চর সাজাই: জীবন যেখানে দুর্বিষহ

ফেসবুক নয়, ইনস্টাগ্রাম নয়, হলিউডি-বলিউডি নায়ক-নায়িকা, ঝাঁ-চকচকে জীবন নয়, সামান্য একটু ভাতের স্বপ্ন নিয়ে ক্লান্ত হয়ে এরা ঘুমিয়ে যায়। আর সকালে জাগে খিদে আর হতাশা নিয়ে।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 6 August 2023, 10:25 PM
Updated : 6 August 2023, 10:25 PM

আমরা ঢাকা থেকে খুব ভোরে রওনা হয়েছিলাম। গন্তব্য চর সাজাই। সঙ্গে ছিলেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম তাহমিদুজ্জামান, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক রেজাউল করিম সিদ্দিক ও চর সাজাই কল্যাণ ট্রাস্টের কোষাধ্যক্ষ ফওজুল আজিম। উদ্দেশ্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ বার্ষিকীতে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পক্ষ থেকে সেখানে ১৫শ দরিদ্র পরিবারের মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র ও গাছের চারা বিতরণের কাজে অংশগ্রহণ। এ কর্মযজ্ঞের আয়োজনে ছিল চর সাজাই কল্যাণ ট্রাস্ট।

চর সাজাই কল্যাণ ট্রাস্টের সন্ধান দিয়েছিলেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সতীর্থ ফওজুল আজিম। তিনি এই ট্রাস্টের কোষাধ্যক্ষ। বছর দুই আগে তারা সমমনা কয়েকজন মিলে মানব কল্যাণের সদিচ্ছা নিয়ে এই ট্রাস্ট গঠন করেছেন। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে কখনও কয়েকটি দরিদ্র পরিবারকে কাপড় কিনে দিয়েছেন। কখনও ঈদের আগে দেড়শ টাকা, কিছু সেমাই কিনে দিয়েছেন। কখনও কিছু চাল-ডাল দিয়েছেন। চরবাসীর অনন্ত চাহিদার তুলনায় এসব সাহায্য হয়তো কিছুই না। তবু তারা লেগে আছেন। তাদের দেখাদেখি যদি আরও কিছু মানুষ এগিয়ে আসে! তা যদি নাও আসে, তবু তারা নিজেরা যদি দু-চারটি পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, তাই বা কম কী? খুব ছোট আকাঙ্ক্ষা, ছোট উদ্যোগ।

কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে চর সাজাই গ্রাম। এর আয়তন ১১ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ২৬,০০০। কোদালকাটি ইউনিয়নটি চার পাশ নদ-নদী বেষ্টিত। পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণে সোনাভরি নদী।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর। উত্তরে রৌমারী, পূর্বে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে জামালপুর ও গাইবান্ধা, পশ্চিমে গাইবান্ধা ও চিলমারী উপজেলা। এখানে দারিদ্র্যের হার ৭৯.৮ শতাংশ। জেলা সদর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ। যাতায়াত ব্যবস্থা মোটেও ভালো নয়। নৌকা থেকে ভ্যানে অথবা হেঁটে বাজারে আসতে হয়।

আমরা সড়ক পথে চর রাজিবপুর পর্যন্ত গিয়ে সেখানে স্পিড বোটে নদী পার হয়ে যখন চর সাজাই গ্রামে পৌঁছাই তখন সকাল প্রায় সাড়ে এগারটা। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান মধ্য চর সাজাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকিদুল ইসলাম (আহাদ মাস্টার), রাজিবপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মাহমুদুল হাসান, চর সাজাই কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারপারসন ও প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ পারভেজ শামসুদ্দীন, ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক শহীদুল ইসলাম বাবলু, ট্রাস্টি ও শিল্প ব্যাংকের ডিজিএম জসিমউদ্দিন খান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গণযোগাযোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু নাসের রাজীব প্রমুখ।

আমরা সেখানে পৌঁছে দেখি, মধ্য চর সাজাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে একটা মঞ্চ তৈরি করে চর সাজাই কল্যাণ ট্রাস্টের স্বেচ্ছাসেবকরা শত শত নারী পুরুষের মাঝে সহায়তা সামগ্রী বিতরণ করছেন। আমরা গিয়ে সেই বিতরণ কাজে অংশগ্রহণ করলাম। উদ্যোক্তরা কিছু কথা বলারও সুযোগ করে দিলেন।

