Published : 25 Mar 2022, 08:20 PM
বিখ্যাত চিত্রকর কামরুল হাসানের একাত্তরের পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়া খানের মুখায়বকে নিয়ে আঁকা 'একজন রাক্ষস '( ১৯৭১) ছবির দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, কতটা রক্তচোষা প্রকৃতির ছিল এই মানুষটি। ছবিটিতে তার চোখ, মুখ এমনকি কি কান দিয়ে বের হচ্ছিল রক্তের লেলিহান শিখা। বাংলাদেশের জেনোসাইড ঘটনার কুখ্যাত খলনায়ক তিনি। ৭০ সালের নির্বাচনে পরাজয় এবং বাঙালির আপামর জনসাধারণের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবিত হওয়া, সব পরিস্থিতির আলোকে পাকিস্তানি শাসকের মনে একটা ভয় চেপে ধরেছিল, পূর্ব পাকিস্তান ভূখণ্ড হারানোর। তাইতো, যে কোন উপায়ে হোক এই ভূখণ্ডকে নিজেদের অধীনে রাখার জন্য নিয়েছিলো পোড়ামাটির নীতি। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি সম্মেলনে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন , "Kill three million of them, and the rest will eat out of our hands." (তাদের ত্রিশ লাখ মেরে ফেলো, বাকিরা আমাদের হাত থেকেই খেয়ে বেঁচে থাকবে)। এই সংবাদের সত্যতা পাওয়া যায় রবার্ট পিয়েনের 'ম্যাসাকার' নামক গ্রন্থে, যার প্রকাশকাল ১৯৭৩ সাল। তার এই নৃশংস পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্যও ছিল কিছু রক্তচোষা পাকিস্তানি সেনা অফিসার। তারাও শুরু করে তাদের নীলনকশা।
১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ সকালে রাও ফরমান আলী ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে খাদিম হুসাইন রাজার অফিসে হাজির হন এবং একটা গোপন বৈঠকে বসেন। এই বৈঠক চলার সময়ে রাও ফরমান আলী একটি সাধারণ কাঠপেন্সিল হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর দিয়ে ১৬টি প্যারা সম্বলিত এবং পাঁচ পৃষ্ঠা দীর্ঘ 'অপারেশন সার্চলাইট' নাম দিয়ে বাঙালি হত্যার নীলনকশা সম্বলিত খসড়া পরিকল্পনা করে। এই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে সিদ্দিক সালিকের রচিত 'উইটনেস টু সারেন্ডার' নামক বইয়ে, যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে।
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, রাও ফরমান আলী খুব সুকৌশলে পেন্সিলের কালি ব্যবহার করে, যাতে পরবর্তীতে সহজে মুছে ফেলা যায় বা কোন দালিলিক প্রমাণ না থাকে। ২০ মার্চে জেনারেল হামিদ এবং লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা সেই পরিকল্পনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে এবং কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেটার উপর গুরুত্ব দেয়। একটি বিষয় জানা প্রয়োজন, এই পরিকল্পনায় অপারেশনের জন্য নির্ধারিত সময়ের উল্লেখ ছিল না। তারা অপেক্ষার প্রহর গুনছিল, গোপনে গোপনে প্রস্তুত হচ্ছিল অপারেশনের জন্য।
এদিকে একাত্তরের মার্চ মাসের আন্দোলন-সংগ্রাম ক্রমেই দানা বাঁধছিলো পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। এমন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নেন। একদিকে আলোচনা, অন্যদিকে দেশব্যাপী প্রতিরোধ-সংগ্রাম। ১৬ই মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত আলোচনায় কোন সমাধান না আসায় ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চে করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। কিন্তু, তার পূর্বেই দিয়ে যান বাঙ্গালী নিধনের পরিকল্পনা 'অপারেশন সার্চলাইট' বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সংকেত।
যে কোন মুহূর্তে পাকবাহিনী যেন বাঙালি নিধনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তার জন্য নিয়ে রেখেছিল সব ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি। ২০ মার্চের পর পর জেনারেল হামিদ বাঙালি সেনা ইউনিটগুলোকে নীরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেসময়ে ইপিআর, আর্মড পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীদের নিরস্ত্র করার অনুমতি দেয়। অপারেশন পরিচালনার জন্য রাও ফরমান আলীকে দেয়া হয় ঢাকার দায়িত্ব এবং খাদিম হুসাইন রাজার উপর ঢাকার বাইরে অন্যান্য সব স্থানের দায়িত্ব। জেনারেল টিক্কা সার্বক্ষণিক প্রস্তুত ছিল ৩১তম কমান্ড সেন্টারের তদারকি এবং ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার জন্য। এই অপারেশনের পরিকল্পনার স্বরূপ পাওয়া যায় খাদিম হুসাইন রাজার লিখিত 'আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ঔন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭১' বইয়ে। পরিকল্পনার মূল দিকগুলো ছিল এইরকম- যে কোন ধরনের বিদ্রোহ বা বিরোধিতাকে কঠোরভাবে দমন করা হবে; বাঙালি সেনা সদস্য ও পুলিশকে নিরস্ত্র করা হবে। বিশেষ করে পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অস্ত্রাগার, রাজারবাগের রিজার্ভ পুলিশ এবং চট্টগ্রামে কুড়ি হাজার রাইফেলের অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ নেয়া; অপারেশন শুরুর সাথে সাথে সব রকমের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে নতুনভাবে যাচাই-বাছাই করে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে অস্ত্রশস্ত্র এবং অপরাধীদের খোঁজে ঘিরে ফেলতে হবে এবং তল্লাশি চালাতে হবে; এছাড়াও, শেখ মুজিবকে জীবিত অবস্থায় ধরতে হবে এবং এর বাইরে আরও ১৫ জন আওয়ামী লীগ এবং কম্যুনিস্ট পার্টির নেতার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে হবে, পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার।
