Published : 15 Jun 2022, 03:58 PM
পুরো দেশ জুড়ে ফুলে-ফেঁপে উঠছে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস। সে তুলনায়, মানবিকতা, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান, গবেষণা, দর্শন ইত্যাদি চর্চা শোচনীয়ভাবে কমছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যন্ত গবেষণা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। গবেষণা এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুরুত্ব পাচ্ছে না। মানুষ এখন সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই পছন্দ করছেন, যারা উপার্জন-প্রতিযোগিতা-অনুশাসন-আনুগত্যের মন্ত্রে দীক্ষিত 'চাকরিযোগ্য' মানবসম্পদ তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপাতত সেই লক্ষ্যেই স্থির। উচ্চশিক্ষা মানে এখন চাকরির বাজারে প্রতিযোগী তৈরি করা, আর সেই সব প্রতিষ্ঠানই উৎকৃষ্ট যারা বেশি টাকা কামাবে অথবা টাকা কামানোর শিক্ষা দেবে। শিক্ষা পরিণত হয়েছে উন্নত পণ্যে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে পণ্য বিক্রির 'দোকান'। এই 'দোকানে' গবেষণা, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন গুরুত্ব পাচ্ছে না।
যেখানে গবেষণা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবার কথা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই গবেষণার খাতে এক টাকাও খরচ করছে না! দেশের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনওরকম গবেষণাকর্ম হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যুক্তি, বিষয়টি বাধ্যতামূলক নয়। ঘটনায় উদ্বিগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা ইউজিসি। কারণ ইউজিসির একটা বাধ্যবাধকতা আছে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মৌলিক গবেষণা থাকতে হবে। সে কারণে গবেষণাকে একেবারে বাদ দিতে পারছে না। হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই কেবল গবেষণা হচ্ছে। অবশ্যই সেটা উল্লেখ করার মতো না। মৌলিক গবেষণার সংস্কৃতি আস্তে আস্তে লোপ পাচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে, এ ব্যাপারে যেন একটা নীরব চক্রান্ত চলছে। আমরা ক্রমে গবেষণা-উদ্ভাবন-জ্ঞানহীন একটা সমাজের দিকেই যেন ক্রমে ধাবিত হচ্ছি।
গবেষণার ক্ষেত্রে বরাদ্দের অভাবের কথা বলা হয়। কিন্তু যতটুকু যা বরাদ্দ আছে, সেটুকু কি ঠিকঠাক মতো ব্যয় হয়? কোনো উল্লেখযোগ্য মৌলিক গবেষণা হয়? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের কেবল উচ্চশিক্ষা দেয় না, সেখানে নানা ধরনের গবেষণাও করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ ওই কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেওয়া হয় ভালো অঙ্কের টাকাও। কিন্তু, চলতি বছরে গবেষণার কাজে বাংলাদেশের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় এক টাকাও খরচ করেনি। এর মধ্যে আছে আটটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণার কাজে কোনো টাকা খরচ করেনি। এই তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি সমীক্ষায়।
ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২০ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে গবেষণা খাতে ১৩৭ কোটি টাকা খরচ করেছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খরচ করেছে ৩৬ কোটি টাকা। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করেছে ১০১ কোটি টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ১৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ৪৬টি এবং বাকিগুলি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন কয়েক হাজার। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠদান, জ্ঞান চর্চা এবং নতুন জ্ঞানের আবিষ্কার এই তিনটা বিষয়কে বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু পাঠদান হলেও, জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞানের নতুন ক্ষেত্রে উন্মোচন, আবিষ্কার উদ্ভাবন বা মৌলিক গবেষণা কতটা হচ্ছে বা মৌলিক গবেষণার সংস্কৃতি কি আদৌ আছে?
আসলে গবেষণা আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর অগ্রাধিকার পায় না। দেশের সবচেয়ে নামজাদা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণার বরাদ্দ অত্যন্ত হাতাশাজনক। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় যে বাজেট প্রস্তাব করেছে সেখানেও দেখা যাচ্ছে গবেষণাখাত উপেক্ষিত। মোট ৯২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকার বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ১৫ কোটি টাকা (মোট বাজেটের ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ)।
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণা খাতে বরাদ্দ অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। গবেষণা তো দূরের কথা শিক্ষাখাতেই আমাদের দেশে ব্যয় বরাদ্দ কম। বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হলে কর্তাব্যক্তিরা বলেন, 'টাকার পরিমাণ বাড়ানোর কথাটা বলা সহজ, করা তত সহজ নয়। আমাদের মতো গরিব দেশে এত বাড়তি অর্থ আসবে কোথা থেকে?' এ কথা নিশ্চয়ই ঠিক, যে আমাদের টাকা নেই। কিন্তু অগ্রাধিকার কি আছে? অগ্রাধিকার থাকলেই কেবল বরাদ্দ বাড়ানোর প্রশ্ন আসে। এই মুহূর্তে ভারতে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ৩.১%, নরওয়ে ৬.৪%, যুক্তরাজ্যে ৬.২%।
ইউনেসকো শিক্ষাখাতে বাজেটের ২৫% এবং জিডিপির ৬% বরাদ্দের কথা বলে। কিন্তু আমরা সেসব পরামর্শকে পাত্তা দিই না। অনেক কম সামর্থ্যবান দেশেও কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণায় প্রচুর টাকা ব্যয় হয়। কিউবা যদি তাদের মোট খরচের শতকরা ১২ শতাংশের বেশি শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করে, বতসোয়ানা যদি ৭ ভাগের বেশি করতে পারে, বুরুন্ডি যদি ৬ শতাংশ করতে পারে, তা হলে আমরা ৩ শতাংশের বেশি বরাদ্দ করতে পারব না কেন?