আমরা সহায়তা সামগ্রী বিতরণের ফাঁকে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সেখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাবার চেষ্টা করছিলাম। প্রবীণদের ভাষ্য মতে, ব্রহ্মপুত্র নদই তাদের যাবতীয় দুঃখের কারণ। এই নদের করাল গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে পুরো উপজেলা। ব্রহ্মপুত্র নদটি একাধিক চ্যানেলে বিভক্ত হয়ে ভারতের আসাম রাজ্য থেকে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় প্রবেশ করেছে।

প্রতি বছর বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে এ এলাকার ব্যাপক নদী ভাঙন দেখা দেয়। ফলে এলাকার সরকারি ও বেসরকারি বহু স্থাপনা, বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর শতাধিক গ্রাম মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এ সব গ্রামের হাজার হাজার মানুষ তাদের বাপ-দাদার ভিটে মাটি হারিয়ে পরিণত হচ্ছে ভূমিহীনে।

পুরো চর ঘুরে অসংখ্য নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে মনটা কেমন বেদনাহত হয়ে উঠল। চর সাজাইয়ের মানুষজন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। তাদের জীবনে দুঃখ, দুর্দশা আর না-পাওয়ার বেদনা ছাড়া যেন অন্য কোনো গল্প নেই। বর্ষা মৌসুমে ভরা বন্যার সময় তাদের চলাচলের বাহন নৌকা বা কলা গাছের ভেলা। বাকি সময় ধু ধু বালুচর আর মেঠো পথে পায়ে হেঁটে চলা। এলাকায় কাজ নেই। পরিবারের সামর্থ্যবান পুরুষরা কাজের খোঁজে ঢাকা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় যান। কেউ কেউ পরিবারে টাকা পাঠান। কেউ কেউ পাঠাতে পারেন না। যে টাকা পাঠান, তাতে পরিবারের সবার খাবার কেনা সম্ভব হয়। ক্ষুধার দেবতা তাদেরকে সব সময় চোখ রাঙায়। এসব পরিবারের নারী-শিশু-বৃদ্ধরা চরম খাদ্যসংকটে দিনাতিপাত করে। বন্যা ও নদের অব্যাহত ভাঙনের কারণে তাদের দুঃখের রাত্রি কখনও পোহায় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তারা আরও বেশি দিশেহারা।

নদে ভাঙা পরিবারগুলো অন্যের জমি চুক্তিভিত্তিক ভাড়া নিয়ে থাকে। বেশিরভাগই পেশায় দিনমজুর। সম্পদ বলতে এক-দুটি গরু, ছাগল আছে। এখানকার প্রায় সব মানুষই গরিব। নদের ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। প্রতি বছর বন্যায় নদ ভাঙে। কিছু মানুষ বসতবাড়ি হারায়। আরও একধাপ গরিব হয়ে যায়। কোদালকাটি ইউনিয়নে তিন কিলোমিটার এলাকায় ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ চলমান রয়েছে। এতে কতটুকু কী হবে, তা এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

এখানে সমস্যার কোনো শেষ নেই। মানুষের রোগ-ব্যাধির পাশাপাশি আছে গবাদি-পশুর রোগ-বালাই। ঘরে অভাব। পেটে ক্ষিধে। তাই এখানে পারিবারিক কলহও অনেক বেশি। নারী ও শিশু নির্যাতন নৈতিত্তিক ঘটনা। এখানকার নারী ও শিশুরা এমনিতেই অপুষ্টির শিকার।

এসব চরের পুরুষেরা কাজের সন্ধানে শহরে গেলে তাদের পরিবারগুলো বাড়িতে হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন, ভোগে নিরাপত্তাহীনতায়। এ সময় অনেক পরিবারের নারী ও মেয়েশিশুর ওপর যৌন নির্যাতন চলে। পরিবারে পুরুষ সদস্যরা বাড়িতে না থাকায় তাদের এসব হয়রানি নীরবে মেনে নিতে হয়। কেউ এসবের প্রতিবাদ করলেও সুবিচার পায় না। উপরন্তু এসব ঘটনা জানাজানি হলে ওই নারীকেই ‘কলঙ্কিনী নারী’ হিসেবে থাকতে হয় সমাজে। তাই চরাঞ্চলের দারিদ্র্য পীড়িত নারীরা মুখ বুজেই সহ্য করেন এসব নির্যাতন।

