Published : 10 Jul 2022, 12:24 AM
পবিত্র ঈদুল আজহার দিনটি মূলত ঈদের নামাজ ও কোরবানির মাধ্যমেই পালিত হয়। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা দুটোই মুসলিমদের বড় ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন না। তবে ইদুল ফিতর বা রোজার ঈদে অন্য সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় যতটা আনন্দে সামিল হন, ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদে ঠিক ততটা একাত্ম বোধ করেন বলে আমার অন্তত মনে হয় না।
এর একটি বড় কারণ গরু কোরবানি। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে গরু কোরবানি নিয়ে এক ধরনের ধর্মীয় সংস্কার আছে। বেশিরভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক গরুর মাংস খাওয়াকে 'ধর্মবিরোধী' বলে মনে করেন। গরু কোরবানির সংখ্যা যত বাড়ছে, ঈদুল আজহার আনন্দ নিয়ে হিন্দুদের উচ্ছ্বাস ততো কমছে।
আমাদের ছোট বেলা কেটেছে পাকিস্তানে। পাকিস্তান ছিল ঘোষণা দিয়ে মুসলিম রাষ্ট্র। তারপরও আমরা দেখেছি, তখন গরু কোরবানি এখনকার মতো ব্যাপক ছিল না। কারণ হতে পারে দুটি। এক. সেই সময় গরু কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য ছিল কম সংখ্যক মানুষের। দুই. কোরবানি দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত গরুও তখন কম ছিল।
তখন মানুষের মধ্যে অন্য ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষের মনোভাব কম ছিল বলেই আমার বিশ্বাস। যার যার ধর্ম সে সে পালন করেছে, তাতে অন্য কেউ বাধা দিয়েছে বলে শুনিনি। এখন সবাই নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে অন্য ধর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ফলে কারো কারো মধ্যে ধর্ম নিয়ে উদারতা কমে সংকীর্ণতা বেড়েছে। তাই এখন আর ধর্মীয় উৎসব সবার নেই। তাতে সাদা চোখে দেখলে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু একটু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে এরই পরিণতিতে উগ্রতা বাড়ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে।
একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের হৃদয় ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের নির্যাতনের খবরে ব্যথিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নির্যাতন হলে, গরু জবাই বন্ধ করার বিধান দেওয়া হলে বাংলাদেশের মুসলিমদের ক্ষুব্ধ হওয়া যৌক্তিক এবং ন্যায্য প্রতিক্রিয়া। ধর্মবিশ্বাসের কারণে কোনো মানুষ বৈষম্যের স্বীকার হলে, নির্যাতিত হলে তার প্রতিবাদ হওয়াই উচিত- সেটা ভারতে হোক, মিয়ানমারে হোক, চীনে হোক, মধ্যপ্রাচ্যে হোক। কিন্তু আমাদের প্রতিক্রিয়া কেন দেশ ভেদে ভিন্ন হয়? চীনের উইঘুরে মুসলিম নিপীড়ণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া শীতল হলেও ভারতের কোথাও তেমন কিছু হলে ক্ষোভের তীব্রতা বেশি লক্ষ্য করা যায়।
আমরা যদি সংখ্যালঘুর বেদনা সত্যই বুঝে থাকি, তাহলে আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি কি আমাদের সেই রকম আচরণ করা উচিত না, যে আচরণ আমরা ভারতের মুসলিমদের জন্য প্রত্যাশা করি?
আরেকটু বড় করে যদি বলা হয় যে, আমরা যদি মজলুমের বেদনা বুঝে থাকি, তাহলে সব মজলুম, দুর্বল, ক্ষমতাহীনের (রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক) প্রতি আমাদের আচরণ হওয়া উচিত সহমর্মিতার। এটা বলা হয়ে থাকে যে, একটা দেশের মানুষ কতটা সভ্য সেটা বোঝার সহজ উপায়- সেই দেশে ক্ষমতাহীনদের প্রতি কেমন আচরণ করা হয় তার মাধ্যমে। আমরা কি সত্যি সত্যি তেমনটা করি ?
