নিদারুণ সত্য হলো আন্দোলনের শতদিনেও রাষ্ট্র পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিলের প্রতি দরদী হয়নি। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক।
Published : 23 Mar 2025, 04:15 PM
মুক্তবিশ্বকোষ নামে পরিচিত ‘উইকিপিডিয়া’তে পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশ বিষয়ক অংশটুকু পড়লে যে কেউ ভিমরি খাবে। বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে এই মার্চের ২০ তারিখে দেখা উইকিপিডিয়ার বয়ানের ভেতর দিয়ে দেখি তাদের অতি দুর্বল গবেষণা এবং অমনোযোগী অসতর্ক আচরণ।এক টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধিতাকে ‘উইকি’ বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করে কী বার্তা দিতে চায়?
দুইশ বছর ধরে যে ভূগোল পরিবেশ আন্দোলন করছে, দুনিয়ার আদি পরিবেশ-বার্তাকে সামাজিক সংগ্রামে রূপ দিয়েছে, সেইসব ইতিহাস পরিবেশনে অবশ্যই সৎ, সতর্ক এবং দায়িত্বশীল থাকা উচিত। বাংলাদেশের মানুষ হাতিখেদা বিরোধী বিদ্রোহ করছে। ১৮০০ থেকে ১৮৩০ পর্যন্ত এই লড়াই চলছে। বনের হাতি ধরে বাণিজ্য করার বিরুদ্ধে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ আন্দোলন করেছে। নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুরে বনের হাতি বাঁচাতে গিয়ে হাজং মনা সর্দার, রতিয়া হাজং, বিহারী হাজং, জগ হাজং, সোয়া হাজং শহীদ হয়েছেন। হাতি ব্যবসায়ী রাজা তাদের পিষে মেরে ফেলেছিলেন। বনের হাতি বাঁচাতে জীবন দেয়া এই পরিবেশ-শহীদদের ভুলে গেলে চলবে না আমাদের।
নিম্নবর্গের পরিবেশ-বীক্ষা ব্রিটিশ উপনিবেশকালে বহু লড়াই সংগ্রামের ভিত গড়েছিল। ষাটের দশকে রাষ্ট্রের বহু জুলুমকে পরিবেশ-আয়নায় আরও প্রবলভাবে পাঠ করা শুরু করে গ্রামীণ নিম্নবর্গ। কিন্তু এসব পরিবেশ আন্দোলনের কোনো হদিশ রাষ্ট্র বা এজেন্সি রাখেনি। কারণ গরিব মেহনতি মানুষের রক্তদাগের খতিয়ান লেখা বা বলার মতো কোনো ইতিহাস-প্রকল্প গড়ে তোলা হয়নি। কারণ এই দেশে ইতিহাস বানায় বড়লোক বাঙালি ব্যাটারা। আর কিছু একাডেমিক এবং এলিটদের নুনের ছিটা থাকে। তাই দেখা যায় বালিশিরা পাহাড় আন্দোলন (১৯৬৩), কাপ্তাই বাঁধ বিরোধী আন্দোলন (১৯৬০) কিংবা মহিমাগঞ্জ সুগারমিলের আগ্রাসন থেকে জমি-জলা রক্ষা আন্দোলন (১৯৬২) আমাদের জাতীয় ইতিহাস হয়ে ওঠে না। বালিশিরা পাহাড় বাঁচাতে গিয়ে ৮০ বছরের প্রবীণ কৃষক গণু মিয়া আর ১৯ বছরের তরুণ সালিক মিয়া শহীদ হয়েছিলেন। আমাদের ঐতিহাসিক সব পরিবেশ-সংগ্রামের কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। বৃহৎ বাঁধের মাধ্যমে নদীপ্রবাহ হত্যার বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানীর ফারাক্কা বিরোধী আন্দোলনের কথা আমাদের বলতে হবে। ভাসান পানি আন্দোলনের বরুণ রায় ও লালমোহন রায়দের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে। ঘুঘুদহ কিংবা ভবদহ বিল রক্ষার আন্দোলন সকল শ্রেণি-বর্গকে একত্র করেছিল। চিংড়িঘেরের আগ্রাসন থেকে জীবন জনপদ বাঁচাতে শহীদ হয়েছেন জায়েদা ও করুণাময়ী সর্দার। মেনকীফান্দা, ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলন, ফুলবাড়ী আন্দোলন থেকে শুরু করে সহস্র পরিবেশ জনসংগ্রাম বাংলাদেশের পরিবেশ-আন্দোলনের ভিত মজবুত করে চলেছে। এই ধারাবাহিকতায় সমকালে রাসায়নিক দূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, বায়ু দূষণ, দখল, ইকোসাইড, উদ্যান-পার্ক রক্ষা, পরিবেশ ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতি কিংবা জলবায়ু ন্যায্যতার আন্দোলনগুলো নানাভাবে দানা বেঁধেছে।
