Published : 28 Mar 2022, 12:59 PM
সত্যেন সেন (২৮ মার্চ ১৯০৭–৫ জানুয়ারি ১৯৮১) প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে সমাজের তলদেশ অবধি সঞ্চারিত করার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। তাই তিনি সংস্কৃতির সঙ্গে জীবনকে যুক্ত করার লক্ষ্যে বিপুল কর্মকাণ্ডেরও আয়োজন করে গেছেন। তাই তাকে চিনতে হলে তার কর্মভাণ্ডারকে জানতে হবে। সত্যেন সেনকে জানার অন্যতম উপায় হচ্ছে তার গান। সত্যেন সেন নিজে সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। তিনি একাধারে গান লিখতেন, সুর করতেন এবং গাইতেন। গানের মধ্য দিয়ে তার মেজাজ, লোকমুখিতা, দর্শন ও চিন্তার প্রতিফলন ভীষণভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন। এ গানগুলোর অধিকাংশই আজ বিলুপ্তপ্রায়। কিছু গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। যতগুলি গানের সন্ধান মিলেছে তা থেকেই সত্যেন সেনের গানের গণমুখীনতার পরিচয় মেলে। সত্যেন সেনের প্রতিটি গানই অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দরের ঐক্য, অসঙ্গতির মাঝে সঙ্গতির সুর ও সাম্য প্রতিষ্ঠার মনষ্কামনা বারংবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সত্যেন সেন তার জীবনের প্রথম দিকে যে গানগুলি রচনা করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো 'লীগ-কংগ্রেস এক হও'। '… কংগ্রেস লীগ দেশনেতা শোনরে আমার কথা/ এখনো দেখরে ভাবিয়া/ কোন পথে চলছে, কি মোহে যে ভুলছে/ কোথায় এসেছো আজি নামিয়া।' এই গানটি তিনি রচনা করেন ১৯৪২ সালে।
১৯৪৩ সাল, বাংলা ১৩৫০ সনে সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণনীতির কারণে খাদ্যের দাম বেড়ে যায়। তিন টাকার চাল চৌদ্দ টাকা হয়। বাংলায় দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। তখনকার ওই পটভূমিতে সত্যেন সেন রচনা করেন 'চাউলের মূল্য চৌদ্দ টাকা/ কেরোসিন তেল নাইরে/ কেরোসিন তেল নাই/ হায় কি করি উপায় রে/ কি করি উপায়।' ওই সময় এ গানটি গেয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলতেন এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সত্যেন সেনের এসব গানের বিষয় এবং দর্শন এমন সময়োপযোগী যে একটু মনোযোগ সহকারে বিশ্লেষণ করলেই সময়ের প্রেক্ষাপট চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে, ভেসে ওঠে একটি দৃশ্যকল্প।
সত্যেন সেনের ভাবনা মানুষকে নিয়ে। মানুষই ছিল তার কাছে প্রধান বিবেচ্য। তার লক্ষ্য ছিল মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা। যে কারণে তার জীবন দর্শন, কথা-কবিতা এবং সংগ্রামে মানুষের ছবি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। তিনি গানে গানে বিধৃত করেছেন 'মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচি গান, মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেয়া প্রাণ'। এ গানের মধ্য দিয়ে সত্যেন সেন মানুষের অন্তরে চির জাগরুক থাকবেন।
আমরা জানি ব্রিটিশরাজ এদেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হলেও দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে যায় সাম্প্রদায়িকতার আগুন। যে আগুনে অঙ্গার হয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান। হিন্দু-মুসলিম ভাইয়ে ভাইয়ে দাঙ্গা হয়েছে। দাঙ্গার বিরুদ্ধে মানুষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সত্যেন সেন লিখেছেন, 'ও যারা দাঙ্গা করে মানুষ মারে/ বুঝে নারে পথের গতি,/ ও যারা দাঙ্গা করে/ সে কি কভু চিন্তা করে/ এটাই আমার দেশের ক্ষতি […]'।
