Published : 15 Feb 2022, 06:22 PM
দুইটি ঘটনার উল্লেখ করে লেখাটি শুরু করতে চাই। প্রথমটি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ 'গ্রন্থাগার ও লেখক' বিষয়ে বক্তৃতা করার জন্যে আমাকে আমন্ত্রণ করেছিল। ওই অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিষয়ের একদল শিক্ষার্থী, গবেষক এবং শিক্ষকও যোগ দিয়েছিলেন। কথা প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার শিক্ষক ডক্টর ওয়ান এবি কাদির ওয়ান দোল্লাহ জানালেন, মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মানুষের নিজ নিজ মাতৃভাষায় বই কেনার জন্যে তাদের কাছে বইয়ের চাহিদা এবং নাম জানতে চাওয়া হয়।
প্রায় অন্য সব দেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষায় বইয়ের চাহিদা গ্রন্থাগারগুলোকে জানালেও ব্যতিক্রম কেবল বাংলাদেশের মানুষের ক্ষেত্রে। তারা খুব একটা গ্রন্থাগারে যান না, আর গেলেও মাতৃভাষায় বইয়ের কোনো নাম বা চাহিদাও জমা দেন না। এর কারণ কী এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?
এর কোনো জবাব দিতে পারিনি। আমি কেবল বলেছি, "এটা আমারও জানার আগ্রহ; আমাদের দেশের যারা তোমাদের দেশে বসবাস করে তারা এখন তোমাদের সমাজেরও অংশ। তোমরা গবেষণা করে বা তাদের সঙ্গে কথা বলে বের করো এর পেছনের কারণ কী এবং এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায়ে কী।"
বিদেশি অতিথি ডক্টর কাদিরকে এই কথা বললেও ভেতরে আমি খুব একটা স্বস্তি পাইনি। শুধু মালয়েশিয়া কেন, খোদ ইউরোপের কয়েকটি দেশের বাবসবাসরত বাঙালির বই পড়া বিষয়ে আমার ধারণা প্রায় একই রকম। এর পেছনের কারণ কি আদতেই আমাদের কাছে অজানা? এই বিষয়ে লেখার পরের দিকে আলোকপাত করবো। তার আগে দ্বিতীয় ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'গ্রন্থাগার ও লেখক' বিষয়ে কথা বলার প্রায় দেড় বছর পর ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে তানজানিয়ার মশি শহরে অবস্থিত কিলিমাঞ্জারো গ্রন্থাগারের আমন্ত্রণে সেদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের তরুণদের লেখালেখি বিষয়ে কর্মশালা পরিচালনার সুযোগ হয়েছিল। এই কর্মশালায় আমার সঙ্গে অন্যান্যদের মধ্যে কেনিয়ার কিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার শিক্ষক এবং কবি ক্রিস্টোফার ওকেমওয়া যোগ দিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক সূচকে খুব একটা ভালো অবস্থানে না থাকলেও, নানা সংকটের পরও সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পিছিয়ে নেই আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া। এবার তানজানিয়া অন্য একটি কারণে সারা দুনিয়ার পঠনপ্রিয় মানুষের কাছে আলোচিত বিষয়। ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত আব্দুলরাজাক গুরনার জন্ম এই দেশেই।
কিলিমাঞ্জারো তরুণদের সঙ্গে লেখালেখি বিষয়ক কর্মশালায় সুইডেন থেকে অনলাইনে যোগ দিয়েছিলেন নানা বয়সের একদল লেখক। এই কর্মশালায় কিলিমাঞ্জারোর তরুণদের কেউই ইতিপূর্বে সৃজনশীল লেখালেখির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও বই পড়ার বিষয়ে তাদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। তাদের কাছ থেকে আমি কয়েকটি জিনিস জানার এবং শেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। এর একটি হলো ওই দেশের আধুনিক উদার প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক লেখক শাবান রবার্ট (১৯০৯–১৯৬২) সম্পর্কে জানা। তরুণরা প্রায় সকলেই তাদের নিজ নিজ লেখা পাঠের পাশাপাশি এক একজন শাবান রবার্ট এর একেকটি বই থেকে পড়েছেন।