প্রায় একশ দিন ধরে পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিল রক্ষায় ঢাকায় একটি আন্দোলন চলছে, যা বিগত বহু পরিবেশ আন্দোলন থেকে নানাভাবেই ভিন্ন। কারণ একশ দিন ধরে কিছু তরুণ পরিবেশকর্মী, শিল্পী ও সংগঠক পান্থকুঞ্জ পার্কে অবস্থান করে এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ভেতর একটি নতুন বছর এসেছে। তীব্র শীতকাল গিয়ে তাপদাহের কাল আসছে। মশা, শব্দ, ধূলি ও বায়ু দূষণের প্রচণ্ড উৎপাতের ভেতরেও তরুণেরা মুমূর্ষু পান্থকুঞ্জ পরিষ্কার করেছেন। যথাসাধ্য প্লাস্টিক ও আবর্জনামুক্ত করেছেন। শাকসবজি চাষ করেছেন।বীজ বুনেছেন, চারা রোপণ করেছেন। শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা গড়েছেন পরিবেশবান্ধব নানা স্থাপনাশিল্প।
‘বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন’ এই আন্দোলনের মূল সমন্বয়ক। বিভিন্ন সামাজিক-পরিবেশ-সাংস্কৃতিক-পরিকল্পনা-পেশাজীবী-সাংস্কৃতিক সংগঠন সংহতি জানিয়েছে। পরিবেশকর্মী, নগর পরিকল্পনাবিদ, সমাজকর্মী, গবেষক, এলাকাবাসী, স্থপতি, প্রকৌশলী, সংস্কৃতিকর্মী, ছাত্র-তরুণ-জনতাসহ নানা শ্রেণি-বর্গের মানুষ নানাভাবে পান্থকুঞ্জ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। বহু মানুষ বিশেষত স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীরা এই আন্দোলনের দাবির পক্ষে লিখেছেন। কিন্তু নিদারুণ সত্য হলো আন্দোলনের শতদিনেও রাষ্ট্র পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিলের প্রতি দরদী হয়নি। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক।
পান্থকুঞ্জ রক্ষা আন্দোলনের শুরুর দিকে ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তিন উপদেষ্টা পান্থকুঞ্জ পার্কে এসে আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলেন এবং বিষয়টি সুরাহার জন্য দ্রুততম সময়ে একসাথে বসার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তিন মাস গত হলো একসাথে বসার সময় হলো না। পান্থকুঞ্জ আন্দোলন আর স্রেফ একটি উদ্যান বা জলাধার বাঁচানোর দাবি হিসেবে রইল না। উন্নয়নের মেগা সুড়ঙ্গ খনন করে তরুণরা সামনে আনা শুরু করলেন মুনাফা আর বাণিজ্যের লোভ, জালিয়াতি আর কর্তৃত্ব কিংবা বিনিয়োগ রাজনীতির অমীমাংসিত সব প্রশ্ন। রাষ্ট্রের উন্নয়ন-দর্শনকে নানাভাবে নাগরিকবর্গ প্রশ্ন করা শুরু করলেন। শততম দিনেও আস্থা হারায়নি পান্থকুঞ্জের শক্তি, আস্থা রাখছে রাষ্ট্র পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল আগলে দাঁড়াবে।
পান্থকুঞ্জ আন্দোলনের দাবিটি অতি সামান্য ও সরল। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জন্য এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক বাতিল করতে হবে। এই সংযোগ সড়ক কেবলমাত্র কিছু ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকের স্বার্থ রক্ষা করবে কিন্তু তৈরি করবে ভয়াবহ যানজট। মানুষসহ পাখি-বৃক্ষ-পতঙ্গ-প্রাণী ঢাকার নাগরিকরা হারাবে একটি উদ্যান আর জলাধার। তাহলে এই বিলাসী ও প্রাণবিনাশী স্থাপনা কেন বাতিল হবে না?
