Published : 25 Apr 2022, 09:24 PM
বাংলাদেশের ইতিহাসে পুলিশ বিভাগ সম্ভবত এখনই সবচেয়ে 'সুসময়' উপভোগ করছে। এ বাহিনীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন হয়েছে। আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। বেতন-কাঠামো ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা গত এক দশকে আমূল পরিবর্তন হয়েছে এই সরকারের তিন শাসনামলে।
এই 'সুসময়' পুলিশকে কতটা জনবান্ধব করতে পেরেছে? অবশ্য প্রশ্নটিই অবান্তর হয়ে যায় নানা ঘটনাপ্রবাহে।
পুলিশের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে জনগণকে সেবা দেওয়া। সেই পুলিশ প্রায়ই ক্ষোভের কেন্দ্রে আসে জনবিরোধী কর্মকাণ্ডে। এসব ঘটনায় পুলিশকে কতটা জবাবদিহি করতে হয়, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ফলে বাহিনীটির সদস্যরা নিয়মিতই খবরের শিরোনামে আসে, বেশিরভাগই নেতিবাচক কারণে।
পুলিশ এবার শিরোনামে এসেছে ঢাকার কলাবাগানের ঘটনায়। তেঁতুল তলা মাঠ নিয়ে রোববার যা হয়েছে, তা কি কোন সভ্য দেশে কল্পনা করা যায়?
দমবন্ধ হয়ে যাওয়া এই নগরে আরও খোলা জায়গা থাকা প্রয়োজন। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঢাকা শহর স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় সে দায় বরাবরই এড়িয়ে গেছে। ফলে পাড়া-মহল্লায় এখন আর খেলার মাঠ দেখা যায় না। এর মধ্যেও যে কয়টি মাঠ টিকে গিয়েছিল, তাও দখল করে নেওয়া হচ্ছে। যার সবশেষ নজির কলাবাগানের তেঁতুল তলা মাঠ, যেটি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর মাধ্যমে।
এমন নির্লজ্জ ঘটনা ঘটলে মানুষ প্রতিবাদ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এমনকি যে সমাজে মানুষ প্রতিবাদ করতে ভুলে যায়, সেখানেও কিছু কিছু প্রতিবাদ হয়। কলাবাগানেও তাই হয়েছে।
এই মাঠ রক্ষার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়রা আন্দোলন করছেন। শিশুদের খেলাধুলা ও সামাজিক নানা প্রয়োজনে ৫০ বছর ধরে যে মাঠ ব্যবহার হচ্ছে, তার অধিকার তারা হারাতে চান না।
পুলিশের দাবি, ভূমি মন্ত্রণালয় এই জমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ দিয়েছে। ফলে স্থানীয়দের আপত্তির পরও তেঁতুল তলা মাঠে কলাবাগান থানার ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।
রাষ্ট্র জনগণের যৌক্তিক দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে এতদিনে এই কাজ বন্ধ হয়ে যেত। অথচ আমরা দেখলাম, উল্টো মাঠ রক্ষার আন্দোলনকারী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলেকে থানায় আটকে রাখা হয়েছে ১৩ ঘণ্টা। কাউকে আটকে রেখে কোন বিতর্কিত কাজকে এগিয়ে নেওয়ার বর্বর চিত্র হয়েই থাকবে এই ঘটনা। পুলিশকে মনে রাখতে হবে, জমির বরাদ্দ পাওয়া মানেই জনগণের ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের বরাদ্দ পেয়ে যাওয়া নয়।
২০১৪ সালের ৫ মে দেশের সব খাল, খেলার মাঠ ও পার্ক রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। খেলার মাঠ রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দিয়েছেন। গত জানুয়ারিতে ডিসি সম্মেলনেও তিনি পার্ক, খেলার মাঠ সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
মাঠ বাঁচিয়ে রাখতে ঢাকার দুই মেয়রও বক্তব্য দিয়ে আসছেন। খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানে কোনোভাবেই কোনো ধরনের ভবন নির্মাণের জন্য দেয়া যেতে পারে না- এটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন। সেখানে তার এলাকার মধ্যেই আরেকটি মাঠ বেহাত হয়ে যাচ্ছে।
মাঠ রক্ষার দাবিতে তৎপর হওয়ায় দুইজন মানুষকে ১৩ ঘণ্টা আটকে রাখার পরও কোন কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া সামনে আসেনি। অথচ এটি কোন রাজনৈতিক ইস্যু হলে সরকারের মন্ত্রিদের কথামালা আসতে বেশি দেরি হতো না। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, মাঠের জন্য বাণী দেওয়া যায়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। একইসাথে জনগনের প্রতি কতটা অবহেলা দেখানো যায়, তাও দেখা গেল কলাবাগানে।
পুলিশের লজ্জিত হওয়ার এমন অসংখ্য ঘটনা নিকট অতীতে তাকালেই দেখা যাবে। নিউ মার্কেটে ব্যবসায়ী-শিক্ষার্থী সংঘর্ষে দুইজনের মৃত্যুর দায় কি পুলিশ এড়াতে পারবে? পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় একটি রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি দেখতে হয়েছে আমাদের। এই ব্যর্থতার জন্য পুলিশকে জবাবদিহি করতে হয়েছে, এমন কোন তথ্যও জানা যায়নি।
চলতি মাসেই লালমনিরহাটে রবিউল নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের হেফাজতে। স্বজনদের অভিযোগ- নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় কেবল একজন এসআইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কঠোর ব্যবস্থা না থাকায় হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও বন্ধ হচ্ছে না।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে পুলিশের ভূমিকাকে কিভাবে দেখবো? বাজার দর নিয়ে রোজার আগে থেকে জনগণের যখন নাভিশ্বাস, তখন ব্যবসায়ীরা জানান সড়ক-মহাসড়কে পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। বাজার ঘুরে বাণিজ্যমন্ত্রীর আলোচনায়ও আসে- চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। পরিস্থিতি এমন হলো যে- চাঁদাবাজি বন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন দেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এরপর পুলিশ সদর দপ্তর সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা তথ্য ছাড়া সড়কে পণ্যবাহী গাড়ি না থামাতে নির্দেশনা দেয়।
এছাড়া কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য চাঁদাবাজির সঙ্গে বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততার যে সন্দেহ, তাকে আরও জোরালো করেছে। পুলিশের দায়িত্ব চাঁদাবাজি বন্ধ করা। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ কি? চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে পুলিশ সক্রিয় নয় কেন? এসব বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার। পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির যে অভিযোগ তাও তদন্ত হওয়া উচিত।
পুলিশের ভূমিকা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলে অপরাধ প্রবণতা কমে আসতো। কলাবাগানে যেভাবে দুইজনকে আটকে রাখা হয়েছে, তা বেআইনি। এর সাথে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক এবং খেলার মাঠে থানা ভবন নির্মাণের বরাদ্দ বাতিল করা হোক। সরকারকে বুঝতে হবে- পতিত জমিতে তার অধিকার ততটুকু, যেটুকু জনকল্যাণকর।
আমরা চাই, পুলিশ তার ভালো কাজের জন্য গর্ব করুক। একইসাথে ভুল আচরণের জন্য লজ্জা পাক, নিজেদের শুধরে নিক। বাহিনীর ভাবমূর্তির জন্যই তা জরুরি। না হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি থামবে না এবং নির্লজ্জ গন্তব্য আস্থার সংকটকেই কেবল বাড়িয়ে দিতে পারে।