শাবান রবার্ট এর জন্ম তানজানিয়ার টাঙা শহরে জার্মান ঔপনিবেশিক শাসনামলে ১৯০৯ সালে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এক কর্মকর্তার অনুরোধে তার মা–বাবা তাদের ছেলের মুসলিম নাম শাবান এর সঙ্গে ক্রিস্টিয়ান নাম রবার্ট যোগ করেন। তার নামের মতোই কথা ও কাজে শাবান রবার্ট উদার অসাম্প্রদায়িক আধুনিক চিন্তাধারার এক বুদ্ধিজীবী লেখক ও কবি। তিনি ওই দেশের জাতীয় কবি এবং সোয়াহিলি সাহিত্যের জনক। তার লেখাজোকা স্কুল পর্যায়ে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্যসূচির অংশ। দেশটির স্থপতি জুলিয়াস নিয়েরেরে তার অবদানকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করেছেন।
তরুণরা এই কর্মশালায় এতটা উদ্দীপ্ত হয়েছেন, এরপর তারা পঠন এবং লেখালেখি বিষয়ে অন্য তরুণদের জন্যে শুভেচ্ছা দূতের ভূমিকা পালন করছেন। তারা এখন নিজেদের স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে অন্যান্য স্কুলে যাচ্ছেন এবং শিক্ষার্থীদের বই পড়া এবং লেখালেখির প্রতি উৎসাহ জোগাচ্ছেন।
এখানে আমার প্রশ্ন আমাদের গ্রন্থাগারগুলো কি এই মহামারী সময়ে এরকম কোনো উদ্যোগ নিতে পেরেছিল বা নিয়েছিল? প্রকারান্তরে সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পারলাম দেশের বড় বড় জেলাশহরের বেশ কয়েকটি পুরোনো গণগ্রন্থাগার বন্ধ রয়েছে কিংবা সংস্কারের অভাবে অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। খোদ ঢাকা শহরের পুরোনো কয়েকটি লাইব্রেরির অবস্থাও তথৈবচ। আমাদের দেশের মফস্বল শহরের মহল্লাভিত্তিক লাইব্রেরিগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এবার প্রথম ঘটনা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। শুধু বিদেশ বিভুঁইয়ে কেন বাঙালি কি এখন আর নিজ দেশেই খুব একটা পড়ুয়া জাতি? বাঙালি এখন লিখুনে জাতি। পড়ুক আর না পড়ুক সবাই এখন লেখক, কেউ পত্রিকায় লিখে, ব্লগে লিখে, সামাজিক মাধ্যমে লিখে, বই প্রকাশ করে, লিখে পুরস্কার জিতে। তাদের পড়ার সময়ের বড়োই অভাব, তাদের লেখার এতো এতো বিষয়। এমন পরিবারও আছে যেখানে বাবা লেখক, চাচা লেখক, মা লেখক, দাদা লেখক, দাদি লেখক, নিজেও লেখক- সবাই লেখক। পরিবারেই ডজন ডজন লেখক। এখন রয়েছে, আমলা, কামলা, বেকার, সেনা, অধ্যাপক, পুলিশ, ঠিকাদার, উকিল, মুক্তার, ব্যারিস্টার, মাস্টার, চৌকিদার–দফাদার, উজির–নাজির, মন্ত্রী, মন্ত্রীর পাইক–পেয়াদা সকলে সব ধরনের লেখক। যে কারণে বইমেলায় হাজার হাজার বই প্রকাশ হয় প্রতিবছর।
খটকা হলো আমাদের চতুর্দিকে এতো এতো লেখক থাকার পরেও আমাদের বাংলা ভাষা ব্যবহারের যে ছিরি আমরা দেখি আর বই বিপণনের যে চিত্র আমাদের সামনে উপস্থিত তাতে তো হিসেব মিলে না। আমাদের প্রায় সকলের আছে, নিজের কথা বলার ও লেখার অদম্য দুর্বার তাগিদ। এর বিপরীতে শোনার এবং পড়ার ব্যাপারে নিদারুণ এক জাতিগত অনীহা। অনীহার এই চিত্র কেবল কি মালয়েশিয়া বা ইউরোপের বাঙালির বেলায়? নিজ দেশেও কি একই রকম না? আমরা যেসব বাঙালি আদমিরা মালয়েশিতে বা মধ্যপ্রাচ্যে বা ইউরোপ কিংবা চীন বা মার্কিন মুল্লুকে যাই বা থাকি, আমরা কি নিজ দেশে থাকা অবস্থায় গড়পরতায় গ্রন্থাগারের ব্যাপারে বা নিজ ভাষায় বই পড়ার বিষয়ে কী এমন দৃষ্টান্ত দেখিয়েছি বা কী এমন সুযোগ বা অভ্যাস আমরা গড়ে তুলেছি?