এক নির্দয় শহরের স্বাক্ষী পান্থকুঞ্জ
ঢাকার ব্যস্ততম কারওয়ানবাজারের কাছে পান্থপথে পান্থকুঞ্জের অবস্থান। কাঁঠালবাগানের প্রভাতী সংঘ এই রুগ্ন উদ্যানটিকে নিজেদের শ্রমে-ঘামে জাগিয়ে তুলেছিলেন একসময়। প্রভাতী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কে এম আলমগীর বলছিলেন, তাদের শৈশবে এলাকাটি নিচু জলাভূমি ছিল। কিছু বুনো ঝোপ, শিমূল, চাম্বল আর পাকুড় গাছ ছিল। কাছেই ছিল পালপাড়া। এখানে তাদের এক প্রাচীন চিতাখোলা ছিল। কাছের হাতিরপুল বাজারকে তখন ‘পারহাউজ’ বলা হতো। ফুলবাড়িয়া (গুলিস্তান) থেকে হাতিরপুল হয়ে তেজগাঁও একটি রেললাইন গিয়েছিল। সন্ধ্যার পর সাধারণত এদিকে কেউ আসার সাহস করত না। গা ছমছম করা রাত নামত এই ছোট্ট জলায়।
প্রভাতী সংঘের আরেক সদস্য মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন বর্ষাকালে এখানে তাদের মাছ ধরার স্মৃতিচারণ করলেন। টেংরা, পুঁটি, শিং, চাপিলা, শোল, মাগুর মাছ পাওয়া যেত অনেক। হেমন্তে অনেকে এখানে টমেটো-বেগুন ইত্যাদি সবজি চাষ করত। আশপাশের অনেকেই খেলাধূলা করতে আসত। অনেক পাখি ছিল এখানে। গুঁইসাপ, বেজি, কাঠবিড়ালি, সাপ, ব্যাঙ এই সেদিনও দেখা গেছে। শৈশবে তারা শুনেছেন হাতিরঝিলে হাতিদের গোসল করাতে আনা হতো। হাতিরঝিল থেকে পান্থকুঞ্জ বিলে যে খালটি ছিল তা ক্রমশ বন্ধ করা হয়। আগ্রাসী শহর পুরো এলাকার ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে। দেশ স্বাধীনের বেশ পরে এখানে একটি পার্ক গড়ে তোলা হয়। পার্কে শিশুদের জন্য কিছু খেলার স্থাপনা এবং ফুলবাগান তৈরি করা হয়। এরশাদ সরকারের পতনের পর, ১৯৯০ সালের দিকে পার্কের অনেক কিছু লোকজন নিয়ে যায়। ধীরে ধীরে পার্কটি আবার পরিত্যক্ত হয়ে ওঠে।
প্রভাতী সংঘের সদস্যরা নিজেদের উদ্যোগে পার্কটি আবার সবুজ করে তোলার চেষ্টা চালান। ধীরে ধীরে পার্কটি পান্থকুঞ্জ পার্ক হিসেবে জনপরিসরে পরিচিত হয়ে ওঠে। তারা বকুল, জারুল, গগণশিরিষ, কাঁঠাল, নারকেল, নিম, খেজুর, বড়ই, হরিতকী, অর্জুন, বহেরা, কাঠমল্লিকাসহ নানা ফুলের গাছ রোপণ করেন। তারা পার্কে বেশকিছু হাঁটার রাস্তা এবং গাছের বেদী তৈরি করেন নিজেদের পয়সায়। আশপাশের এলাকাবাসী পার্কটিতে নিয়মিত হাঁটতে আসতেন। শরীরচর্চা ও খেলাধূলার জন্য শিশু, নারী, প্রবীণরা ব্যবহার করতেন। ক্লান্ত পথিক, রিকশাচালক, শ্রমজীবী, দিনমজুর, অসুস্থ মানুষ এখানে বিশ্রাম নিতেন। বহু পথবাসীর আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে এই উদ্যান। পান্থকুঞ্জ এই নির্দয় শহরের প্রাণবিনাশী উন্নয়ন আর বিশৃঙ্খল নগরায়নের স্বাক্ষী। এই উদ্যানের পরতে পরতে নাগরিক যন্ত্রণার দাগ ও ছাপ লেগে আছে।
ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে কাকে উড়াবে?
