প্রিয়জনের মৃত্যুটা যদি আইসিউতে হয় তখন আমরা আত্মতৃপ্তি পাই যে, যাই হোক সর্বোচ্চ চেষ্টা তো করলাম। কিন্তু যিনি মারা যাচ্ছেন তিনি আইসিইউর বিছানায় নিঃসঙ্গ মেশিনের টিকটিক শব্দের মধ্যে কতটুকু প্রস্তুত হন অন্যভুবনে যেতে? সেটা কি ভাবি আমরা?
Published : 12 Oct 2024, 12:54 AM
“মৃত্যুই যেখানে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে মৃত্যুকে জীবনের কিনারায় সরিয়ে রাখার চেষ্টা কতই না করুণ”— কথাটি বলেছেন তুরস্কের ঔপন্যাসিক এলিফ শাফাক।
১২ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব হসপিস এবং প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিবস। ভালোভাবে বাঁচা এবং ভালোভাবে মারা যাওয়াকে যদি একটি অর্কেস্ট্রার সঙ্গে তুলনা করা যায় তবে ওই সুর এবং তাল যেন স্বাস্থ্যজনিত ভোগান্তির দ্বারা না কাটে। এই দিবসটির মূল লক্ষ্য তেমনই।
কেমন হতে পারে জীবনের সেই বেসুরো ছন্দ? এ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার খাতা থেকে একটি কেস রিপোর্ট তুলে ধরছি প্রথমে।
এক ভদ্রলোকের স্ত্রী আইসিইউকে। তিনি এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। অতঃপর মলিনমুখে একটি অনুরোধ করেন। যা আমার হৃদয়ে বেশ কেটে যায়। ভদ্রলোক বললেন, “আপা, আমি আইসিইউতে আমার স্ত্রীর হাতটা ধরে বসতে চাই। জানি এটা অ্যালাউড না। কিন্তু আমার দাবিটা কি খুব অযৌক্তিক? ও যেখানে রাতের বেলা ঘরের লাইট অফ থাকলে ভয় পায়, একা বাথরুমে যেতে ভয় পায়, সেখানে একদম একা একটা অন্য ভুবনে চলে যাচ্ছে, আমি যদি আইসিউতে ওর হাতটা ধরে থাকি, মনে মনে হয়তোবা একটু সাহস পাবে। খুব ইমোশনাল তো! কখনো তো ওকে একা একা ছাড়ি নাই। নিজের মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীর শুধু হাতটা ধরব সেটা কি একান্তই ভুল চাওয়া আমার? ইনফেকশন কন্ট্রোলের কথা বলছে, আমি প্রোপার ব্যবস্থা নিয়ে যাব, যেভাবে ডাক্তার-নার্সরা যাচ্ছেন। আমি তো জানিই আমার স্ত্রী মারা যাচ্ছে। আমি জানি সে লাইফ সাপোর্টে আছে। যদি লাইফ সাপোর্টে দেবার অনুমতির জন্য সই করতে পারি, যদি লাইফ সাপোর্ট উইথড্র করার জন্য অনুমতি দিতে পারি, তাহলে যে মানুষটা মারা যাচ্ছে তার হাতটা ধরে বসে থাকতে পারব না কেন?”
এমন প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। শুধু লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ। পরিচিত আইসিইউ ইনচার্জকে অনুরোধ করা ছাড়া আর করণীয় কিছু ছিল না। তিনিও তার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যেতে দিয়েছিলেন।
ভদ্রলোকের প্রশ্নটা কয়েকদিন আমার মনে বারবার ফিরে আসছিল।
ইদানিং পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে কতটা কম বুঝি সেটাই বারবার চোখের সামনে ফুটে ওঠে। অবাক হয়ে ভাবলাম, আমাদের ডাক্তারি শিক্ষা জীবনে ‘End of life care’ আসলে কতটুকু পড়ানো হয়?
মৃত্যু একটা মানুষের শুধু শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নয়। কারণ এটা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের অংশ নয়। স্বাস্থ্যের অংশই হলো শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য।
বহুদিন আগেই আমরা high quality death সুনিশ্চিত করতে আমাদের মৃত্যুপথযাত্রীর বিছানার পাশে থেকে হুজুর/পুরোহিত অনেককেই সরিয়েছি। এরপর সরালাম কমিউনিটিকে। ফলে শেষপর্যন্ত মৃত্যুটা যদি আইসিউতে হয় তখন আমরা আত্মতৃপ্তি পাই যে, যাই হোক আমি তো সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। কিন্তু যিনি মারা যাচ্ছেন তিনি আইসিইউর বিছানায় নিঃসঙ্গ মেশিনের টিকটিক শব্দের মধ্যে কতটুকু প্রস্তুত হন অন্যভুবনে যেতে?
যতক্ষণ পর্যন্ত তার মস্তিষ্ক কাজ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষটি কতটুকু ভয় পান, একা একা এই পথ চলায়? তিনি কতটুকু দুঃখ পান তার প্রিয় মুখগুলো আশেপাশে হাত ধরে নেই বলে? তার কি তখন রাগ হয়? কতটুকু অসহায় বোধ করেন?