অভাব এদের পিছু ছাড়ে না। কেননা চরের জীবন মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই আলাদা। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এই চরের মানুষেরা স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা, জীবন-জীবিকা, অন্যান্য সেবা ও সুযোগ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। এখানকার স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা খুবই করুণ। কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎস সীমাবদ্ধ। বর্ষায় থাকে না স্যানিটেশন ব্যবস্থা, নিরাপদ পানি। ডাকাতি, চুরির ভয়ে ঘর ছাড়ে না কেউ। সাপের ভয়ে ঘুমাতে পারে না। সুবিধাবঞ্চিত এই চরবাসীর তাই দুঃখের শেষ নেই। চরের মানুষের পরিবার-পরিকল্পনা জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারে সচেতন না হওয়ায় অধিক সন্তান জন্মদান এবং বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি। অসুখ-বিসুখে চরের মানুষ কমিউনিটি ক্লিনিক ও গ্রাম্য ডাক্তার, কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক ও পানি পড়ার ওপর নিভর্রশীল। শুষ্ক মৌসুমে কিছুটা সুখের মুখ দেখলেও বর্ষা মৌসুমে ভাসমান জীবন যাপনে কষ্টের শেষ নেই তাদের। 

চরে বিদেশি গাছ লাগানোর প্রবণতা বেড়েছে। যা পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ। সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইউক্যালিপটাস গাছ রোপণ করা হচ্ছে। বাজারজাতকরণ কষ্টসাধ্য হওয়ায় উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় চরম বঞ্চনার মুখে পড়েছে কৃষক।

এখানে কষ্টে-সৃষ্টে একটু ঘুরে দাঁড়ানো মানুষেরা বার বার বন্যা আর নদী ভাঙনের শিকার হন। চার-পাঁচ বছরের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে গড়া বাড়িঘর বিলীন হয়ে যায়। নিঃস্ব হতে হয় আবারও। অবশিষ্ট থাকে শুধু দুটি হাত আর নতুন চরের ধু ধু বালু জমি। এ অবস্থায় কিছু পরিবারের প্রাইমারি পাশ করা সন্তানরা কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরে পাড়ি জমালেও সেখানে তাদের শ্রমিকের কাজ ছাড়া আর কিছুই জোটে না। তাদের সামান্য রোজগারে নিজেদের খরচ মেটানোর পর পরিবারের জন্য আর কিছুই করতে পারে না।

আমরা মধ্যবিত্তরা যেন এক অলীক কল্পনার জগতে বাস করি। রঙ-বেরঙের নিয়ন আলো, সড়ক মহাসড়ক, বিশাল বিশাল ব্রিজ, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, গভীর সমুদ্র বন্দর, আইটি পার্ক, মেট্রেরেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল, নতুন নতুন বহুতল ভবনে আচ্ছন্ন আমাদের মন। প্রতিদিন আমরা ফেসবুকে কত রঙের কথা লিখি, কত ঢঙের ছবি পোস্ট করি। কত কিছু নিয়েই না মত-মন্তব্য ট্রল করি। অথচ চর সাজাইয়ের হাজার হাজার মানুষ এখনও তিন বেলা খেতে পায় না। শিশুরা চিকিৎসা পায় না। এরা কখনও বলতে পারে না যে, জীবন সুন্দর। ফেসবুক নয়, ইনস্টাগ্রাম নয়, হলিউডি-বলিউডি নায়ক-নায়িকা, ঝাঁ-চকচকে জীবন নয়, সামান্য একটু ভাতের স্বপ্ন নিয়ে ক্লান্ত হয়ে এরা ঘুমিয়ে যায়। আর সকালে জেগে ওঠে এক বুক খিদে আর হতাশা নিয়ে। এদের জীবনে কোনো স্বপ্ন নেই। রাজনীতি নেই। গণতন্ত্র নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। এরা শুধু একটু ভাত-কাপড়ের স্বপ্ন দেখে। এদের জীবনে বেঁচে থাকাটাই যেন সবচেয়ে বড় পাওয়া!