Published : 13 Apr 2022, 11:28 PM
ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার রমনার বটমূলে সমবেত কণ্ঠে 'এসো হে বৈশাখ, এসো এসো' গানের মাধ্যমে বৈশাখবন্দনা বা বাংলা বর্ষবরণের শুরু হয়েছিল গত শতকের ষাটের দশকের পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ ইংরেজি এবং ১৩৭৪ বাংলা সালে এই বর্ষবরণের সূচনা হয়। রাখঢাক না করে যখন পাকিস্তান সরকারের একাধিক মন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান রবীন্দ্রবিরোধী বক্তব্য দেওয়া শুরু করলে তারই প্রতিবাদে হিসেবে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার কথা ভাবতে হয় শিল্পীদের। ছায়ানটের শিল্পীদের মতামতের ভিত্তিতে ১৯৬৭ সালের খোলামঞ্চে গান গাওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। তবে এর পক্ষে ও বিপক্ষে মত থাকলেও পক্ষেই ছিলেন বেশি। ছায়ানট গড়ে তোলার উদ্যোক্তদের একাধিকজনের স্মৃতিচারণ থেকে যা জানা যায়, তা এরকম: প্রকৃতিপ্রেমিক ড. নওয়াজেশ আহমদের ওপরে ভার দেওয়া হয় একটি গাছ খোঁজার, যার নিচে বসে গান গাওয়া যায়। ড. নওয়াজেশ খোঁজখবর নিয়ে ওয়াহিদুল হককে রমনা বটমূলের কথা জানান। সেটি আসলে বটগাছ ছিল না, সেটা ছিল অশ্বত্থ গাছ। কিন্তু বলা ও শোনার সুবিধা বিবেচনা করে অশ্বত্থ গাছটিকেই বটগাছ বলে চালিয়ে প্রথম বছরের অনুষ্ঠানটি করা হয়। এ নিয়ে শুরুতে একটু দ্বিধা থাকলেও 'বটমূল' নাম গ্রহণে কারো কাছ থেকেই প্রবল আপত্তি ওঠেনি।
জঙল ভর্তি রমনায় অনুষ্ঠান করার উপযোগী না হলেও শান্ত, কোলাহলমুক্ত বলে অনুষ্ঠান করার জন্য সেই জায়গাই নির্বাচন করা হয়েছিল। সারারাত আলো জ্বেলে ছায়ানটের কর্মীরা সেই জঙল, ঘাস পরিষ্কার করে প্রথমবারের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। প্রথমবারের মতোন খোলা মঞ্চে সমবেত কণ্ঠে ছায়ানটের শিল্পীদের কণ্ঠে গীত হয়েছিল, 'আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও'। সেই থেকে ছায়ানট তার সুরের ধারায় প্রতি বছর মাতিয়ে রেখেছে রমনার বটমূল। খোলা মঞ্চে গান গাওয়া যায় না বলে ছায়ানটের শিল্পীদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল সে সময়ে। প্রথমবারের মেলায় জনসমাগম তেমন না হলেও তারপর থেকে প্রতি বছরই জনসমাগম ক্রমে বেড়েছে এবং পহেলা বৈশাখের এই অনুষ্ঠান অব্যাহত রেখেছে ছায়ানট। ধীরে ধীরে এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে জমে উঠতে থাকে বৈশাখী মেলা। ছায়ানটের বর্ষবরণের এই অনুষ্ঠান যে এখন বাঙালির জাগরণের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে তা কিন্তু সহজে হয়নি। অনেক বাধা ছিল। বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছিল। একে 'হিন্দুয়ানি' প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা ছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীলতাকে পরাভূত করে শেষপর্যন্ত জয়ী হয়েছে বাঙালির 'সাংস্কৃতিক দ্রোহ'। শুধু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কারণে এবং ২০২০-২০২১ দুই বছর করোনার জন্য ছায়ানটের বাংলা নববর্ষ আবাহনের এই অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। আগেই বলেছি, প্রতি বছরই রমনায় জনস্রোত বেড়েছে। গত কয়েক বছর থেকে একসঙ্গে যুক্ত হয়েছে চারুকলা ইনস্টিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবার উগ্রবাদীদের হামলার আশঙ্কায় ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত এটা মনে রাখা ভালো যে, ২০০১ সালে অর্থাৎ বাংলা ১৪০৮ সালের শুরুর দিনটিতে ঢাকার রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে বোমা বর্ষণে ঝলসে উঠেছিল রমনার বটমূল। অনুষ্ঠানে তখন চলছিল নজরুলের 'এ কী অপরূপ রূপে মা' গানটির সুরবিস্তার। ঠিক তখনই বিকট শব্দে চমকে ওঠেন সবাই। ঘটনাটি ছিল