Published : 05 Feb 2022, 11:33 PM
বাংলাদেশের রাজনীতিতে উল্টোস্রোতে জীবন কাটানো এক ভাগ্য বিড়ম্বিত জননায়ক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। রাজনীতিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উত্থান যেমন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তেমনি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও তার লড়াকু জীবনের ইতি টানতে হয়েছে চরম প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে। ষাটের দশকের আন্দোলন,সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ,যেমন চরম প্রতিক্রিয়াশীল অপরাজনীতি মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত চেহারা নিয়ে। তেমনি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ধর্মান্ধতা, কুপমুন্ডকতা আর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে রাজনীতি করতে হয়েছে ভগ্ন হৃদয়ে। বাংলাদেশের উন্মেষ, বিকাশ ও প্রতিবন্ধকতার রাজনীতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনীতির ঘাত প্রতিঘাতের যথাযথ চিত্র ফুটে উঠে আপন মহিমায়। তার রাজনীতির জীবনপ্রবাহ বাংলাদেশের রাজনীতির যেন এক রূপান্তরের চিত্র।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির এক কিংবদন্তি পুরুষ। স্বাধিকার, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের উন্মেষ ও বিকাশে গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সবসময় ছিলেন সামনের কাতারে। ভাটিবাংলার অবিসংবাদিত এই নেতা ছিলেন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনীতির এক নির্ভীক কণ্ঠ।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৫ সালের ৫ মে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিতের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থি রাজনীতির মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক জাতীয় নির্বাচনে এমপিএ নির্বাচিত হয়ে তার জনপ্রতিনিধিত্বকালের শুরু। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে তিনি সাত বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এই সাতবারের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সময় আর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রবাহে তিনি যে এক সফল প্রতিশ্রুতিশীল প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ তা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত। মন্ত্রিসভার সদস্য, মন্ত্রী মর্যাদার পদ-পদবী ধারণ করলেও তিনি যেন এক ভাগ্য বিড়ম্বিত জননেতা। ক্ষমতার সান্নিধ্যের চেয়ে জনতার জাগরণেই তিনি ছিলেন প্রানবন্ত,স্বতস্ফূর্ত। তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় সংসদের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আপন যোগ্যতায়,স্বভাবসুলভ স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়ে স্পষ্টবাদী এ রাজনীতিবিদ আলো ছড়িয়েছেন সকল কালিমা আর ষড়যন্ত্রকারিদের চক্রান্ত নস্যাত করে। নির্বাচনী এলাকার জনগণই ছিল সংগ্রামী এ রাজনীতিবিদের সাহস আর দৃপ্ত প্রত্যয়ে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে কিছুদিন আইন পেশায়ও যুক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) বিভক্ত হলে তিনি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন অংশে যোগ দেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে ন্যাপ থেকে জয়ী হয়ে দেশবাসীকে তাক লাগিয়ে দেন তরুণ এ রাজনীতিক। তিনি ছিলের গণতন্ত্রী পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন।
পঞ্চম সংসদের সদস্য থাকাকালেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দিরাই-শাল্লা আসনে সামান্য ভোটে হেরে গেলেও পরে হবিগঞ্জের একটি আসনে উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান। এসময় সংবিধান সংশোধনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি নবগঠিত রেল মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এক বছরের মাথায় ব্যক্তিগত সহকারীর দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করায় ওই সরকারের শেষ মেয়াদ পর্যন্ত দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বদ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ৭১ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । পরেরদিন ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জে তার মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জন্মস্থান দিরাইয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বভাবসুলভ রসবোধ আর