Published : 19 Mar 2022, 07:35 PM
আধুনিক নাটকের জনক হেনরিক ইবসেনের নোরা (এ ডলস হাউজ) নাটক তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার নারীর শেকল ভাঙ্গার গান। যেখানে নোরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার স্বামী কর্তৃক আদরের প্রলোভন-পরাধীনতাকে পায়ে মাড়িয়ে ঘর ছেড়েছেন। বিষয়টি ঈর্ষণীয় কারণ তখনো ক্ষমতা কাঠামো ছিল পুরুষকেন্দ্রিক এবং তা খারিজ করা ছিল চ্যালেঞ্জের। পাশ্চাত্যের মতো প্রাচ্যেও এমন প্রেরণাময়ী নাম আছে, আছে কর্মযজ্ঞ। যদিও সময়ের হিসেবে এসবের প্রেক্ষাপট ও ক্ষেত্রপট ভিন্ন এবং পৃথিবীর নিয়মে এখানেও তা স্বীকারে উদাসীনতা আছে।
দুঃসাহসিক এই প্রেরণার নাম বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সন্তানদের পারিবারিক, নৈতিক শিক্ষা এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অনমনীয় আত্মবিশ্বাসে বেহুলার একক ভাসান যাত্রার মতো সবকিছুকে আগলে নিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন দল ও দেশকে। সংস্কৃত নাটকের আটটি (ক্ষেত্রবিশেষে নয়টিও বলা হয়) রসের একটি তাণ্ডবের অনুপ্রাণনে ১৭ই ডিসেম্বর ধানমণ্ডির ২৮ নং রোডের বাড়ি থেকে মুক্তিলাভের পর বাড়িতে উড়তে থাকা পাকিস্তানিদের পতাকাকে টেনে নামিয়ে, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
বেগম মুজিব মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টায় সবকিছু সামলেছেন আরো কৌশলে। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার অর্থ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন- তাদের নিজেদের অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত আছে। শুধু প্রয়োজন মুজিবের সই। ক'দিন পর বঙ্গবন্ধুর সইসহ চেক আসে। তার এই বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় বঙ্গবন্ধু জীবিত আছেন।
শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং সংগ্রাম শীর্ষক যে ৩টি গ্রন্থ আজ পাওয়া যায় এও বেগম মুজিবের বুদ্ধিমত্তার কারণেই। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর বিশ্ব দরবারে ইমেইজ ঠিক রাখার জন্য ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে ধানমণ্ডির ১৮ নম্বরের বাড়িতে বন্দি করে সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর কথা বললে- বেগম মুজিব পাকিস্তানি সেনাদের জানান সন্তানদের বই খাতা ৩২ এর বাসায়। এরপর বড় মেয়ে শেখ হাসিনাকে দিয়ে কৌশলে বঙ্গবন্ধুর নোট-খাতার লেখাগুলোকে আনিয়ে নেন। সেইসব পাণ্ডুলিপি গোয়েন্দা তৎপরতা এড়াতে শেখ মণির বাসার বারান্দার ঝোলানো শিকায় লুকিয়ে রাখেন। যা আজ তার কন্যার মমতায় প্রকাশিত এবং সর্বময় সমাদৃত।
বেগম সুফিয়া কামাল ফজিলাতুন নেছা মুজিবের মূল্যায়নে বলেন, "মুজিবের কথা বলতে গেলে মুজিবের স্ত্রীর কথা বলতে হয়। এত ধৈর্যশীল, এত শান্ত, এত নিষ্ঠাবতী মহিলা খুবই কম দেখা যায়। বছরের বেশির ভাগ সময় কেটেছে জেলখানায়। যখনই শুনেছি মুজিবকে ধরে নিয়ে গিয়েছে, ছুটে গিয়েছি, দেখেছি, মুজিবের স্ত্রী অবিচল মুখে কাপড়, বিছানা-বালিশ গুছিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। বলেছেন, আপনার ভাই তো জেলে গেছে। বেচারি (শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব) খুব ধৈর্যের সঙ্গে টেনেছে।"
ক্ষমতা-সুখ ছেড়ে দায়িত্ববোধের শেকলে জড়াতে গেলেও বঙ্গবন্ধুকে কখনও নিরুৎসাহিত করেননি। বরং মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের দায়িত্ব নেবার সময়ও মনোযোগী হয়ে ঘর গুছিয়েছেন সরকারি বাড়ি ছাড়বার উদ্দেশ্যে। স্বামীর অবর্তমানে অসুস্থ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চিকিৎসা, বাড়িতে বাজার আছে কিনা- এসবের খবর নিয়েছেন। এসব করতে করতে কখনও কখনও নিজের গয়নাও বিক্রি করেছেন। সংসার চালাতে আমেরিকা থেকে আনা ফ্রিজ বিক্রি করেছেন। সন্তানদের বুঝিয়েছেন ফ্রিজের পানি খেলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার কারণে সন্তানদের মধ্যে যেন বেহিসেবী ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব তৈরি না হয়, সেদিকে সব সময় সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন বঙ্গমাতা। তাদের মানুষ হিসেবে গড়তে গিয়ে নিজেও থেকেছেন অনাড়ম্বর জীবনে। সন্তানদের খিচুরি, আচার খাইয়ে বলেছেন, প্রতিদিন ভাত খেতে ভাল লাগে নাকি ? বাড়ির খরচ বাঁচানোর জন্যে নিজে ইট বিছিয়েছেন, দেয়ালে পানি দিয়েছেন। এককথায় সর্বংসহা। অথচ বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রপ্রধানদের স্ত্রীদের জীবনাচরণে চাকচিক্যের অন্ত ছিল না।
নিরীক্ষার দৃষ্টিতে দেখলে এমন সর্বংসহা ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু এতটা এগোতে পেরেছেন। যদিও পুরুষতান্ত্রিক চোখ এরপরও তাকে কেবল মুজিবের স্ত্রী বা বেগম মুজিব সম্বোধন করতে চাইবে, কিন্তু তিনি নিজেও একজন সচেতন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। ৬ দফাকে ৮ দফায় নেবার পাঁয়তারা থেকে শুরু করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের প্যারোলে মুক্তি, সকল ষড়যন্ত্রকে ছায়াসঙ্গী হিসেবে রুখে দিয়েছেন।
এক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এর উদাহরণ। 'এই মামলা নিয়ে আপস না করলে বিধবা হতে হবে' এমন কথার উত্তরে বঙ্গমাতা বলেছিলেন , "এই মামলার ৩৫ জনের ৩৪ জনই বিবাহিত। কাজেই বিধবা তো আমি একা হচ্ছি না।" এমনই দীপ্ত আলোক সম্ভাষিত ছিল তার আচরণ। ইবসেনের নোরার চরিত্র নাটকের নায়িকা মাত্র। বঙ্গমাতা বাঙালির শেকল ভাঙ্গা গানের পথিকৃত, আগুন ঝরা স্বপ্নের মূর্ত উপস্থিতি।