পশু কোরবানি দিয়ে মহান সৃষ্টি কর্তার অনুগ্রহ লাভের আশা করা হবে। ঈদুল আজহার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিজের অহমিকা ও উচ্চাভিলাষ উৎসর্গ করা। পশু কোরবানির মাধ্যমে মানুষের ভেতরে থাকা পশুশক্তি, কাম-ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতাসহ সব মন্দ রিপুকে ত্যাগ করার শপথ নেওয়ার কথা।
প্রশ্ন হলো, মানুষের মনের মধ্যে যে পশুপ্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তার কোরবানি দিতে যদি সমান উৎসাহ দেখানো না যায় তাহলে তো আমরা নিষ্ঠুরতার বদলে মানবিক হয়ে উঠতে পারবো না। আমাদের পরিবারে-সমাজে পুরনো যে বন্ধন ছিল, যে আন্তরিকতা, মায়ামমতার গিঁট ছিল তা নানা কারণে শিথিল হয়ে পড়েছে। ঈদের দিন আমরা পরস্পর কোলাকুলি করি এখনও ঠিকই, কিন্তু তা যেন কিছুটা কৃত্রিমতায় ভরা। করোনার জন্য মাস্ক পরে যেমন মুখ ঢাকছি, তেমনি মনের ঔদার্যকে বিশেষ কিছু দিয়ে আড়াল করেই যেন আজকাল আমরা উৎসবে মেতে ওঠার চেষ্টা করি।
লেখার এই পর্যায়ে এসে আমাদের বালকবেলায় বা তারও আগে আমাদের পরিবারগুলো কেমন ছিল, কেমন ছিল সামাজিক বন্ধন, কেমন কাটতো আমাদের ঠাকুরমা, দিদিমা, মা-কাকিমা, মাসি-পিসি বা অন্য নারীদের জীবন- সেকথা মনে পড়ে গেল।
নারীদের অধিকার-মর্যাদার বিষয়টি স্কুলে পড়ার সময় শুনেছি বলে খুব মনে পড়ে না। নারী শিক্ষা ছিল একেবারেই সীমিত। নারীদের শিক্ষা নিয়ে পরিবারে খুব আগ্রহ-উৎসাহ দেখিনি। তবে ব্যতিক্রম তো অবশ্যই ছিল। আমাদের প্রজন্মের বহু আগে বেগম রোকেয়া, সুফিযা কামাল, ইলা মিত্র, লীলা নাগসহ অনেক নারী আলো হাতে বের হয়েছেন ঘরের ঘেরাটোপ থেকে। জাহানারা ইমাম, লায়লা সামাদের মতো উজ্জ্বল নারী ব্যক্তিত্ব যখন আত্মপ্রকাশ করছেন, তখনও অধিকাংশ পরিবারে মেয়েদের আসলে স্বামীর ঘর করার উপযুক্ত হিসেবেই গড়ে তোলাকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। মেয়েরা একটু লেখাপড়া শিখবে আর বেশি শিখবে ঘরকন্যার কাজ। রান্নাবান্না, সেলাইফোড়াই, ঘর গোছানো, শ্বশুরবাড়ির মানুষের মন জোগানোর মতো শিক্ষায় মেয়েরা পটু হয়ে উঠুক – এটাই ছিল অধিকাংশ পরিবারের চাওয়া। নারীর কাজ, পুরুষের কাজ বলে কর্মবিভক্তি যে চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা, সেটা মনে করা হতো না।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবার এবং মুসলিম পরিবারে ঘরের ভেতরের অবস্থা প্রায় এক রকমই ছিল। হিন্দু পরিবারে গানবাজনার রেওয়াজ থাকলেও মুসলিম পরিবারে এসব নিয়ে কিছু রক্ষণশীলতা ছিল। তবে আমরা তখন কোনো মুসলিম পরিবারেই হিজাব, বোরকা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। নামাজ-রোজা-কোরান পাঠ ছিল, তবে তা নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখিনি। পাড়ায় পাড়ায় মাদ্রাসা দেখিনি। মসজিদও ছিল সীমিত সংখ্যায়। হিন্দুদের মন্দিরও খুব জাঁকজমক পূর্ণ ছিল না। আমাদের বাজারে যে মন্দির এখন বেশ সাজানো, আমাদের সময়ে সেটা যেন কিছুটা পোড়োবাড়ির মতোই দেখেছি।
আমরা ধর্ম নিয়ে যে উদারতা ও সহনশীলতা দেখে বড় হয়েছি, এখন আর তা দেখি না। তখন মানুষের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার কম ছিল, কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক 'সহবত' ছিল বেশি। তখন নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি ছিল আলাদা। এক পরিবারের অভিভাবক, অন্য পরিবারের ভালোমন্দ নিয়ে উদাসীন থাকতেন না। আমার প্রতি আমার বাবা যেমন নজর রাখতেন, আমার বন্ধুর প্রতিও রাখতেন। কারো বাবা নিজ সন্তানের সঙ্গে অন্যের সন্তানকেও শাসন করার অধিকার রাখতেন।