সত্যেন সেনের সাহিত্যকর্মের মূলে মানুষ থাকলেও খেটে খাওয়া মানুষ, অসহায় নারী, অস্পৃশ্য বা নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি ছিল তার বিশেষ নজর। তাই তো তিনি ১৯৪৩ সালে ঘুমন্ত ও সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নারী সমাজকে জাগ্রত ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে গান লেখেন। নিবেদিতা নাগ তার একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির ময়মনসিংহ জেলা সম্মেলনের পূর্বে সত্যেনদা একটি গান লিখে তাতে সুর করে দেন। গানটি ছিল এরকম, 'ও ভারতের নারী/ চলতে হবে রক্ত পিছিল রাজপথে/ সহজপথে চলার উপায় নাইকো কোনো মতে।' আমেনা আক্তার, যিনি ১৯৫৬ সালের দিকে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় অনীল মুখার্জী, সত্যেন সেনদেরকে পরম মমতায় আগলে রাখতেন, রান্না করে খাওয়াতেন। তার স্মৃতিচারণ থেকে পাওয়া যায়, নারীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং মিছিলে অনেক লোক জড়ো করার কৌশল হিসেবে সত্যেনদা একটি গান লিখে দিয়ে তা গাইতে বলেছিলেন। ওই গানের কথাগুলো ছিল, 'মেয়েরা জাগো জাগো/ মেয়েরা জাগো জাগো/ পুরুষের হাতে গড়া শাস্ত্রের বিধানে/ কারাগৃহে নন্দিনী নারী/ মেয়েরা জাগো জাগো/ তোমাদের পদ ভারে কেঁপে যাক ধরণী/ ভেঙে যাক জীর্ণ এ কারা/ মেয়েরা জাগো জাগো/ মেয়েরা জাগো জাগো'।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো সত্যেন সেনের এ গানগুলি এখনো প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। সত্যেন সেনের সৃষ্টি এবং দৃষ্টিতে ছিল ভীষণ রকমের তীক্ষ্ণতা ও প্রখরতা। যা দিয়ে তিনি দেখেছেন বিস্তীর্ণ প্রান্তর পর্যন্ত। তিনি তার গানের মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী নর-নারীর প্রতি তার যে দরদ তা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। সত্যেন সেনের গানে শ্রমজীবী মানুষের বন্দনা বারবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে, 'বল জয় জয় জয়/ বল সর্বহারার জয়/ বল বীর জনতার জয়/ […] বল জয় মজুর চাষির'। কৃষক তার রক্ত পানি করে ফসল ফলায়, দেশের মানুষের জীবন রক্ষা করে, কিন্তু নিজে না খেয়ে মরে। এ চিত্র সত্যেন সেনের অন্তরকে ব্যথিত করে। তাই তো তিনি গানের মধ্য দিয়ে বলে উঠেছেন, 'দিনে যদি হোসরে কানা/ কি হবে আর রাত্রি হলে/ বুঝবি কি আর মলে'। সত্যেন সেন দেখেছেন চারিদিকে শোষণের জুলুমের জিঞ্জির। সে জিঞ্জির ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য মুক্তিকামী মানুষের প্রতি তার আহ্বান, 'আজি সপ্তসাগর ওঠে উচ্ছলিয়া/ […] মুক্তির সেনানীরা ছুটে আয়/ মৃত্যু ও জীবনের মোহনায়/ জানি পথ দুর্গম তবু চল দুর্দম/ মুক্তির রণরোলে ছেয়েছে আকাশ'। সত্যেন সেন অতি সাধারণ মেহনতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিড়ম্বনা অন্তরের দরদ দিয়ে উপস্থাপন করেছেন তার গানের মধ্য দিয়ে। এরকম একটি গান, 'হায় দুঃখ সয়না প্রাণেরে হায় হায়রে/ […] রাইতে দিনে চোরের মেলা লুইটা পুইটা খায়/ গরীব লোকের ভাঙা কপাল বাঁচন হইলো দায় রে'। যে কৃষক ফসল ফলায়ে মানুষের অন্নের জোগান দেয় সেই কৃষকের প্রতি সত্যেন সেনের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাই তো কথা ও সুরে বন্দনা করেছেন কৃষকের, 'চাষি দে তোর লাল সালাম তোর লাল নিশান রে/ আঁধার পথে আলো দেয় সে মুশকিল আসান করে।