস্তরে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠবে এবং তা স্থায়ী রূপ লাভ করবে।
কেবল আইনি প্রক্রিয়া বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘৃণ্য অপরাধে অপরাধীদের পুনরুত্থান স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে পারে না তা আমরা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই জানি। গত চার দশকে এটা আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করেছি যে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা এ ধরনের ব্যক্তি ও দলের সঙ্গে আপস-সমঝোতা করতে মোটেই দ্বিধা করেননি। এর একটা অন্যতম কারণ হল সামাজিকভাবে নীরব কিন্ত নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান প্রতিরোধের ধারণাই আমাদের মধ্যে ছিল অনুপস্থিত।
সমাজের ভেতরে, আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে এবং প্রজন্ম-পরম্পরায় প্রতিদিনের জীবনাচারণে আমরা যদি একটা সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি করতে না পারি তাহলে আমাদের এরকম একটা উত্থানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক দশক। আমি যে সামাজিক প্রতিরোধের কথা বলছি সে জন্য বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হবে না। কেননা আমরা কেবলমাত্র ব্যক্তির থাকা না-থাকার কথা বলছি না; আমরা বলছি এমন এক সামাজিক পরিস্থিতির কথা যেখানে কেবল যে এ ধরনের ব্যক্তি, সংগঠন ও আদর্শ প্রত্যাখাতই হবে তা নয়- প্রত্যাখাত হবে তারাও যারা এ মনোভাবাপন্নদের সঙ্গে সামাজিক বা রাজনীতিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করবে।
এ ধরনের সামাজিক প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল নাৎসিদের বিরুদ্ধে দেশে দেশে বিরাজমান মনোভাব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নয়া নাৎসিবাদীরা যে পুনর্গঠিত হতে চেষ্টা করেছে; ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমরা সেটা লক্ষ্য করি। পাশাপাশি এটাও আমরা দেখতে পাই যে সমাজের একবারে ক্ষুদ্র অংশের বাইরে এরা বিস্তৃত হতে পারেনি। কারণ সমাজের সর্বস্তরে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনের প্রতিরোধের ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেবলমাত্র বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা অর্জিত হয়নি। সেটি হয়েছে নৈতিক শক্তির জোরে।
শাহবাগ আন্দোলনের মধ্যে সে নৈতিক শক্তির জোর রয়েছে। একে আরও সামনে নিয়ে আসা দরকার।
আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।