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের জন্য কোনো ধরণের নাগরিক মতামত ছাড়াই পান্থকুঞ্জের ৪০ প্রজাতির প্রায় দুই হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মূলত একধরণের উড়াল সড়ক। আকাশ ঢেকে দেওয়া এই স্থাপনা মূলত ধনীদের গাড়ি চলাচলের জন্য। যানজট নিরসন এবং টেকসই যোগাযোগব্যবস্থা পরিকল্পনার জন্য ২০০৫ সালে ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা বা এসটিপি তৈরি হয়। ঢাকার জন্য গণপরিবহনকে তখন প্রাধান্য দেয়া হয়, এক্সপ্রেসওয়ে ছিল পেছনের দিকে। কিন্তু ২০১১ সালে ৩,২১৬ কোটি টাকার এই উড়াল সড়ক প্রকল্প গৃহীত হয়। প্রকল্পের প্রাথমিক মেয়াদ ছিল ২০১১ থেকে ২০১৪। কিন্তু অনিয়ম, দুর্নীতি আর জবাবদিহিতা না থাকায় প্রকল্পটির ব্যয় বাড়তে থাকে এবং ঢাকাবাসীর জন্য দুর্ভোগ তৈরি করে। এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন এবং ইউটিলিজ ব্যয় নির্বাহে ‘সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট’ নামে আরেকটি প্রকল্প গৃহীত হয় সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে। দুই প্রকল্প মিলিয়ে সরকারের খরচ ৭,৩৩০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং বিদেশী কোম্পানির বিনিয়োগ ৬,৫২৭ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষে ২৫ বছর ধরে বিদেশি কোম্পানি টোল আদায় করলেও বাংলাদেশ সরকার পাবে মাত্র ২৭২ কোটি টাকা। আবার ১৫দিন ধরে যদি দৈনিক গড়ে ১৩,৫০০ টির কম যানবাহন চলাচল করে তবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিদেশি কোম্পানিকে চুক্তি মোতাবেক ২৫ বছরের চেয়েও বেশি সময় ধরে অতিরিক্ত টোল আদায় করতে দিতে হবে।
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা, কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত এই এক্সপ্রেসওয়ের মূল করিডোরের দৈর্ঘ্য ১৯.৭৩ কিলোমিটার। দ্রুতগতির গাড়ি যাতে ঢাকার একপ্রান্ত থকে সরাসরি আরেকপ্রান্তে যেতে পারে এ কারণে এর পরিকল্পনা করা হলেও এই উড়াল সড়কে ৩১টি র্যাম্প (ওঠানামার সংযোগ সড়কপথ) রাখা হয়েছে। র্যাম্পগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার, যা এক্সপ্রেসওয়ের চেয়ে সাত কিলোমিটার বেশি। এখনি ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের আশেপাশের সড়কে তীব্র যানজট আর ৩১টি র্যাম্প চালু হলে যানজটের মাত্রা কেমন হতে পারে ভাবা যায়? এক্সপ্রেসওয়ের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে ১২৮ একর জমি দিলেও তারা টোলের কোনো অংশ পাবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। যানজট নিরসনের জন্য এই প্রকল্প গৃহীত হলেও এটি ক্রমাগতই জনস্বার্থবিরোধী হয়ে ওঠছে এবং এই উড়াল সড়ক নাগরিক দুর্ভোগ উড়াতে অক্ষম হবে। ২০২১ সালে প্রকল্পে আবার ডিজাইন বদলানো হয় এবং এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত একটা সংযোগ সড়ক যুক্ত করা হয়। নতুন এই সংযোগ সড়কটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পান্থকুঞ্জের গাছ কেটে হাতিরঝিল ভরাট করে ইকোসাইড করা হয়। আর প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী এই সংযোগ সড়কটি শুধুমাত্র বাতিলের দাবিতে পান্থকুঞ্জ আন্দোলন শুরু হয়।