এই মৃত্যুটি তো আমারও হতে পারে। আর প্রিয় মানুষগুলো আইসিইউর দেয়ালের বাইরে বোবা অপেক্ষায় কীভাবে ছিন্নভিন্ন হতে থাকেন? আইসিইউ কর্মীরাই বা কীভাবে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর এই অবিরাম বেদনার ভার নেন?
মৃত্যুটা কি আরও একটু ভালো হতে পারে না?
গবেষণায় দেখা গেছে, আইসিইউতে ভর্তি রোগী জীবনের অন্তিম মুহূর্তে সরাসরি আইসিইউ থেকে বাসায় গিয়ে কোনোরকম থেরাপিউটিক বা চিকিৎসা সংক্রান্ত বাহুল্য বাদ দিয়ে পরিজনদের সঙ্গে মৃত্যুপথে যাত্রা করতেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই মৃত্যু রোগী এবং তার পরিবারের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় প্রথায় হওয়াটা রোগী এবং তার পরিবারের জন্য স্বস্তিদায়ক।
কাজেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে এখন একটা প্রশ্ন উঠে এসেছে, একজন মানুষ যখন নিজের ঘরে মারা যেতে চান কীভাবে ওই শিক্ষাটি স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা পূরণ করতে পারেন? একজন মৃত্যুপথযাত্রী যখন হাসপাতালের বিছানায় অন্তিম দিন গুণছেন, ওইই অভিজ্ঞতা তার আত্মীয়দের পক্ষেও ভয়ংকর। এই কারণেই আইসিইউতে প্যালিয়েটিভ কেয়ার চর্চা এখন সময়ের দাবি।
কিন্তু মুশকিল হলো বাংলাদেশের এই সেবা এখন পর্যন্ত ঢাকাকেন্দ্রিক। আধুনিক প্রজন্মে মানুষের মারা যাওয়ার ধরনের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। অনেকের ক্ষেত্রেই মৃত্যু অনেক দেরিতে আসে ও মরণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘায়িত হয়। পরিবার ও সম্প্রদায়ের বিন্যাস থেকে মৃত্যু এখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ভেতরে চলে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবনের শেষপর্যায়ে নিরর্থক ও অনুপযুক্ত চিকিৎসা চলে। ফলে মৃত্যু ও মরণ বর্তমানে অপরিচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং একইসঙ্গে পরিবার ও সম্প্রদায়ের ভূমিকা কমে এসেছে। এই বিষয়ে মানুষের দক্ষতা, প্রথা ও জ্ঞান হারিয়ে গেছে।
উচ্চ আয়ের দেশে মৃত্যু ও মরণ ভারসম্যহীন হয়ে গেছে এবং স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশেও একই জিনিসই হতে চলেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিকে মনোযোগ না দিয়ে বরং জীবনের শেষ সময়ের জন্য ক্লিনিক্যাল বিভিন্ন আবিষ্কারের দিকে সবার মনোযোগ অনেক বেশি।
কোভিড-১৯ মহামারীর সময় মিডিয়াগুলোতে দৈনিক মৃত্যু লক্ষণীয় হারে দেখানোর ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিচলিত হয়ে পড়ে। মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাসপাতালে একাকী মারা গেছে। অনেকেরই পরিবারের সঙ্গে শেষ কথাও হয়নি। সামনাসামনি পরিবারের সঙ্গে কোনো কথা তো হয়ইনি বরং যা হয়েছে সবই ইলেক্ট্রোনিক্যালি। এই অবস্থা মানুষের মৃত্যুভীতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন বিষয়কে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করেছে।
মৌলিকভাবে মৃত্যুর উত্তম ব্যবস্থাপনায় মৃত্যুর গুরুত্ব নিয়ে ল্যান্সেট কমিশন পাঁচটি নীতি ঘোষণা করেছে— মৃত্যু ও মরণ কী রকম হতে পারে তার নতুন দর্শন। নীতি পাঁচটি হলো: মৃত্যু, মরণ ও শোকের সামাজিক নির্ধারকগুলোর সম্মুখীন হওয়া; মৃত্যুকে শুধুমাত্র শরীরবৃত্তীয় একটি বিষয় মনে না করে বরং আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া হিসেবে উপলব্ধি করা; যারা মারা যাচ্ছে, যারা যত্ন করছে ও যারা শোক করছে তাদের সকলের প্রতি যত্নশীল হওয়া; মৃত্যু, মরণ ও শোক নিয়ে কথোপকথন ও গল্প স্বাভাবিক হিসেবে দেখা; এবং মৃত্যুর গুরুত্ব উপলব্ধি করা।
একজন চিকিৎসক, তিনি যখন নিরাময়েঅযোগ্য জীবন সীমিত রোগে আক্রান্ত, তখন তিনি কেমন মৃত্যু চান? তিনি তার রোগীদেরকে যেভাবে মৃত্যু অফার করছেন নিজের জন্য কি একইপন্থায় মৃত্যুবরণ বেছে নিচ্ছেন? এটি কিন্তু একটি মৌলিক প্রশ্ন। যেখানে বিতর্ক হতে পারে একজন ডাক্তার রোগীকে যেই মৃত্যু দিচ্ছেন নিজের জন্যও কি সেই মৃত্যু নিচ্ছেন কি নিচ্ছেন না।
যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি জরিপ হয়েছিল ২০১২ সালে। সেখানে উঠে এসেছে যুক্তরাজ্যের চিকিৎসক যে মৃত্যু তার রোগীকে অফার করছেন নিজের জন্য ওই একইপন্থার মৃত্যু বর্জন করছেন। ভালো মৃত্যুর সংজ্ঞা খুঁজতে বই পড়তে হবে না; নিজেকে প্রশ্ন করুন আমি আমার জন্য কোন মৃত্যুটিকে ভালো মনে করি? কেমন মৃত্যু চাই নিজের জন্য?