আমাদের শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। গত বছরের শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৬৯,৬৪৩ কোটি টাকা, যা ছিল মূল বাজেটের ১১.৯২% এবং জিডিপি'র ২.০৮%। এবার প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। পরিমাণ ৮১, ৪৪৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের তুলনায় ১১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বেড়েছে। এই বরাদ্দ মূল বাজেটের ১২% শতাংশ, তার মানে বরাদ্দ একটু হলেও বেড়েছে। এটা শুনতে খুব ভালো। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে জিডিপির শেয়ারে এটা দাঁড়িয়েছে ১.৮৩ শতাংশ, যা গত বছরে ছিল ২.০৮ শতাংশ। তাহলে শিক্ষা বাজেট কি বাড়ল আসলে? এই শিক্ষা-গবেষণা বরাদ্দের মধ্যে কিন্তু রুপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা-জাতীয় বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট গবেষণাও অন্তর্ভুক্ত। তাহলে শিক্ষায় কোথায় বরাদ্দ বাড়ল? গবেষণা কোথায় গুরুত্ব পেল?
আমাদের মোট শিক্ষাখাতের ব্যয় এখনও জিডিপির ২.০৮%। দেশে গবেষণা ও উন্নয়ন নামে কোনো খাত নেই। এ খাতে তাই কোনো বরাদ্দও নেই। অথচ বিশ্বের প্রায় ১২৫টি দেশে উন্নয়ন ও গবেষণা নামে একটা আলাদা খাত আছে। এই খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। এমনকি এই তালিকায় নেপালও আছে। কিন্তু বাংলাদেশ নাই। একদিকে মৌলিক গবেষণায় অর্থের অভাব অন্যদিকে চাকরির অনিশ্চয়তার ফলে তরুণ প্রজন্ম মৌলিক গবেষণায় ক্রমে আগ্রহ হারাচ্ছে।
অথচ যেখানে একটু সহায়তা, অনুদান, বরাদ্দ, পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে, সেখানে গবেষণায়ও সাফল্য লক্ষ করা গেছে। জিনোম সিকোয়েন্সিং (জীবের দেহে থাকা জিনগত সংকেতগুলোকে একের পর এক বিন্যস্ত করা/অনুসন্ধান করা) গবেষণাতে বাংলাদেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশি পাট ও তোষা পাটসহ একটি ক্ষতিকারক ছত্রাকের জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্সিং) উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ইলিশ মাছের জিন নকশা বের করেছেন। দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন)। এরপর বাংলাদেশে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করে। এসবই আমাদের দেশে গবেষণায় সাফল্যের গল্প। এ ধরনের গল্প রচনায় দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তেমন উদ্যোগ ও সংকল্পের অভাব দেখা যাচ্ছে প্রবলভাবে।
সরকারি নীতির কারণেই আমাদের সমাজে গবেষণা, বিজ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান চিন্তা ক্রমেই কমছে। ব্যক্তিপর্যায়ে, সামাজিকভাবে কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, কোনো জায়গাতেই গবেষণা ও বিজ্ঞান চর্চা যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ আমাদের দেশের অগ্রগতি কিংবা অবনতি, দুই–ই দেশের গবেষণার অভিমুখের ওপর নির্ভর করে। দেশের গবেষণার অভিমুখ তৈরি করে সরকারি নীতি। যে দল সরকার চালায় তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্রই নির্ধারণ করে সরকারি নীতি। স্থির হয় আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ, বিভিন্ন মৌলিক গবেষণার অভিমুখ।
হ্যাঁ, দেশের ভালো চাইলে সরকারকে এ ব্যাপারে নীতি বদলাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও নিজেদের মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় একটু আত্মপোলব্ধির জায়গায় পৌঁছতে হবে। শুধু গ্রাজুয়েট বা এমএ পাশের একটা সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেওয়াই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য হয়, তাহলে গবেষণা কোনোকালে প্রাধান্য পাবে না। জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান চর্চাও এগোবে না। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে আন্তর্জাতিক র্যাংকিং হবে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তালিকার পাঁচশ, এক হাজার, দুই হাজার, পাঁচ হাজারেও থাকবে না।
কেউ যদি গলা বাড়িয়ে বলেন, আমরা তো 'এই বেশ ভালো আছি', তোমার এত মায়াকান্না কেন? তাহলে অবশ্য বলার কিছু থাকে না!