Published : 05 Feb 2022, 02:08 PM
মানুষের মধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা আগেও ছিল। এটা ঘটত চুপিসারে। এখন মানুষ আত্মহত্যা করছেন ফেইসবুক লাইভে এসে, সবাইকে জানিয়ে। সর্বশেষ গত ১ ফেব্রুয়ারি আবু মহসিন খান নামে রাজধানীর একজন ব্যবসায়ী ফেইসবুক লাইভে এসে প্রায় ১৫ মিনিট কথা বলার পর নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
ঘটনাটি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। একটা মানুষ কেন এভাবে সবাইকে জানান দিয়ে আত্মঘাতী হতে চাইছে? কী এর পেছনের কারণ? এখন তো সব কিছুই মানুষ ফেইসবুকে দিয়ে দেখাতে চায়। একটা নেশার মতো। নিজের জন্মদিন, কী খাচ্ছেন, কোথাও ঘুরতে গিয়েছেন সবই ফেইসবুকে পোস্ট হচ্ছে। সেই অভ্যেসেরই আরও একটি দিক হয়তো এরকম লাইভ দেওয়া।
আবু মহসিন খান কেন আত্মঘাতী হলেন? তার ব্যবসায়ের সংকট ছিল, কিন্তু সেই অর্থে তিনি অস্বচ্ছল ছিলেন না। রাজধানীর ধানমন্ডির মতো এলাকায় বসবাস করতেন, তার লাইসেন্স করা পিস্তলও ছিল। তবু কেন তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন? হ্যাঁ, তিনি অবসাদে ভুগছিলেন। একাকীত্ব তার ওপর ভীষণভাবে চেপে বসেছিল। জীবনের কোথাও কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পুলিশও বলেছে, দীর্ঘদিনের একাকী জীবন, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই, ব্যবসায় লোকসান– সব কিছু মিলিয়ে চরম অবসাদগ্রস্ত হয়ে আবু মহসিন খান আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
শুধু তিনি নন, ২০২১ সালের অগাস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় মাসে আরো তিনজন ফেইসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন। গত বছরের ১৭ অগাস্ট মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের গয়ঘর এলাকায় সুমন নামের এক যুবক ফেইসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেন। তার এ মৃত্যুর জন্য তিনি কাউকে দায়ী করেননি।
গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে ফেইসবুক লাইভে এসে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন পুবাইলের স্বপন চন্দ্র দাস নামের এক ব্যবসায়ী। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর সবুজ সরকার নামে কুমিল্লার এক তরুণ সৌদি আরবে ফেইসবুক লাইভে এসে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এর বাইরেও প্রবীণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এদের বেশিরভাগই একা থাকেন অথবা পরিবারের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হন। গত বছরের ৩ জানুয়ারি রাজধানীর লালবাগের নিউ পল্টন এলাকার নিজ বাড়ি থেকে জুলহাস মুন্সি (৭০) নামের এক বৃদ্ধের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, জুলহাস ওই বাসায় একাই থাকতেন। নিঃসঙ্গ অবস্থায় খালি ঘরে তিনি আত্মহত্যা করেন। একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর বরগুনার পাথরঘাটায় পারিবারিক কলহে অভিমান করে মো. জয়নাল মাঝি (৫৫) নামের এক বয়স্ক লোক আত্মহত্যা করেন। ১৬ নভেম্বর রাজধানী বাড্ডার সাঁতারকূল রোডে আব্দুল বারেক হাওলাদার (৬৩) নামের এক বৃদ্ধ আত্মহত্যা করেন। এর আগে ১২ অক্টোবর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ইদ্রিস আলী (৭৫)। ১৭ সেপ্টেম্বর নাটোরের লালপুরে জলিল খামারু বিষ পানে আত্মহত্যা করেন। ৭ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের মাধবপুরে আবদুল জাহের মিয়া (৬৫) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