এই পর্যায়ে আমাদের জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি নিয়ে কয়েকটি কথা বলে নিতে চাই। ২০০০ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উদ্যোগে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে প্রধান করে একটি জাতীয় গ্রন্থাগার প্রণয়ন কমিটি করা হয়েছিল। এই কমিটি চমৎকার আধুনিক একটি গ্রন্থাগার নীতি প্রণয়ন করেছিল। পরে সেটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় হয়ে মন্ত্রিসভা কর্তৃক সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়েছিল। ১৯টি ধারা সম্বলিত খুব সংক্ষিপ্ত আকারের কিন্তু অর্থবহ সময়োপযোগী জাতীয় গ্রন্থাগার নীতির মধ্যে অনেক চমৎকার প্রস্তাব ছিল। তার কয়েকটি ধারা আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই।
নীতি দুই: গণগ্রন্থাগার নেটওয়ার্ক ক্রমান্বয়ে গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা, যাতে যে কোনো নাগরিক তার বাসস্থানের এক মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে একটি গণগ্রন্থাগার বা তার একটি শাখা কিংবা একটি চলমান শাখা থেকে গ্রন্থাগার পরিষেবা পেতে পারেন। পাশাপাশি সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগের মধ্যে পারষ্পরিক তথ্য বিনিময়ের লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় গ্রন্থাগার নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা চালু করা।
নীতি ছয়: দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়/মহাবিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় আবশ্যিকভাবে গ্রন্থাগার সেবা নিশ্চিত করা।
পরিতাপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, দুই দশকের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এই গ্রন্থাগার নীতি বাস্তবায়নের তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। উপজেলা পর্যায়েই গণগ্রন্থাগার নেই। অনেক স্কুল কলেজ গ্রন্থাগার সেবা নিশ্চিত করা হয়নি। সেখানে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত গ্রন্থাগার সেবা কবে পৌঁছাবে? গ্রন্থাগার নীতি বাস্তবায়ন হলে জাতির চেহারা চরিত্র আমূল পাল্টে যেতে পারতো। ধর্মীয় মৌলবাদের মতো অতিমারী জাতীয় যন্ত্রণা থেকে দেশ ও জাতি রেহাই পেতে পারতো। এখন সময় এসেছে বিদ্যমান এই গ্রন্থনীতিকে ভিত্তি করে নতুন যুগোপযোগী গ্রন্থনীতি প্রণয়ন করার।
বিশেষ করে সারাদেশের ডাকঘরগুলোকে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয়ে গ্রন্থাগার সেবার নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া।
তথ্যপ্রযুক্তির যে চিত্র ২০০০ সালে ছিল তা আমাদের দেশে দুই দশক পরে এসে আমূল পাল্টে গেছে। একই সঙ্গে অন্যান্য গণতান্ত্রিক বিশ্বের জনকল্যাণমুখী অর্থনীতির দেশে বিরাজমান গ্রন্থাগার নীতির সঙ্গে আমাদের নীতির তুলনামূলক চিত্র আমরা ঝালিয়ে নিতে পারি, বিশেষ করে উত্তর মেরু অঞ্চলের দেশগুলোর গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা থেকে আমরা অনেকটা ধারণা নিতে পারি। তার কিছুটা দৃষ্টান্ত আমাদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গ্রন্থাগার কার্যক্রমের মধ্যে খেয়াল করা যায়।