পাখিদের ছাড়পত্র নাই, জনতার রায় নাই
কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে নানা সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। পরিবেশত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক। এক্সপ্রেসওয়ের পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনে (ইআইএ) বলা হয়েছে, এর কারণে পলাশী, কাঁটাবন এলাকায় ট্রাফিকের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে এবং নিচের রাস্তার উপযোগিতা কমে যাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পান্থকুঞ্জ উদ্যান ধ্বংস করা হয়েছে। উদ্যানের প্রবীণ চাম্বল ও গগণশিরিষ গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ কেটে ফেলার কারণে পাখিদের বাসা ও ডিম ভেঙে গেছে। বহু ছানা পাখি মারা গেছে। পান্থপথে পাখিদের শেষ আশ্রয়স্থলটুকু ধ্বংস হয়েছে। কেবল বৃক্ষপ্রজাতি নয়; পান্থকুঞ্জ উদ্যানে বনবড়ই, কালো ধুতরা, ছোট হুড়হুড়ে, থানকুনি, মালঞ্চ, তেলাকুচা, বনকচু, শ্বেতদ্রোণ, কলমি, ভৃঙ্গরাজ, কপালফুটকি, কাঁটাবেগুন, মুথা ঘাস, শেওড়া, আসামলতা, ক্ষেতগিমার মতো বহু ভেষজ গুল্মর সন্ধান পেয়েছি। সন্তান ও ঘরহারা পাখিদের ওড়াওড়ি এবং করুণ চিৎকার যে কাউকে বিমর্ষ করবে। চিলদের হয়েছে সবচেয়ে বেশি সমস্যা, কারণ উঁচু কোনো ক্যানোপি নেই। সর্বশেষ গগণশিরিষ গাছটিও কেটে ফেলা হয়েছে।উড়তে উড়তে ক্লান্ত চিলেরা আশেপাশের দালানের কাচের জানালায় ঠোক্কর খায়। দালানে যে পাখিরা বসবে এমন একটু স্থাপত্যশৈলীও কেউ রাখেনি এই নির্দয় শহরে। হায়রে স্থাপত্যবিদ্যা, হায়রে প্রকৌশল! এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়া হয় এবং এর মেয়াদকাল ওই বছরেরই ৮ ডিসেম্বর শেষ হয়ে যায়। বিগত রেজিমের সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদ পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই জনগণের কোনো পরামর্শ ও অনুমতি না নিয়ে পান্থকুঞ্জ পার্কের গাছ কেটে ফেলে। আদালত পান্থকুঞ্জকে উন্মুক্ত রাখার নির্দেশ প্রদান করে (রিট পিটিশন নং ১০৯৮৫/২০১৪)। নির্মাণকাজের জন্য পান্থকুঞ্জে যন্ত্রের মাধ্যমে যেসব গর্ত করা হয়েছে তাতে এই এলাকার মাটির বহু নিচের স্তর পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যায় এটি নিম্ন জলাঞ্চল। হয়তো মধুপুর গড়াঞ্চল প্রতিবেশের চালা ও বাইদ শ্রেণিবিন্যাসে এটি বাইদ এলাকা। আজ একের পর এক রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন যন্ত্রণার কারণে এই অঞ্চলটি তার ভূমিবিন্যাসের সকল চরিত্র ও শ্রেণি হারিয়েছে। এখন আবার বৃক্ষ ও প্রাণীদের সংসার হারালো উদ্যান।
তারা কোথায় গেল রাষ্ট্র জানে কি?