অপ্রত্যাশিত। অমন নির্দোষ একটি সাংস্কৃতিক আয়োজনে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশুর আনন্দঘন উপস্থিতিতে বোমা? ছায়ানট সভাপতি অধ্যাপক সনজীদা খাতুন লিখেছিলেন, ''বিস্ফোরণের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে মাইক স্তব্ধ হয়ে গেল! মঞ্চের শিল্পীরা বিস্মিত হয়ে ডান দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল কার একখানি পা উড়ে যাচ্ছে, মঞ্চের ওপরে উড়ে এসে পড়ল একটি চোখ…! ছায়ানটের কর্মীরা চকিত হয়ে উঠলেন। একজন এগিয়ে গিয়ে দেখে এসে উদগত কান্না রোধ করতে করতে জানালেন 'মানুষ মরে গেছে ওখানে!' মঞ্চের ডান ধারে দেখা গেল একটি জায়গায় স্তূপ হয়ে পড়ে রয়েছে মৃতদেহ।'' এই হামলায় ছায়ানটের কোনো কর্মী আহত বা নিহত না হলেও মোট দশজন মানুষ মারা যায়।
বাঙালি জাতিসত্তার চেতনাকে স্তব্ধ করতে হলে আঘাত করতে হবে শিল্পের ওপরে– এই ভাবনা থেকেই হয়তো ধর্মান্ধ উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ভেবেছিল ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে হামলা করলে ভয়ে আর এই অনুষ্ঠান করা হবে না। কিন্তু তারা তো জানত না যে রাষ্ট্রীয় রবীন্দ্রবিরোধী শক্তির সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য রমনার খোলামঞ্চে এই বর্ষবরণের শুরু তাকে এত সহজে থামিয়ে দেওয়া যাবে না। পাকিস্তান-পর্বের সেই ঘোর অমানিশাকালে বাংলা ভাষার বিকৃতি-সাধন ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার বন্ধের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ছায়ানটের সংগঠক ও শিল্পীরা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক লড়াই অব্যাহত রেখেছেন।
নিরাপত্তার কারণে এবার অনুষ্ঠান আয়োজনে হয়তো সেভাবে উদ্দামতা, তারুণ্যের বাধভাঙা উচ্ছ্বাস থাকবে না, তবে এটা নিশ্চিত যে সীমিত আয়োজনেও থাকবে 'রসের আবেশরাশি'। মোট কথা পহেলা বৈশাখে বিষণ্ণতা নয়, অবসাদ নয়– সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মাততে চায় বাঙালি । চিত্তকে ভয়শূন্য রেখেই অনেকে মেতে উঠবে সীমিত বৈশাখী উৎসবে। সীমার মাঝেই তো হয় অসীমের সন্ধান। বাধার মুখে কিংবা প্রতিকূল পরিবেশে বাঙালি সৃজনশীলতার পরিচয়দানে সক্ষমতা সব সময়ই দেখিয়েছে।
আমরা এটাও জানি যে, পহেলা বৈশাখ বাঙালির উৎসবের দিন, আনন্দের দিন, সম্প্রীতির দিন, সৌহার্দ্যের দিন। পহেলা বৈশাখ মানে হালখাতা, পহেলা বৈশাখ মানে গ্রাম্য মেলা। নাগর দোলা, হাওয়াই মিঠাই, বাতাসা, পুতুল নাচ, গান, সার্কাস, মুখোশনৃত্য– আরও কত কি! আজকাল আয়োজনে ব্যাপকতা এসেছে, এসেছে কিছুটা পরিবর্তনও। কিন্ত পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে বাঙালির আবেগ ও ভালোবাসা আছে চির জাগরুক। শুভ নববর্ষ বলে একে অপরের শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনায় কোনো পরিবর্তন নেই, ব্যত্যয় নেই।
ঈদ কিংবা পূজাও উৎসব। ওই উৎসবেও আনন্দ হয়। আর আমাদের আনন্দ মানেই তো খাওয়া-দাওয়া, নতুন পোশাক পরা, দল বেধে ঘুরে বেড়ানো, আড্ডায় মেতে ওঠা। ঈদ-পূজার উৎসব আয়োজন সর্বজনীন নয়। তাতে ধর্ম বিশ্বাসের গণ্ডি আছে। মুখে বলা হয়, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। কিন্তু বাস্তবে তা আচরিত হওয়া কঠিন। হিন্দু যাবেন না ঈদের নামাজের মাঠে। মুসলমান মন্দিরে করবেন না নৈবেদ্য নিবেদন। কিন্তু পহেলা বৈশাখের উৎসবটা প্রকৃত অর্থেই সবার, সব বাঙালির, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির উৎসব বর্ষবরণ।
