পরাণ হু হু করা বসন্তের হাওয়া প্রকৃতিতে দিয়েছে দোলা। চারদিকে চোখ মেলে তাকালেই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, হৃদয় রাঙানিয়া বসন্ত এসে গেছে। বসন্ত মানে সজীবতা, বসন্ত মানে প্রাণের টান। বসন্ত মানে জীবনের ধূসরতা একটু আড়াল করে পুষ্পের ন্যায় প্রস্ফুটিত হওয়া। বসন্ত মানেই কোকিলের ডাক, মন আনচান। বসন্ত মানে প্রেম, বসন্ত মানে উদাস হাওয়া।
আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিলো নেশা
বসন্তে আগুন সাজে প্রকৃতিকন্যা, পৃথিবীর সব ফুল তার অনুষঙ্গ। এ যেন ফুলেল সময়! প্রকৃতিতে শিমূল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়ার বর্ণিল সাজ। তরুণীদের ফুলসজ্জার রাজসিক চাল বলে দেয়, এ যেন প্রেমের সময়!
আবার বসন্ত মানে ঝরা পাতার হাহাকার, শূন্য গাছের বিষণ্ণতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছেন :
বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে।দেখিস নে কি শুক্নো-পাতা ঝরা-ফুলের খেলা রে।
আবার বসন্ত মানেই দ্রোহ, খুন রাঙা বিক্ষোভ। বসন্ত মানে অধিকার, বসন্তেই যে ভাষার আন্দোলন! ভাই হারানোর শোক সন্তানহারা মায়ের চোখের জল। হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন :
বাংলাদেশের শহর গ্রামে চরে
ফাগুন মাসে দুঃখী গোলাপ ফোটে
বুকের ভেতর শহিদ মিনার ওঠে।
বসন্ত মানেই ৮ ফাল্গুন, ২১ ফেব্রুয়ারি। বসন্ত মানেই 'মাথা নত না করা', দুর্জয় সাহসে ভর। বসন্ত মানে স্বাধীনতা। একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিন। বসন্ত মানে 'দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়'। বসন্ত মানে শেখ মুজিবুর রহমান। বসন্ত মানে কেউ আমাদের 'দাবায়ে' রাখতে পারবে না। বসন্ত মানে 'রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো-ইনশাল্লাহ'। বসন্ত মানে 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, একবার সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'।
ফাল্গুনের প্রথম দিন বসন্তের আবাহন করবে সব বয়সের মানুষ, নানা সাজে নানা আয়োজনে। জীবনকে রসময়, প্রেমময় করে তুলতে বাসন্তী সাজে, মাথায় ফুল গোঁজে। প্রিয় মানুষের গেরুয়া বরণে একাকার হবে তরুণীর যত্নের সাজ। তখন মনে হয়, কে বলেছে বয়স বাড়ছে বুড়ো পৃথিবীর! পৃথিবীটা চিরযৌবনা জীবনের, জীবনের কলহাস্য মুখর, প্রেমময়।
বসন্ত যেমন উচ্ছ্বলতা, উচ্ছাস, তেমনি বসন্ত আবার বেদনা-হাহাকারেরও শব্দধ্বনি বাজায়। বসন্তে প্রকৃতি শুধু কোমল নয়, কঠোরও হয়। বসন্তই কখনো কখনো ডেকে আনে অকাল বৈশাখ, বৈশাখী ঝড়। তবু বসন্ত আরাধ্য, তাই বসন্তবন্দনা আমাদের প্রাণের গান। 'ফুল ফুটুক, আর না ফুটুক, আজ বসন্ত।
১৪ ফেব্রুয়ারি কবে থেকে আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবস হলো? কে আমাদের দেশে ভ্যালেনটাইন ডে আমদানি করলেন? আমরা তো আমাদের ছাত্রবেলায় ভ্যালেনটাইন ডে কিংবা ভালোবাসা দিবস পালন করিনি, শুনিও নি যে শুধু বছরের একদিন ঘটা করে ভালোবাসা দিবস পালন করে বাকি ৩৬৪ দিন থাকতে হবে ভালোবাসাহীন!
এখন যেন সব কিছুতেই কেমন আদিখ্যেতা। ভালোবাসা নিয়েও। আমরা দিন দিন হৃদয়হীন হচ্ছি, আর আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হচ্ছি। বাইরে ভালোবাসার রঙিন সাজ, ভেতরে হিংসার বাস। মানবিকতা কমছে, দানবিকতা বাড়ছে, আর বাড়ছে কপটতা। হৃদয়ে বিদ্বেষ-বিষ পুষে কী কাউকে ভালোবাসা যায়?
একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ১৯৭৫ সাল। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছেন। ছাত্র ইউনিয়ন- ছাত্রলীগ সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় ছাত্রলীগ। ঠিক হলো, একটি নির্দিষ্ট দিন আমরা ফুল দিয়ে আমাদের শিক্ষকদের সম্মান জানাবো, শ্রদ্ধা নিবেদন করবো।
আমি নির্দিষ্ট দিনে যথারীতি একটি গোলাপ নিয়ে গেলাম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. আহমদ শরীফের কক্ষে। তার হাতে ফুল দিতেই জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী? হঠাৎ ফুল কেন? আজ তো আমার জন্মদিন নয়।
আমি কাচুমাচু করে ঘটনা বললাম।
স্যার কিছুটা বিদ্রূপ করে বললেন, বছরে একদিন শ্রদ্ধা-সম্মান, অন্যদিনগুলোতে কী অশ্রদ্ধা-অসম্মান? স্যারের কথার কোনও জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়ে এসেছিলাম।
সারা বছর ভালোবাসাহীন থাকার জন্যই কি ১৪ ফেব্রুয়ারি লোকদেখানো ভালোবাসার এই বাণিজ্যিক আয়োজন?
অথচ আমরা সম্ভবত ভুলে গেছি যে, ১৯৮৩ সালের এই দিন স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে দেশের কয়জন সোনার ছেলে-মেয়ে জীবন দিয়েছিলেন। জাফর-জয়নাল-দীপালি-কাঞ্চনদের বুকের খুনে রাঙা ১৪ ফেব্রুয়ারিতে আমরা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদদের প্রতি ভালোবাসা না জানিয়ে, শ্রদ্ধা না জানিয়ে, নমিত না হয়ে ভ্যালেনটাইন ডে-র উৎকট আনন্দে মাতি!
আমরা কি আসলে সত্যি কাউকে ভালোবাসি? আমরা কি আমাদের দেশকে ভালোবাসি? আমরা কি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ভালোবাসি? আমরা কি আমাদের নিজেকে ভালোবাসি?
নাকি আমরা করি ভালোবাসার অর্থহীন অভিনয়। আমরা কি আমাদের কেউ মাতাতে চাইলেই মেতে উঠবো, চেতাতে চাইলেই চেতে উঠবো? আমরা কি আমাদের নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যকে চিনতে পারবো না? আমরা অন্যের দোলায় দুলে কত কি যে থাকি ভুলে! তাই কি আমাদের ভালোবাসা 'কেবলই যাতনাময়'।