উল্লিখিত ঘটনাগুলো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, সেটা এখনও এক রহস্য। বিজ্ঞানীদের মতে, আত্মহত্যার ৭০ ভাগ কারণ হলো মনোরোগ। বিষণ্ণতা আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তাতে মানুষ অসহায়বোধ করে। জীবনের প্রতি তার কোনো মায়া থাকে না। বিষণ্ণতায় আত্মহত্যার হার বেশি। এ ছাড়া সিজোফ্রেনিয়া নামে একটি কঠিন মানসিক রোগ রয়েছে। তাতেও অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার ইচ্ছা জন্ম নেয়।
একাকিত্ব, আর্থিক সমস্যা এবং সমাজের নানাবিধ চাপে অবসাদে ভোগেন এরকম মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। মেধাবী ছেলে ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি, ব্যবসা ডুবেছে, প্রচুর দেনা হয়ে গিয়েছে, ভালো পড়াশোনা করা সত্ত্বেও যোগ্য ব্যক্তি তার উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছেন না বা কর্মক্ষেত্রে যথাযথ মর্যাদা বা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, ব্যক্তিগত জীবনে অপ্রাপ্তি, পারিবারিক অশান্তি চলছে– ইত্যাদি নানা কারণ থেকে মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ইদানীং বয়স্কদের মধ্যেও একাকিত্ব থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এমনও বহু মানুষ আছেন যাদের পরিবারে মানসিক সমস্যার থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। সেখান থেকেও কারণে অকারণে লোকজন আত্মহননের দিকে এগোয়।
শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাই নয়, সম্প্রতি করোনাভাইরাসের কারণেও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে দেশে দেশে। ভাইরাসটিকে নিয়ে ভীতি মানুষকে অসহায় করে তুলছে, কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন মানুষকে নিঃসঙ্গ করে তুলছে। নিজে আক্রান্ত হওয়া বা নিজের দেহ থেকে পরিবারের অন্যান্যদের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক, ঘরে থাকা, সামাজিক মেলামেশা কমে যাওয়া, একাকিত্ব এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, করোনার জন্য কাজ হারানো, ব্যবসায়ের ক্ষতি, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা– প্রভৃতি কারণে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা।
এর থেকে কাউকে বাঁচাতে প্রয়োজন মানসিকভাবে পরিবারের সদস্যদের একে অপরের খুব কাছে থাকা। প্রয়োজন নিয়মিত সবার খোঁজ খবর নেওয়া, বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করা, তথ্য বিনিময় করা, শিশুদের সঙ্গ দেওয়া, বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়ানো। আমাদের দেশে প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্য একেবারেই অবহেলিত। এর মূল কারণ হলো সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রবীণরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র– সবার দায় রয়েছে। তাদের প্রতি আমাদের আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
কিন্তু এই কাজগুলো আমরা করি না। মনের যত্ন বা মানসিক সুশ্রূষাকে আমাদের দেশের মানুষ খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। অথচ এটা এখন একটা বড় সমস্যা। এমনিতেই এখন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ক্ষুদ্র এককে পরিণত হয়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছে। অনেকের আবার এক বা দুইজন সন্তান। সন্তানরা বড় হয়ে বাইরের দেশে পাড়ি জমান। মা-বাবা একা হয়ে পড়েন। সিঙ্গেল মাদার বা ফাদারেরা চরম একাকীত্ব নিয়ে জীবন কাটান। দেশে নিঃসন্তান মানুষের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। তারা সব সময়ই একাকীত্বে ভোগেন।
