Published : 06 Feb 2022, 05:47 PM
ডাক্তারের কাছে গিয়েছে এক লোক। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার বললেন রক্ত এবং পেশাব দুটোতেই আপনার ডায়াবেটিস পজেটিভ। পেশাবে সুগারের মাত্রাও অনেক বেশি। লোকটা পরীক্ষার জন্য যে পেশাবের বোতল নিয়ে গিয়েছিল সেটা ফেরত নিয়ে এসে বউয়ের সামনে রেখে বলল, ডাক্তার বলেছেন আমার পেশাবে সুগারের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই বোতলটা নিয়ে এলাম। চিনির দাম যা বেড়েছে তাতে চায়ের সাথে এটাকেই ব্যবহার করতে পারো!
সবকিছু 'বাড়া' নাকি ভালো না। ধরুন আপনি ভিক্ষুককে ভিক্ষা দিতে চাচ্ছেন না। বললেন, 'সামনে বাড়েন'। ভিক্ষুক কিন্তু বলতে পারে সামনে বাড়তে বাড়তে কি বঙ্গোপসাগরে পইরা যাইতে বলেন? ধরুন আপনার বাড়ির পুরোনো দেয়ালে পাখির কল্যাণে এক পাকুর গাছের জন্ম হলো। গাছ যত বাড়বে দেয়াল তত দুর্বল হবে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে নাকি টাকার মান কমে! আগে যে টাকা দিয়ে জিনিস কিনতেন তার চেয়ে বেশি টাকা লাগবে ওই একই জিনিস কিনতে। জিম্বাবুয়েতে এক ব্যাগ টাকা লাগে একটা বার্গার কিনতে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে একটা 'বিশাল' কবিতার লাইন এমন, 'মুদ্রাস্ফীতির মেদ জমে/বাড়ে মানচিত্রের ঋণ/ তোমার ঠোটের তিলে জমে আছে/ নাবিকের নিকোটিন!'
অবশ্য একই জিনিসের দাম ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন রকম। যেমন কফি। ফুটপাতের দোকানে হয়তো এটা বিশ-ত্রিশ টাকা। কোথাও কোথাও আশি থেকে একশ টাকা। ফাইভ স্টার হোটেলে পাঁচশ টাকার বেশি। তাই কৌতুকও ছড়িয়ে পড়ে এমন, এক ইঞ্জিনিয়ার এসেছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা খেতে। দোকানে বিস্কিট, চিপসের সাথে কলা ঝোলানো আছে। ইঞ্জিনিয়ার জানতে চাইল কলার দাম কত? দোকানি বলল, কোথায় ব্যবহার করবেন তার ওপর নির্ভর করে দাম। ইঞ্জিনিয়ারের অবাক হওয়া দেখে দোকানি বলল, কোনও মিলাদ বা ধর্মীয় কাজে নিলে দুই টাকা, হাসপাতালের রোগীর জন্য নিলে তিন টাকা আর নিজের জন্য নিলে পাঁচ টাকা। ইঞ্জিনিয়ার খানিকটা রেগে জানতে চাইল, একই জিনিসের দাম তিন জায়গায় তিনরকম হবে কেন? দোকানি উত্তর দিল, আমার বাসায় বিদ্যুতের দাম যা এই মুদি দোকানে তার চেয়ে বেশি। কমার্শিয়াল প্লেস বা অফিসে নাকি আরও বেশি। কারখানায় নাকি তারও বেশি। বিদ্যুৎের দাম যদি তিন চার জায়গায় তিন চার রকম হয় তাহলে কলার দাম তিন চার রকম হইলে দোষ কোথায়?
কিছু কিছু জিনিসের দাম বাড়া দোষের না বরং কিছু জিনিসের দাম বাড়লে নাকি ভালো লাগে বা দেশ উপকৃত হয়! যেমন প্রতিবছর নিকোটিন বা সিগারেট আর মদের দাম বাড়ে। এসবের দাম বাড়লে কেউ সমালোচনা করে না বরং কেউ কেউ বলে থাকেন সরকার আগের চেয়ে বেশি রাজস্ব পাবে। বেতন বাড়লেও ভালো লাগে সবার। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। বাংলাদেশে একবার দাম বাড়লে আর নাকি কমে না। স্নেহ ও জল শুধু নিম্নগামী। মূল্যবৃদ্ধি সবসময় আকাশ ছোঁয়া।
আকাশ ছোঁয়া একটা জিনিস নাকি মানুষের খুবই পছন্দের। সেটা হচ্ছে ভালোবাসা। এদেশে ছবির নাম আছে, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা। মানুষ ভালোবাসাকে আকাশে তুলতে চায় আর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নামিয়ে আনতে চায় মাটিতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লেও প্রান্তিক কৃষকের কোনও লাভ হয় না। তারা যে তিমিরে ছিল সেখানেই থেকে যায়। টমেটো বা আলুর দাম না পেলে কৃষকদের তা রাস্তায় ফেলে প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়। ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক একবার ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'ইরানের তেল মাটির নীচ থেকে তুলে আমরা যদি আমাদের স্বার্থমতো বিক্রি করতে না পারি তাহলে আমাদের তেল মাটির নীচেই থাকবে'। সরিষা, আলু, পটল, ফুলকপিসহ সব সবজিরা কী তাহলে গাছেই থাকবে? নাকি দাম বাড়ানো চক্র বা সিন্ডিকেটের কল্যাণে এসবের দাম আকাশ ছোঁয়া হলেও কৃষকের তাতে কিছু যাবে আসবে না।
তেল, গ্যাস আর বিদ্যুৎের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের যায়-আসে! তারা নিজেদের সীমাহীন অসহায় ভাবে। তাদের অবস্থার জন্য তারা অভিশাপ দেয়, পরিবারের কর্তাব্যক্তি অপমানিত বোধ করেন। করোনা কালে মানুষের আয় কিংবা বেতন বাড়েনি। বাড়েনি কর্মসংস্থান বরং কমেছে অনেক। গত দুই বছরে (২০২০-২১) কতবার বেড়েছে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম? সাধারণ মানুষের এই অসাধারণ দুঃখ সইবার ক্ষমতা কি আছে?
