Published : 20 Jun 2022, 08:52 PM
বাজেটের অনেকগুলো জনগুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। তার সবগুলোই নিয়মিত ও অনিবার্য বিষয়। তবে এবারের বাজেট একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ সবার মনোযোগ কেড়েছে। সেটা হচ্ছে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ বৈধকরণ ও ফিরিয়ে আনা সংক্রান্ত অর্থমন্ত্রীর একটি ঘোষণা।
অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় কী বলা হয়েছে?
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, "বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি থাকলে দেশের আয়কর রিটার্নে দেখাতে চাইলে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। এ ছাড়া অস্থাবর সম্পত্তির ওপর ১০ শতাংশ এবং পাচার হওয়া টাকা দেশে আনলে সেই টাকার ওপর ৭ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারবেন যে কেউ। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেবে না সরকার। তাঁকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।"
এই ঘোষণার পর অর্থমন্ত্রী তীব্র সমালোচনার মুখ পড়েছেন। সমালোচনা শুধু বাইরেই নয়, সংসদের ভেতরেও তিনি তোপের মুখে পড়েছেন। বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা ও দায়মুক্তির সুযোগ রাখায় সংসদ সদস্যরা বলছেন, যারা অর্থপাচার করেছে তারা অসৎ। আর অসৎ লোকের কাছে সততা আশা করা নির্বুদ্ধিতা। ব্যাংকের টাকা লোপাট করে, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ যারা বিদেশে পাচার করেছে, তারা অপরাধী, শাস্তিই তাদের প্রাপ্য। সামান্য অর্থের বিনিময়ে তাদের দায়মুক্তি হবে জনগণের সাথে প্রতারণা। এটা মেনে নেয়া যায় না। সুতরাং এই সিদ্ধান্ত পরিহার করতে হবে।
নাগরিক পর্যায়ে বাজেটের নানা অসঙ্গতি নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তখন সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের বিপুল পরিমাণ অর্থের সংবাদ প্রকাশিত হলো। ২০২০ থেকে ২০২১, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। যা গত বছরের তুলনায় ৫৫ গুণ। প্রশ্ন উঠেছে এসব অর্থ বৈধ না অবৈধ? তবে বৈধ অর্থ গোপন করা ও সুইস ব্যাংকের রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কিন্তু কীভাবে ওই অর্থ সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো? বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এই পরিমাণ অর্থ বিদেশে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সঙ্গতই বলা যায় এগুলো সব বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অবৈধ দুর্নীতির অর্থ। তাহলে সুইস ব্যাংকে থাকা এই বিপুল অর্থের পরিণতি কী? সেগুলো কি অর্থমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত এই সুযোগের আওতায় দেশে ফিরে আসবে? যদি না আসে তাহলে এই ঘোষণার অর্থ কী?
সুইস ব্যাংক কি কোনো নির্দিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান?
সুইস ব্যাংক বলতে নির্দিষ্ট কোনো একটি ব্যাংককে বোঝানো হয় না। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং নীতিমালার আওতায় পরিচালিত প্রায় ২৫০টি ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিতভাবে সুইস ব্যাংক বলা হয়। তাহলে বিশ্বের এত নামীদামী বড় বড় ব্যাংক থাকতে কেন ঘুরেফিরে এই ব্যাংকের নাম সামনে ও আলোচনায় আসে? আলোচনায় আসার কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অসাধু দুর্নীতিবাজ বিত্তশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-শাসকরা তাদের অবৈধ অর্থ-সম্পদ এই সুইস ব্যাংক জমা রাখেন। কারণ এই সুইস ব্যাংকগুলো সর্বনিম্ন ঝুকিপূর্ণ ও সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করে।
সুইস ব্যংক কি সাধারণ ব্যাংকের মতোই কোনো ব্যাংক না অন্য কিছু?
সুইস ব্যাংকগুলো অন্যান্য যে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতোই প্রতিষ্ঠান। তাদের বিশেষত্ব হচ্ছে, তারা গ্রাহকের কোনো তথ্য বাইরে প্রকাশ করে না। তারা সেটা দিতে বাধ্যও নয়। সুইজারল্যান্ডের সব ব্যাংকই এই নীতি অনুসরণ করে থাকে। ওই দেশের আইন-সংবিধান তাদের এই নীতিকে কঠোরভাবে সমর্থন করে। যে কারণে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ না করার আইনি সুরক্ষা পায়। সুইস ব্যাংকগুলো গ্রাহকের পরিচয় ও অর্থের উৎস কোনো ভাবেই প্রকাশ করে না।
তাহলে সুইস ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশের তথ্য এলো কী করে?
এর কারণ, এক দশক ধরে সুইস ব্যাংক তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে জমাকৃত অর্থের হিসেবে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কোনো গ্রাহক বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রকাশ করা হয় না। দেশভিত্তিক তথ্য প্রকাশের সুবাদেই বাংলাদেশের বিষয়টি জানা যায়।
সুইস ব্যাংক কেন এই গোপনীয়তার নীতি শিথিল করলো?
১/১১- এর ঘটনা অনেক কিছুকেই এলোমেলো করে দেয়। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মুদ্রাপাচার উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে থাকে। বিভিন্ন দেশের বিত্তশালী, দুর্নীতিবাজ ও তৃতীয় বিশ্বের স্বৈরশাসকদের অর্থে সুইস ব্যাংকগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ নিয়ে তীব্র আলোচনা শুরু হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে সুইস সরকারের ওপর চাপ আসতে থাকে। পরবর্তীতে সুইস ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে সংশোধনী এনে সীমিত আকারে তথ্য প্রকাশের নীতিগ্রহণ করে। শুধু তাই নয় কোনো গ্রাহক-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ থাকলে ব্যাংকগুলো তাদের তথ্য প্রকাশে বাধ্য থাকে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের কী পরিমাণ অর্থ জমা আছে?