আমাদের দেশের সমাজ বা রাষ্ট্র প্রবীণ মানুষদের কোনো দায়িত্ব নেয় না। তেমন আধুনিক কোনো ওল্ড হোম বা বয়স্ক নিবাস নেই। যেখানে প্রবীণেরা যত্ন পাবেন, চিকিৎসা পাবেন, ভালো খাবার পাবেন, নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে সময় কাটাতে পারবেন। আমাদের সমাজে 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ' বাড়লেও ভবিষ্যতের ভাবনা নেই। একটা মানুষ প্রবীণ বয়সে কী করবেন, কীভাবে সময় কাটাবেন– সেই চিন্তাটা নেই বললেই চলে। তাই তো এখানে ব্যক্তি উদ্যোগেও ভালো কোনো ওল্ডহোম গড়ে উঠছে না। সন্তানসন্ততিনির্ভর জীবনের বাইরে কেউ কিছু ভাবতে পারে না। তাই তো বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না। ওল্ড হোম বা বৃদ্ধনিবাস সম্পর্কে রয়েছে আমাদের দেশের মানুষের ভুল ধারণা। বৃটিশবিরোধী বিদ্রোহী ও বিপ্লবীদের দীর্ঘমেয়াদী সাজার জন্য যেমন আন্দামান পাঠিয়ে দেওয়া হতো, অনেকে মনে করেন যে, ওল্ডহোমে থাকা মানে যেন তেমন এক নির্বাসন। অথচ উন্নত বিশ্বে ওল্ড হোম মানে বয়সীদের নিশ্চিত ঠিকানা। যেখানে তারা পরিবারের চেয়েও ভালো থাকেন, আনন্দে থাকেন। ওল্ড হোম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের দেশের মানুষকে বের করে আনা দরকার।
আরেকটি কথা, জীবন হলো ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ উপহার। তাকে নিজে নিজে শেষ করে দেওয়াটা চরম বোকামি। দুঃখ, কষ্ট, সাফল্য, ব্যর্থতা, ঠকা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হওয়া– সব কিছু মিলিয়েই জীবন। এগুলোকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে হবে। নানা অপ্রাপ্তির মধ্যেও পছন্দের কাজ করে যেতে হবে। তার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। নিজেকে বলতে হবে, আমি ভালো থাকব। আমার জীবনটা নিতান্তই আমার। এই জীবনকে ভালো রাখা– একান্তভাবেই আমার কাজ। এটা বুঝতে হবে যে, আমার চারপাশে এ রকম অনেক মানুষ আছেন যারা আমার থেকে অনেক বেশি সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। অনেক বেশি খারাপ রয়েছেন। তা-ও লড়াই করছেন। বেঁচে আছেন। টিকে আছেন। আসলে জীবনে আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। যা করলে মন ভালো থাকে, আনন্দ পাওয়া যায়, এমন কাজগুলো বেশি বেশি করতে হবে।
এমনিতে প্রত্যেকটা মানুষই নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গতাকে ভরে তোলা জীবনের একটা বড় আর্ট। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আমোদে থাকতে হবে। যে মানুষের অনেক বন্ধু, বহুজনের সঙ্গে খাতির, সে নিঃসঙ্গ হয় না। এ জন্য ছাড় দিতে হবে। সবেচেয়ে বড় কথা জীবনের দর্শন বদলাতে হবে। কেবল টাকা, সাফল্য, খ্যাতি, গাড়ি-বাড়ির পেছনে ছুটলে হবে না। অল্পতে তুষ্ট হতে হবে। নিজের মতো করে ভালো থাকা ও সুখে থাকার উপায় বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, সাফল্য-ব্যর্থতা, ভালো থাকা-মন্দ থাকা জীবনের অঙ্গ। ঘুরে-ফিরে সবই আসে। সময়ের উপর ধৈর্য রাখতে হবে। আজ না হলে কাল সাফল্য আসবেই। ভালো কিছু কারও ক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি হয়, কারও তা দেরিতে আসে। মনের কথা খুলে বলার মতো মানুষ তৈরি করতে হবে। সে রকম কেউ না থাকলে মনোবিদের কাছে যেতে হবে। আমার ভালো থাকা কেউ আটকাতে পারবে না– এই কথাটি মন্ত্রের মতো জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হবে।