খুব সাধারণ মানুষ তবু স্বপ্ন দেখে। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম তাদের ক্রয় ক্ষমতার ভেতরে থাকবে, বাইরে যাবে না। কিন্তু দুঃস্বপ্ন জীবনভর। স্বপ্নের মতো এসবের দাম সাধারণের সাধ্যের বাইরেই থাকে। কবি ওমর আলী লিখেছিলেন, 'এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি'। ভবিষ্যতে কেউ হয়তো এটার অনুকরণে লিখবেন, এদেশে দাম না কমার রেওয়াজ শুনেছি। অথবা লেখা হবে এভাবে, এদেশে দাম যারে খায় কুড়ে কুড়ে খায়…সাধারণেরা চিরকালই অন্যের খাওয়া বা শোষণের আওতার ভেতর বসবাস করতে বাধ্য হন। এরা দুর্বা ঘাস। দুই হাতি যখন যুদ্ধ করে তখনও পদদলিত হয়, দুই হাতি যখন রমন করে তখনও পদদলিত হয়। কবিতার ভাষায়, 'মানতে মানতে জীবন এখন পায়ের নীচের পাপস'!
কী আর করা? সাধারণেরা মেনে নিয়েছে দুর্ভাগ্যকেই। এদের নামেই রাজনীতি হয়। বলা হয়ে থাকে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। সম্ভবত এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিথ্যা! আমরা সত্য কথা শুনে মুখবন্ধ রেখে বিদায় নি-ই। আবুল নামের এক ছেলে স্কুলে পড়ে। সে স্কুল থেকে ফিরে বলল, বাবা কাল থেকে আমরা বড়লোক হয়ে যাব। অনেক টাকা হবে আমাদের। বাবা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, কীভাবে? আবুল বলল, বাবা অংকের স্যার কাল আমাদের শেখাবেন পয়সা থেকে কীভাবে টাকা বানাতে হয়! বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আবুল কাল বাসা থেকে বের হবার সময় মানিকের মুদি দোকান হয়ে যাবি। দেখবি সেখানে একটা নোটিশ বোর্ডে কী লেখা আছে। আবুল পরদিন স্কুলে যাবার সময় মানিকের মুদি দোকানে যেয়ে দেখল নোটিশ বোর্ডে লেখা, আজ নগদ কাল বাকী। আবুল বুঝল না এই লেখার মানে কী?
সাধারণেরা না বুঝলেই ভালো। আর ভালো মুখ বন্ধ রাখা। কথায় আছে না বোবার শত্রু নেই। এদেশে নেতারা বহুদিন ধরে ভোটার বা জনগণকে পান দিয়ে আপ্যায়ন করেন। কারণ, পান খাওয়ার সময় মুখ বন্ধ থাকে। মুখ বন্ধ রাখার আরও গল্প আছে।
এক মহিলা পীর বাবার কাছে গিয়ে কেঁদে কেটে বলল, আমি আত্মহত্যা করব। স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না। আমাকে সারাদিন মারে। শাস্তি দেয়। সময় মতো খেতে দেয় না। কাপড় চোপড় ধুতে হয়, ঘর মুছতে হয়। সে আমার কাছে… কথা শেষ করতে দিলেন না পীর সাহেব। থামিয়ে দিয়ে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। তাবিজ দিয়ে দিচ্ছি। এটা হাত বা গলায় পরা যাবে না। দাঁত দিয়ে চেপে রাখতে হবে। তাবিজ নিয়ে চলে গেলেন মহিলা। দশদিন পরে ফিরলেন পীরের কাছে মিষ্টি আর ফুল নিয়ে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, পীর সাহেব আপনার তাবিজের কেরামতিতে আমার স্বামী ভালো হয়ে গেছে। এখন আর গায়ে হাত তোলে না। শাস্তি দেয় না… পীর সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার তাবিজের কেরামতি না। কেরামতি আপনার মুখের যেটা তাবিজ দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আপনি তাবিজটা দয়া করে এখনই দাঁত দিয়ে চেপে ধরুন। মুখ বন্ধ রাখুন।
দাঁতে দাঁত চেপে মুখ বন্ধ রাখুক সাধারণেরা! আপনারা কী বলেন?