যতটুকু জানা যায়, ২০০৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৩৬৫ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের হিসেবে অনুযায়ী সেখানে আছে ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ বেড়েছে এক হাজার ৩৭০ গুণ! সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজার ২ শত ৭৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে, এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩ শত ৪৭ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে কয়েক বছরের যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যায় এই বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ। এক বছরেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ২ হাজার ৯ শত ২৮ কোটি টাকা।
বাজেটে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সে আলোচনার মধ্যেই সুইস ব্যাংকের এই তথ্য প্রকাশিত হলো। যে কারণে অর্থপাচারের আলোচনায় ভিন্নমাত্রা যুক্ত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত আসলে কতটা কার্যকর হবে?
সুইস ব্যাংকের এ অর্থ কাদের?
গত বছর নভেম্বরে সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, দেশ থেকে কারা অর্থ পাচার করেন তিনি তা জানেন না। কারা টাকা পাচার করছে এমন তথ্য তার জানা নেই। তাহলে সুইস ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে যে বাংলাদেশিদের বিপুল অর্থের খতিয়ান দেয়া হলো, সে অর্থ কাদের? এ অর্থের উৎস কী? কারা এ অর্থ পাচার করছেন? জিএফআই- এর গবেষণাও বলছে, দেশ থেকে প্রতি বছর ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। এ সব তথ্য কি অর্থমন্ত্রীর অজানা? একদিকে অর্থপাচারের বিষয় না জানার কথা বলছেন অন্যদিকে পাচারকৃত অর্থের বৈধতা ও দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন, এ কেমন স্ববিরোধিতা?
অর্থমন্ত্রীর আকর্ষণীয় অফারে কি পাচারকৃত অর্থ ফেরত আসবে?
১০ শতাংশ কর দেয়ার মাধ্যমে সরকার কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল। ১৮ বার এ সুযোগ দেয়ার পরও করোনার সময় ছাড়া এ বিষয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়নি। পাচারকৃত অর্থের ক্ষেত্রেও ফল পাওয়া যাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর এর সুফল না পাওয়া গেলে দেশের আর্থিক খাতের জন্য এটি একটি খারাপ উদাহরণ হবে। পাচারকারীদের এই সুযোগ ও দায়মুক্তি দেশের সৎ উদ্যোক্তা ও করদাতাদের জন্য একটি বড় আঘাত।
৭ শতাংশ কর দিয়ে দুর্নীতির অবৈধ অর্থই শুধু বৈধ হবে না, এ অর্থ পাচার করে যারা বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি করেছেন, সেই বেগমপাড়াগুলো বৈধ হয়ে যাবে। পাচারের টাকায় বিদেশে করা সম্পত্তি দেশে না নিয়েও তারা সরকারের বৈধতার সনদ পাবে। এই আকর্ষণীয় অফারে বলা হয়েছে, স্থাবর সম্পত্তির জন্য ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তির জন্য ১০ শতাংশ কর দিলেই সব জায়েজ হয়ে যাবে। সরকারের এই ব্যবস্থায় পাচারকারীরা শুধু দেশে নয় বিদেশেও দায়মুক্তি দেবে। কারণ তারা সরকারের কাছ থেকে এজন্য সনদ পেয়েই যাবে। কর না দিয়েও হয়তো কিছু টাকা দিয়ে পাচারকারীরা ভুয়া সনদ, কাগজপত্র বানিয়ে নেবেন। আমাদের দেশে এ আর কঠিন কি!
প্রতি বছর ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। ওই অংকের তুলনায় সুইস ব্যাংকের ৩ হাজার কোটি টাকা খুব বেশি নয়। তারপরও এই তথ্য দেশ থেকে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অংকের স্বীকৃত প্রমাণ। ৬৪ আর ৩ এই ৬৭ হাজারের অর্ধেক অর্থও যদি ৭ শতাংশ কর দিয়ে ফেরত আনা যেত তাহলেও নাহয় এই অন্যায়-অনৈতিক সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গাওয়া যেত। কিন্তু তা কি হবে? মুদ্রাপাচার ও কালো টাকার অতীত রেকর্ড সে কথা বলে না।
বিশেষজ্ঞরা কী বলেন?
এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মত, পাচারকৃত অর্থকে বৈধতার অনৈতিক সুযোগ না দিয়ে বরং পাচার কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তার যে পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে তা বন্ধের ব্যবস্থা করা জরুরী। অর্থ দেশে থেকে বেরিয়ে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন বা অসম্ভব। পরিকল্পনামন্ত্রী নিজেও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এক্ষেত্রে যেচে কেউ নিজের দায় স্বীকার করবে না এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ নিয়ে কোনও কার্যকর আইন নেই। দেশকে নিয়ে পাচারকারীদের ভাবনা থাকলে সে অর্থ বিদেশে পাচার হতো না, দেশেই থাকতো। তার সাথে আছে নির্বাচন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন। টিউব থেকে একবার পেস্ট বেরিয়ে গেলে- তাকে যেমন ভেতরে প্রবেশ করানো যায় না, পাচারের অর্থও ব্যতিক্রমবাদে তা আর ফিরে আসে না।