সে হিসেবে বর্ষবরণের উৎসবই হওয়ার কথা বাঙালির প্রধান জাতীয় উৎসব। কিন্তু হয়েছে কি? না, পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়েও বিভেদ-বিভ্রান্তির অপচেষ্টা আছে, ছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির কৃষ্টি-ঐতিহ্যকে অবদমনের চেষ্টা করেছে। একে 'হিন্দুয়ানি' বলে প্রচার করেছে। তবে বাঙালি সেটা মানেনি। পহেলা বৈশাখকে একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসব হিসেবেই পালন করে আসা হচ্ছে। বাধা দিলে বাধা না মানাই হলো বাঙালির এক সহজাত প্রবণতা। পহেলা বৈশাখ পালনে বাধা দিয়ে পাকিস্তানিরা বাঙালিকে হারাতে পারেনি, নিজেরাই হেরেছে।
এখনও যারা বাঙালির বর্ষবরণের উৎসবের বিরোধিতা করেন, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অমঙ্গলের চিহ্ন দেখেন, তাদেরও পিছু হঠতে হবে। কারণ বাঙালির রক্তে আছে দ্রোহ, এ রক্ত পরাভব মানে না। 'জ্বলে পুড়ে ছাড়খার তবু মাথা নোয়াবার নয়'। বাঙালি বিশ্বাস করে-মুছে যাবে গ্লানি, ঘুচে যাবে জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হবে ধরা।
বাংলা নববর্ষ বরণের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবহনমান কাল ধরে বাঙালির পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস তুলে ধরে বলেছেন, "বিভিন্ন ধর্মে-বর্ণে বিভক্ত হলেও ঐতিহ্য ও কৃষ্টির জায়গায় সব বাঙালি এক এবং অভিন্ন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও পয়লা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন এখনও স্ব-মহিমায় টিকে আছে। সারা বছরের ক্লেদ-গ্লানি, হতাশা ভুলে এদিন সব বাঙালি নতুন আনন্দ-উদ্দীপনায় মেতে উঠেন।"
বাঙালির মুখের ভাষা,সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে উপজীব্য করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিন বলেছেন, "যার উপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা মানে আমাদের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা।"
'সকল সঙ্কীর্ণতা, কূপমণ্ডুকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পয়লা বৈশাখ আমাদের অনুপ্রাণিত করে'' বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, "মনের ভিতরের সকল ক্লেদ,জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যমে বাঁচার শক্তি জোগায়, স্বপ্ন দেখায়। আমরা যে বাঙালি,বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়,উজ্জীবিত হয়।"
গত কয়েকদিনে দেশে কয়েকটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুজন স্কুল শিক্ষককে যেভাবে অসম্মানিত করা হয়েছে, তা খুবই পীড়াদায়ক। 'সংকীর্ণতা, কূপমন্ডুকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পয়লা বৈশাখ আমাদের অনুপ্রাণিত করে' বলে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে যেসব অপশক্তি মাঝেমাঝেই চ্যালেঞ্জ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিধা করলে মনের ভেতরের ক্লেদ-গ্লানি-হতাশা দূর হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে না।
আমাদের জীবনে দুঃখ-বেদনা আছে। জয়ের আনন্দের পাশাপাশি সাময়িক পরাজয়ের কাতরতাও আছে। আমরা পাই, আবার পেয়েও হারাই। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অবদমিত হয় না। পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে আমরা বরণ করি এই আশা নিয়ে যে, নতুন বছরে আমরা 'পুরাতন অপরাধ'- এর পুনরাবৃত্তি করব না। বৈশাখ চির নতুনকেই ডাক দিতে এসেছে। আমরা নতুন করে সংকল্পবদ্ধ হব, দুবেলা মরার আগে মরব না, আমরা ভয় করব না। আমরা মানুষ হয়ে ওঠার সাধনা করব। মনুষ্যত্বের জয়গান গাইব। ধর্ম যেন আমাদের যুক্তিবোধ ও শুভবোধকে আচ্ছন্ন করতে না পারে। আমরা যেন ভুলে না যাই, মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। 'মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো'। যেকোনো পশ্চাৎগামিতাকে প্রতিরোধ করে, আঁধারের বুকে আলো জ্বালানোর প্রতিজ্ঞা নিয়েই আমরা আবাহন করব নতুন বছরকে–১৪২৯ বঙ্গাব্দকে। শুভ নববর্ষ। জয় হোক বাঙালির। জয় হোক মানুষের।