ব্রুস লিকে ধার করে শেষ করি। তিনি বলেছেন, “আমি যে সত্যটি খুঁজছিলাম- এই সত্যটি মৃত্যু। তবু মৃত্যুও অন্বেষী। চিরকাল আমাকে খুঁজছে। তাই আমরা শেষ পর্যন্ত দেখা করেছি। এবং আমি প্রস্তুত, আমি শান্তিতে আছি।”
নিজের জন্য যেমন মৃত্যু চাইব সেটাই ভালো মৃত্যু। একটিবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো তার পরিবারের জন্য আপনি কী করতে পারেন? নিজের সীমিত সক্ষমতার বাইরে কার সাহায্য চাইতে পারেন? ঠিক এই জায়গাটি থেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে শাখাটি কাজ করে ওই শাখাটির নাম ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্যালিয়েটিভ কেয়ার হলো এমন একটি উদ্যোগ যা নিরাময়অযোগ্য রোগী এবং তার পরিবারের জীবনের গুণগত মান বাড়ায়, প্রাথমিক পর্যায়ে জীবন সীমিতকারী রোগ শনাক্তকরণ, তা প্রতিরোধ ও ভোগান্তি কমানো এবং নিখুঁত বিশ্লেষণসহ ব্যথা ও অন্যান্য শারীরিক মনোসামাজিক এবং আত্মিক সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রয়াস পায়। এসব সেবা রোগ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় এবং রোগীকে এই রোগ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হোক বা না হোক প্যালিটিভ সেবা চলতে থাকে। তাই সহজ ভাষায় নিরাময়অযোগ্য জীবন সীমিত রোগে আক্রান্ত মানুষটির রোগমুক্তি নয় বরং ভোগান্তি কমানোর সঙ্গে সঙ্গে রোগীর পরিবারের যত্নের কথাও বলে।
কাজেই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য খুবই জরুরি প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্যালিয়েটিভ কেয়ার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এর জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগ।
কারণ বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রটি এত বড় যে সবাই মিলে হাত লাগালেও আগামী ২০ বছরেও ওই চাহিদা পূরণ হবার নয়। এ কারণেই প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে চিকিৎসা ব্যবস্থায় আবদ্ধ না রেখে একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। কারণ মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে সমন্বিত করতে না পারলে বেহালায় জীবনের সুরের ছন্দপতন ঘটবে। পাশাপাশি প্রত্যেককে বুঝতে হবে যে প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিজের জন্যই একটি বিনিয়োগ।
ছবি: প্যালিয়েটিভ কেয়ার সোসাইটি অব বাংলাদেশ
তথ্যসূত্র
1.Hold JL. A good death. Nurs Ethics. 2017 Feb;24(1):9-19.
2.Beuks BC, Nijhof AC, Meertens JH, Ligtenberg JJ, Tulleken JE, Zijlstra JG. A good death. Intensive Care Med. 2006 May;32(5):752-3.
3.Boussarsar M, Bouchoucha S. Dying at home: cultural and religious preferences. Intensive Care Med. 2006 Nov;32(11):1917-8.
4.Hoogveld LM, Bergmans DC, de Vries S, van Proemeren H, van den Beuken-van Everdingen MH, Zijlstra JG, van Mook WN. IC-patiënten die thuis willen overlijden: hoe kun je deze laatste wens vervullen? [Intensive care patients who want to die at home: how can we fulfil this last wish?]. Ned Tijdschr Geneeskd. 2015;159:A8711. Dutch.
5.Donnelly SM, Psirides A. Relatives' and staff's experience of patients dying in ICU. QJM. 2015 Dec;108(12):935-42.
6.Restau J, Green P. Palliative care in the intensive care unit. Crit Care Nurs Clin North Am. 2014 Dec;26(4):551-8.
7. https://www.theguardian.com/society/2012/feb/08/how-doctors-choose-die