/ […] আমরা মাটির মানুষে ভাই মাটির জয়গান গাই/ হাজার কিষাণ বাজাই বিষাণ নতুন দিনের ভোরে।' শ্রমজীবী মানুষকে এই শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্ত করতে সত্যেন সেন যুথবদ্ধতায় বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন অর্থনৈতিক মুক্তিতে। সত্যেন সেন মনে করতেন শ্রমজীবী মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় একত্রিত হয়ে যে জনশক্তি গড়ে উঠবে তা থেকেই একদিন শ্রেণি জাগরণের সূত্রপাত ঘটবে, দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে চূর্ণ হবে। সে ধারণা থেকেই তিনি রচনা করেছেন সমবায় উন্নয়নের গান, 'জনরক্ষা সমিতি গড় সেই আমাদের জোর/ আত্মরক্ষা সমিতি গড় সেই আমাদের দায়/ দশে মিল্যা হাত মিলাইরে/ সব রইব বজায় আর সব হইব আদায়/ এই কর উপায় রে ভাই এই কর উপায়।'
মানুষ যখন জেগে ওঠে তখন তাকে প্রতিহত করা শক্ত। মাতৃভাষার দাবিতে বাংলার মানুষ যখন জেগে উঠেছিল তখন সামরিক সরকারও তার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে যখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে সে সময় সত্যেন সেন লিখলেন, 'আগুন নিভাইবো কেরে/ […]আগুন নিভে নিভে নিভে না/ […] তোমার ঐ জঙ্গী আইন চলবে ক'দিন যতই করো জারি/ ঘরে ঘরে ডাক পাঠাই একুশে ফেব্রুয়ারি।' সত্যেন সেনের এই দৃঢ় প্রত্যয় কোনোদিন নিভবে না, জ্বলে উঠবে প্রতিটি শোষণ প্রহসনের বিরুদ্ধে।
গানের মধ্য দিয়ে যে মানুষকে ভালোবাসা যায়, তাকে উজ্জীবিত করা যায় তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ এখানে তুলে ধরতে চাই। সত্যেন সেন-এর জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে কারাগারে। সেখানেও তিনি কয়েদিদেরকে গান গেয়ে মাতিয়ে রাখতেন। কয়েদিদের জন্য তিনি একটি বিশেষ গান লিখেছিলেন। গানটি হলো- 'পায়খানাতে যাই জলভরে খাই/ এই ঘটিতে সব চলে/ জেলখানাতে দুঃখ আছে কে বলে?'।
সত্যেন সেনের আরেকটি অবিস্মরণীয় গান 'মারো জোয়ান হেইও মারো কষে টান/ তালে তালে ফেলো বৈঠা নদীতে উজান।' ৬৪ সালের দিকে মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বে দেশের মধ্যে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষগুলোর মধ্যে যখন ফাটল ধরতে আরম্ভ করেছে তখন সত্যেন সেন রচনা করেন 'ও আমার দেশের ভাইরে আমার মিনতি শোনো শোনো/ শোনোরে ভাই দেশের মানুষ মুখ তুলিয়া চাও/ ঘরের ইন্দুর বাঁধ কাটে ভাই দেখতে কি না পাও'। এভাবেই সমাজের সর্বস্তরের অসঙ্গতিগুলো তার গানের মধ্যে ধরা পড়েছে।
সত্যেন সেন বিশ্বাস করতেন সর্বহারা শ্রেণির মুক্তিতে। তিনি মনে করতেন শ্রমজীবী মানুষ, যাদের রক্ত-ঘাম ও শ্রমের বিনিময়ে সভ্যতার চাকা সচল রয়েছে তাদেরকে জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে মানুষের আসল মুক্তি সম্ভব। তাই তো এই শ্রমজীবী মানুষকে জাগ্রত করার প্রয়াসে তার নিবেদন– ওরে ওরে বঞ্চিত সর্বহারা দল/শোষণের দিন হয়ে এল ক্ষীণ/নবযুগ আসে চঞ্চল'। স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক সংগীতের প্রেরণায় রচিত হয়েছে এ গানটি। তার গানগুলি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে আজ আমরাই সমৃদ্ধ হতাম। এখনও যে গানগুলি সংগ্রহে আছে সে গানের মশাল বহন করে আমরা যদি এগোতে পারি তাহলে প্রগতিবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে মানুষের যে সংগ্রাম তা আরও গতিশীল হবে। ১১৫তম জন্মদিনে তার প্রতি আভূমিনত শ্রদ্ধা।