প্রতিটি মেগাউন্নয়ন প্রাণনাশ করে। প্রকৃতি বদলায়। সংস্কৃতিকে বিকল করে। এক্সপ্রেসওয়ে কেবল গাছ, পাখি, পতঙ্গ, পরিবেশ হত্যা করেনি; এই প্রকল্পের কারণে প্রায় ৯ জন মানুষের জীবনহানির কথাও জানা যায়। ২০২২ সালের ১৫ অগাস্ট এক্সপ্রেসওয়ের গার্ডারের চাপায় ৪ জন বরযাত্রী নিহত হন। ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি ভাটারা এলাকায় এক্সপ্রেসওয়েতে কাজ করতে গিয়ে লালমনিরহাটের রাহিদুল ইসলাম মারা যান। ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁওয়ে স্লিপারের আঘাতে চাঁদপুরের হাসান মিঝি মারা যান। ২০২৩ সালের ২৯ মে মহাখালীতে এক্সপ্রেসওয়ের লোহার রড পড়ে এক কিশোরের মৃত্যু হয়, পুলিশ তখন জানিয়েছিল সে ‘অজ্ঞাত’। ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এক্সপ্রেসওয়ের লোহার মই পড়ে মগবাজার এলাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতিউর রহমান নিহত হন এবং একইদিনে ক্রেন পড়ে তেজগাঁও এলাকায় নরসিংদীর শামীম মিয়া মারা যান। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাষ্ট্র যখন নাগরিকের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করে তারপর রাষ্ট্র কী আর কখনো তাদের খোঁজ নেয়?
সিনোহাইড্রো ও পরিবেশ-বিতর্ক
ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটির সাথে জড়িত চায়না কোম্পানি সিনোহাইড্রো। ১৯৫০ সালে গঠিত রাষ্ট্রায়ত্ত এই কোম্পানিটি বিভিন্ন দেশে স্থাপনা নির্মাণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তুমুল পরিবেশ-বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছে এবং পরিবেশ ধ্বংসের কারণে কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পদ্মাসেতু থেকে অর্থায়ন বন্ধ বিতর্কের পর এই কোম্পানিকে মূলত স্থাপনা নির্মাণে রাষ্ট্রীয়ভাবে যুক্ত করা হয়। মালয়েশিয়াতে সিমে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাথে এক বৃহৎ বাঁধ প্রকল্প নির্মাণ করতে গিয়ে সিনোহাইড্রোর বিরুদ্ধে নির্মাণকাজে দুর্নীতির অভিযোগে পড়ে। তারা সিমেন্টের সাথে বেশি পানি মিশিয়ে স্থাপনাকে দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছিল। সারাওয়াক রিপোর্ট নামের একটি মালয়েশিয়ান ব্লগে এটি প্রকাশিত হওয়ার পর নিউজটি হ্যাক হয়ে যায়। ইসরায়েল, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, জর্জিয়া, শ্রীলঙ্কা, আলজেরিয়া, হন্ডুরাস মূলত এসব দেশে পরিবেশ প্রশ্নে বিতর্কিত হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্প নির্মাণের সাথেই এই কোম্পানি বেশি জড়িত। বলিভিয়াতে এই কোম্পানি অনেকগুলো হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্পের সাথে জড়িত। ইভিরিজু পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীরা তর্ক তুলেছে। বলিভিয়ার কোচাবাম্বা-সান্তা ক্রুজ মহাসড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে সিনোহাইড্রোর গাড়ি চাপায় একটি জাগুয়ার মারা যায়। তাঞ্জানিয়ার সেলোস গেম রিজার্ভে জুলিয়াস নাইয়েরিয়ারে বাঁধ নির্মাণের সাথে সিনোহাইড্রো জড়িত। এই বনটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্য এবং আফ্রিকার বন্যপ্রাণীর এক বৃহৎ বিচরণ অঞ্চল। গায়ানাতে কৌকৌতাম্বা বাঁধ নির্মাণের কারণে অতিবিপন্ন শিম্পাঞ্জীদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে এই কোম্পানি। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় বাটাং টরু বাঁধ নির্মাণে সিনোহাইড্রো জড়িত এবং এই বাঁধের কারণে নব্য আবিষ্কৃত একটি ওরাংওটাং প্রজাতি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী সিনোহাইড্রোকে নিয়ে প্রমাণসমেত বহু পরিবেশ-তর্ক জারি থাকলে প্রশ্নহীনভাবে এই কোম্পানি বাংলাদেশে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস করেও বহাল তবিয়তে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। কী নির্দয়ভাবে পান্থকুঞ্জ এবং হাতিরঝিল তারা ক্ষয় করেছে এর জবাব রাষ্ট্র কবে চাইবে?
শিরিন বানুর কাঠমালতির দোহাই
আলেম মো. সাইফুল ইসলাম একসময় নিজ উদ্যোগে পান্থকুঞ্জে পথশিশুদের পড়াতেন। দিনমজুর রেণু বেগমের এক সন্তান জন্মের পর মারা যায় এবং আরেকজন পানিতে পড়ে মারা যায়। দুই শিশুকেই মাটি দেয়া হয়েছে পান্থকুঞ্জের কেটে ফেলা গগণ শিরিষের তলায়। প্রভাতী সংঘের শিরিন বানুরা মিলে বহু গাছের চারা লাগিয়েছিলেন পান্থকুঞ্জে। শিরিনের কাঠমালতীর গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়।ফুলন্ত গাছ জড়িয়ে ছবিও তুলেছিলেন শিরিন। আজ শিরিন বেঁচে নেই। রাষ্ট্র তার স্মৃতিকথাটুকু কাটার আগে কাউকে জিজ্ঞেসও করেনি। পান্থকুঞ্জ ঘিরে এমন কত স্মৃতি, বলা-না বলা গল্প, কত কী কত জনের ছড়িয়ে আছে দিগবিদিক। আজ সব ছিন্নভিন্ন, ওলোটপালট। সংবিধানে রাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছে পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিলের গাছ, পরিবেশ, প্রাণসত্তা রক্ষা করবে। রাষ্ট্র তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করছে। ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের ২০২৪ সালের জানুয়ারির টোল ও ট্রাফিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায় এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করা গাড়ির প্রায় ৯৮.৩ ভাগ হলো ব্যক্তিগত গাড়ি। প্রশ্ন হলো কেমন বাংলাদেশ আমরা চাই? শিরিন বানুদের কাঠমালতীতে ভরপুর সবার জন্য এক স্বপ্নময় দেশ, নাকি কেবল কিছু ধনীদের বিলাসিতার জন্য অস্বস্তিকতর রুগ্ন এক কাঠামো? জুলাই গণঅভ্যুত্থান এক ইনক্লুসিভ বাংলাদেশর বার্তা দিয়েছে। আশা করি রাষ্ট্র এই বার্তাকে আমলে নেবে, জনআকাঙ্ক্ষাকে পাঠ করবে, পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল সুরক্ষায় দায় ও দরদের নতুন পরিবেশ-বন্দোবস্তি গড়ে তুলবে সকলকে সঙ্গী করে।