যুক্তিপূর্ণ বাগ্মিতায় তিনি পৌঁছেছিলেন অনন্য উচ্চতায়। তিনি ছিলেন সত্যিকারের মাটি ও মানুষের নেতা। মানুষের মনের ভাষা তিনি পড়তে পারতেন। মানুষকে উজ্জীবিত করাই ছিল যেন তার প্রশান্তি। রাজনৈতিক সকল সংকটে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ছুটে যেতেন। মানুষের সমর্থন নিয়ে তিনি প্রথাবিরোধী হুংকার দিতেন আপন মহিমায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরের যোদ্ধা এবং সংগঠক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ৫ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার। বাঙালি জাতীয়তাবাদ , অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন একজন পড়াশোনা করা রাজনীতিবিদ। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এই নন্দিত পার্লামেন্টারিয়ানের সাহিত্য,সংস্কৃতির প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। বক্তব্য,বিবৃতিতে তিনি প্রায়ই কবিতার পঙক্তি ব্যবহার করতেন। সাধারণ মানুষের ভাষা রপ্ত করা,সাহিত্যের রসবোধ আর প্রখর মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জননেতা ছিলেন তিনি। তেজ ও নাটকীয়তায় ভরা বক্তব্যে তিনি জাতীয় সংসদ থেকে জনসভা সর্বত্র মুগ্ধতা ছড়াতেন। রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় নানা ষড়যন্ত্র আর উল্টোস্রোতে সাঁতার কেটে হয়ে উঠেছিলেন একজন সংগ্রামী। স্বভাবসুলভ বিপ্লবী। অমিত সাহস নিয়ে কথা বলতেন যুক্তিপূর্ণ মুক্তচিন্তায়। হাস্যরসাত্মকভাবে সহজ ভাষায় কঠিন আক্রমণ করতেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। শিল্পীত প্রকাশে ঘায়েল করতেন বিরোধীপক্ষকে।
সরকারি দল, বিরোধীদল সব অবস্থানেই তিনি মন্ত্রী,আমলাদের বিরুদ্ধে টিপ্পনি কাটতেন। অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কখা বলতেন। দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চায় তিনি উচ্চ কণ্ঠ। এজন্য তাকে কম মূল্য দিতে হয়নি। বিভিন্নভাবে অবমূল্যায়িত হলেও কষ্ট চেপে রাখতেন । রেলমন্ত্রী থাকাকালীন নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত সহকারীর আর্থিক কেলেংকারিতে তিনি আহত হয়েছিলেন। প্রশাসন ও মিডিয়ার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সংবাদ মাধ্যমে তাকে জড়িয়ে কাল্পনিক প্রতিবেদনে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় উচ্চারণ করেছেন। তদন্তের মাধ্যমে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে তিনি রাজনীতিতে ফিরে আসেন অমিত সাহসে। তবু যেন অনেকটা ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এরইমধ্যে ধীরে ধীরে অসুস্থতা কাবু করে ফেলে। তবুও অসুস্থ শরীরে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ব্যক্ত করেছেন আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব আর দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সংকট আর সম্ভাবনার কথা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এক অনন্য পুরুষ। তার জন্য অনেক পদের জন্ম হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা তার আগে কেউ ছিলেন না। দেশের প্রথম রেলমন্ত্রীও তিনি। প্রথম দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর মর্যাদাও তারই দখলে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন আজীবন রাজনীতির মাঠে আলো ছড়ানো তারকা। মাটি আর মানুষের কাছে থেকে রাজনীতি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জনবান্ধব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে। হাওরের কঠিন-কোমল প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা একজন সুরঞ্জিত বর্ণিল রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় উঠেছিলেন রাজনীতির বরপুত্র এবং ভাটি অঞ্চলের সিংহ পুরুষে। নিজস্ব ভাষা, ভঙ্গি আর স্বভাবসুলভ উচ্চারণে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি জননেতা । জাতীয় সংসদ, সংবাদ সম্মেলন, রাজনৈতিক জনসভায় তিনি কথা বললে জনতা হাসতেন, কাঁদতেন, জাগতেন। সজ্জন, সদালাপী ব্যক্তি সুরঞ্জিত ছিলেন সব দলমতের মানুষের কাছে সমান প্রিয়। আর ভাটি বাংলার মানুষের কাছে ছিলেন আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। বরেণ্য রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রয়োজনীয়তা যতদিন যাচ্ছে তত যেন আরও বাড়ছে। তার অনুপস্থিতি দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে তৈরি করেছে গভীর শূন্যতা। রাজনীতির কবি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। জয়তু জনতার নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।