এবার জাতীয় গ্রন্থনীতি বিষয়ে আলোকপাত করা দরকার। বিগত শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরুর দিকে আমাদের একটি জাতীয় গ্রন্থনীতি প্রণীত হয়েছিল। ২০১১ সালে গ্রন্থনীতিটি পরিমার্জন, সংশোধন আর যুগোপযোগী করার উদ্দেশে সরকারের তরফ থেকে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর নিমিত্তে ইতিহাসের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি জাতীয় গ্রন্থনীতি প্রণয়ন কমিটি করা হয়। কমিটি ২০১৫ সালে গ্রন্থনীতির খসড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেল এ খসড়ায় অনেক ভালো ভালো কথা এবং প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ করার মতো একটি হচ্ছে, 'গ্রন্থ উন্নয়ন পরিষদ'। কিন্তু বেদনার বিষয় হচ্ছে গত অর্ধ যুগেও সেই খসড়া গ্রন্থনীতি আলোর মুখ দেখেনি। এর দায় খোদ সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এবং সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এড়াতে পারেন না।
গণতন্ত্রে বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রে নূন্যতম জবাবদিহিতা থাকা দরকার। আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই জবাবদিহিতা আরো বেশি বেশি সঙ্গত।
এবার বইমেলা প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা যায়। সংশ্লিষ্টদের একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বাংলা একাডেমিকে বইমেলার মতো একটি অনুষ্ঠান আয়োজন থেকে রেহাই দিতে হবে। একাডেমির আরও অনেক আবশ্যক কাজ রয়েছে। বইমেলা আয়োজনের জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, প্রকাশক সমিতি আর সরকারের প্রণোদনায় স্বতন্ত্র একটি সংস্থা বা কমিটি বা কোম্পানি করে দিয়ে বইমেলাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব। সেই ক্ষেত্রে আমাদের বইয়ের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজার প্রসারিত হবে, অনুবাদের ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে। বাংলা একাডেমি বরং বইমেলা চলাকালীন সেমিনার, অনুষ্ঠান আয়োজনের মতো কাজগুলো আরো যুগোপযোগী করার ফুরসৎ পেতে পারে। বইমেলাটিকে যদি আমরা 'একুশে গ্রন্থমেলা' বলি তাহলে এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে দ্বিধা কেন? ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলে আহ্লাদিত হবো, অন্যদিকে এর তাৎপর্যের উপর ভিত্তি করে আয়োজিত বইমেলাকে নিজেদের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবো, এটা কেমন কথা?
এবার খোদ লেখকদের বিষয়ে কথা বলা যায়। এ সময়ের মতো নড়নচড়নহীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর লেখক সমাজ কোনো দেশে আছে কি না আমি জানি না। তার একটা দৃষ্টান্ত, প্রায় একযুগ ধরে বাংলা একাডেমি পরিচালিত হচ্ছে সাধারণ পরিষদ থেকে একাডেমির সদস্যদের প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যতিরেকে। এই নিয়ে কোনো লেখকের কোনো রা নাই। এর মধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লেখালেখিতে আসা তরুণরা নানাভাবে নিগৃহীত এবং উপেক্ষিত। লেখালেখিতে আসা তরুণ লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, অনুবাদক এবং প্রকাশকদের জন্যে নূন্যতম উল্লেখ করার মতো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে থেকে কোনো বৃত্তি, প্রণোদনা বা উৎসাহব্যঞ্জক দৃশ্যত কোনো উদ্যোগ নাই।