জেনোসাইড চালানোর বিষয়ে সবসময় কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেছিল। ২৫ মার্চে রাতকে তারা ব্যবহার করলো সূচনা হিসেবে। কারফিউ জারি করা হল ২৫ মার্চ রাত ১১টায়। টেলিফোন/টেলিগ্রাফ/রেডিও স্টেশন এবং সকল প্রকার পত্রিকাপ্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হলো। ঢাকা শহরকে সব শহর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কর্মীদের ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হলো আগেই।
রাত ১১টা ৩০মিনিট। পাকিস্তানি বাহিনী জলপাই রঙের ট্যাংক নিয়ে হামলে পড়ে বাঙালি নিধনের জন্য। ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ৪৩টি হালকা অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট (এলএএ) রেজিমেন্ট, ২২ বালুচ, ৩২ পাঞ্জাব, ১৮ পাঞ্জাব সমস্ত আর্টিলারি বাহিনী বিভিন্ন পয়েন্টে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা সেনানিবাস, বিমানবন্দর অঞ্চল, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস লাইন, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, নবাবপুর অঞ্চলসহ সারা পুরান ঢাকায় অপারেশন পরিচালনা করে। কী পরিমাণ মানুষকে হত্যা করা হয় সেটার পরিসংখ্যান আজও অজানা। এই হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতা কল্পনাতীত।
২৫ মার্চের স্মৃতিচারণা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজয় রায়ের প্রকাশিত লেখায় উঠে এসেছে,
সব রাতের শেষ আছে। ২৫ মার্চের কালরাত্রি এক সময় পোহাল। দূরাগত আজানের ধ্বনি ভেসে আসলো। না ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে সেদিন আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়নি- সাহস পাননি নামাজের আহ্বান জানাতে ধর্মপ্রাণ মুয়াজ্জিন। যেন মনে হল দূরাগত ঐ আজানের ধ্বনির মধ্যে সারা বাংলাদেশের কান্না ঝরে পড়ছে। এমন বিষাদ এবং ক্রন্দনময় আজানের ধ্বনি জীবনে শুনিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। ইকবাল হলে ২০০ ছাত্র, তাদের কোয়ার্টারে ৭ জন শিক্ষক এবং আরও ১২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল । জগন্নাথ হলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী, আক্রমণের শিকার হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, রোকেয়া হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবসহ নানা এলাকা। আমেরিকার সরবরাহকৃত এম ২৪ বিশ্বযুদ্ধের ট্যাঙ্কগুলিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে গোপনে ঢাকায় লুকিয়ে থাকা লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের ২৯ মার্চ ব্যাংকক থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পাওয়া যায় এই তথ্যাদি।
আরও জানা যায়, সে রাতে ঢাকায় কমপক্ষে ৭ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। শহীদ মিনার, দৈনিক ইত্তেফাক কার্যালয়, ডেইলি পিপলস কার্যালয় এবং রমনার কালী মন্দির ধ্বংস করা হয়। রাজারবাগ পুলিশলাইনে আক্রমণ চালানো হয়। সারা ঢাকার পরিস্থিতি ছিল অবর্ণনীয়। ফজলুল কাদের কাদেরী সম্পাদিত 'বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস (২০০৩) বইয়ে উঠে এসেছে, একাত্তরের ২৬ মার্চ মধ্য দুপুরে পাকিস্তানি বাহিনী ইংলিশ রোড, ফেঞ্চ রোড, নয়া বাজার, সিটি বাজার এলাকায় ব্যাপক অগ্নি সংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। দুপুর ১২ টা থেকে দুইটার মধ্যকার সময়ে এসব এলাকায় প্রায় সাতশ নর- নারী এবং শিশুকে হত্যা করে। এভাবেই শুরু হয় বাঙালি নিধনের গভীর ষড়যন্ত্র। একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতের ঢাকা থেকে শুরু হয়ে ক্রমান্বয়ে অপারেশন ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে, পাড়ায়, মহল্লায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ।
একাত্তরের নয়মাসব্যাপী বাংলাদেশের সবজায়গায় পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা, ধর্ষণ, জমিদখল, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াসহ সকল ঘৃণ্যকাজ পরিচালনা করে। সাথে যুক্ত ছিল এদেশীয় দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস। ২৫ মার্চের রাত বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গভীর এবং নৃশংস রাত। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সরকার ২৫ মার্চকে "জাতীয় গণহত্যা দিবস"হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রতি বছর পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারকে অনেক বেশি প্রচেষ্টা চালাতে হবে বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতির বিষয়ে। মার্কিন দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'লেমকিন ইনস্টিউট' এবং 'জেনোসাইড ওয়াচ' সম্প্রতি বাংলাদেশ জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিয়ে বিবৃতি দিয়েছে , সেই ক্ষেত্রে আবেদনটি গিয়েছিল ব্যক্তি পর্যায় থেকে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে জেনোসাইড বিষয়ে গবেষণা, একাডেমিক কার্যক্রম, বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতির বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রতি জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। যেসমস্ত পাকিস্তানি শাসক, প্রতিনিধি এবং সেনা অফিসাররা একাত্তরের ২৫ মার্চ সহ মুক্তিযুদ্ধের পুরোসময়ে চলমান জেনোসাইডের সাথে যুক্ত ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কাছে জোর দাবি জানানোর এখনই সময়।