পরিবারে বা ব্যক্তি পর্যায়ে হিংসা-বিদ্বেষ ছিলনা, তা নয়। তবে সেটা কখনও সামাজিক স্থিতি বিনষ্টের কারণ হয়নি। সম্ভবত সে জন্যই ওই গানটি এখন জনপ্রিয় 'আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম'।
মানুষের চিত্ত বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা তেমন ছিল না। একটু সম্পন্ন পরিবারে ছিল 'কলের গান'। কলের গানে রেকর্ড চাপিয়ে পুরনো দিনের মন মাতানো গান শোনার অভিজ্ঞতা যাদের নেই, তারা বুঝবেন তা তার মাদকতা। তারপর রেডিও। রেডিওতে অনুরোধের আসর বেশি জনপ্রিয় ছিল বলে আমার ধারণা। আকাশবাণী, রেডিও শিলং বহু মানুষ শুনতেন। রেডিও-র নাটকও কম জনপ্রিয় ছিল না। একসময় ঢাকা বেতারের একটি অনুষ্ঠানের একটি চরিত্র 'মজিদের মা' অনেকের কাছেই পরিচিতি পেয়েছিল। সিনেমা হল জেলা ও মহকুমা শহরে ছাড়া ছিল না। তাই সিনেমা দেখে বিনোদিত হওয়া মানুষের সংখ্যাও ছিল সীমিত। যাত্রাপালা দেখা অবশ্যই বিনোদনের একটি বড় মাধ্যম ছিল।
পুরুষ মানুষেরা যেহেতু হাট-বাজারে যেতে পারতেন, সেহেতু বহু মানুষের সঙ্গে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো। মানুষে মানুষে সংযোগ রিফ্রেশমেন্টের একটি বড় উপাদান। কিন্ত নারীদের সেই সুযোগ ছিল না। তাহলে নারীরা কীভাবে মুক্তির নিঃশ্বাস নিতেন? 'পাড়া বেড়ানো' ছিল তাদের জন্য খোলা হাওয়া পাওয়ার একটি উপায়। ঘর-সংসারের কাজ-কর্ম শেষ করে ছোটবড় সব মেয়েরা জোট বেধে বেড়াতে বের হতেন। ঘণ্টাখানেক হয়তো গল্পগুজব হতো, কিন্ত এটাই তাদের জন্য টনিকের কাজ করতো। একটু যারা লেখাপড়া জানতেন তারা অবসর সময়ে শরৎ চন্দ্র বা আর কারো লেখা উপন্যাস পড়তেন। প্রেম-বিরহের উপন্যাস পড়ে কেউবা হাপুস নয়নে কাঁদতেন। 'গৃহদাহ'- এর অচলার দোলাচল চিত্তবৃত্তি কাউকে বা আকুল করতো। দেবদাস-পার্বতীর জন্য কার না পরান আকুলিবিকুলি করতো!
বিকেলে পাটি পেতে দাওয়ায় লম্বা হয়ে বসে চুল বাঁধা বা উকুন বাছার দৃশ্য নিজের বাড়িতেই তো প্রায় প্রতিদিন দেখেছি। ওই সব ঘরোয়া সম্মিলনে পাড়া বেড়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে পরনিন্দা-পরচর্চাও কম হতো না। কিছু কিছু বাড়িতে একজন করে 'কুটনি বুড়ি'ও দেখেছি। তিনি এ বাড়ির হাঁড়ির খবর ও বাড়িতে পাচার করে একটু চা-মুড়ি-পান পেয়ে খুশি মনে বিদায় হতেন। কার কেমন 'স্বভাব' তা প্রায় সবাই জানতেন। কাজেই কেউ এমন কিছু করতেন না, যাতে কলহ বাঁধতে পারে।
সময় বদলেছে। যন্ত্র সভ্যতা মানুষের মধ্যেও পরিবর্তন এনেছে। যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে অনেকের জীবন। জটিলতা বেড়েছে। আবার ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের আড়ম্বর বেড়েছে। মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পশু কোরবানির সংখ্যা বেড়েছে। পরিবর্তনের সঙ্গে না চলে উপায় নেই। কিন্তু পরিবর্তনটা যেন কিছুতেই মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি না করে। মানুষ হোক মানুষের জন্য। এবার ঈদে আমাদের সবার প্রার্থনা হোক –আর্ত ও দুস্থ মানুষের প্রতি যেন আমরা অবহেলার মনোভাব পরিহার করি। বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবী দ্রুত করোনামুক্ত হোক। যুদ্ধ ও হিংসা-হানাহানির অবসান ঘটুক। সব মানুষের জীবন নিরাপদ হোক। ঈদ সবার জন্য শান্তি বয়ে আনুক। ঈদ মোবারক।