বাংলাদেশের প্রায় সব পুরস্কার নিয়েই অসমর্থিত নানা সূত্রে অনেক নেতিবাচক কথা শোনা যায়। সেই দিক থেকে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত সাহিত্য পুরস্কারও মুক্ত নয়। এক সময়ে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের লেখাজোকার প্রতি পাঠকদের আগ্রহ চোখে পড়তো। এখন কারো কারো পুরস্কারে বিরক্তি উদ্রেক হওয়াটাও অসঙ্গত নয়। এই কালিমা থেকে মুক্ত হবার জন্যে পুরস্কার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা দরকার। বিশেষ করে যাদের নাম চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে মনোনয়ন আকারে জমা হয়, সেই তালিকা প্রকাশ করা দরকার। সেই তালিকা থেকে যাদেরকে পুরস্কারের জন্যে নির্বাচিত করা হয় সে সম্পর্কে স্পষ্ট বিবৃতি থাকতে হবে পুরস্কার কমিটির পক্ষ থেকে।
পুরস্কার দেওয়ার কাঠামোও পুনর্গঠন করা যায়। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের জন্যে পুরস্কার পাবার পর ধারাবাহিক বক্তৃতার আয়োজন করা যেতে পারে এবং পাঠকদের সঙ্গে সংলাপের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আর পুরস্কারের যে অর্থমূল্য তা নিতান্তই কম। এই বিষয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী কয়েক বছর আগে একাডেমিতে বইমেলা উদ্বোধনের সময় প্রদত্ত বক্তৃতায় আহ্বান জানিয়েছিলেন পুরস্কারের অর্থমূল্য বাড়াতে। একাডেমি কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত সেই আহ্বানে সাড়া দিতে পারেননি।
একাডেমির পক্ষে এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তরফে লেখালেখি জগতের তরুণদের জন্যে দৃশ্যমান উদ্যোগ থাকা আবশ্যক। বিশেষ করে স্বাধীনতার অর্ধশতকে এটি বড় বেশি সঙ্গত বিষয়। আমাদের ভাষা, সাহিত্য, অনুবাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের যুগোপযোগী বিকাশের নিমিত্তে কতগুলো পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে লেখাটি শেষ করতে চাই:
১. জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি ২০০০–র বাস্তবায়ন
২. প্রস্তাবিত জাতীয় গ্রন্থনীতি ২০১৫–কে সিদ্ধান্ত আকারে প্রকাশ এবং বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া
৩. বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্টেকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং ট্রাস্টের অধীনে স্বতন্ত্র লেখক তহবিল গঠন করা
৪. জাতীয় অনুবাদ নীতি প্রণয়ন এবং উচ্চশিক্ষায় অনুবাদবিদ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করা, একই সঙ্গে অনুবাদ একাডেমি/প্রতিষ্ঠান চালু করা
৫. লেখালেখি অনুবাদ সম্পাদনা আর প্রকাশনায় তরুণদের জন্যে স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবিধ বৃত্তি চালু করা
৬. বিভিন্ন জাতীয় প্লাটফর্মে কেবল বয়স্কদের নয়, তরুণদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। অনেক কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে তরুণরা নেতৃত্বের জায়গায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিবের বয়স চল্লিশের কোটায়। পেশাজীবী সংগঠন/পরিষদগুলোর নেতৃত্বে যারা তাদের বড় একটা অংশের বয়স তিরিশের কোটায়। সাহিত্য পুরস্কার আর বৃত্তির ক্ষেত্রেও একই চিত্র দৃশ্যমান।
৭. স্থানীয় সরকারের নানা ইউনিট বিশেষ করে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা এবং জেলা পরিষদকেও গ্রন্থ, গ্রন্থাকার গ্রন্থাগারসহ পাঠাভ্যাস বিস্তৃতির প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা এবং দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া।
৮. ঢাকাকে ইউনেস্কো সাহিত্য নগরীর মর্যাদায় উন্নীত করার জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৯. সর্বোপরি বিএনপি–জামাত সরকারের সময় প্রণীত সংস্কৃতি নীতি ২০০৬ থেকে –বেরিয়ে এসে যুগোপযোগী একটি সংস্কৃতি নীতি প্রণয়ন করা।