Published : 21 Dec 2021, 07:09 PM
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়ে গেল মহা সমারোহে। এই সময়কালে আমরা বেঁচে ছিলাম সেই আনন্দ ভোলার নয়। যদিও বিদেশে থাকি, তারপরও দেশের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ প্রবাসীদেরকে ঘিরে থাকে। হয়তো দেশের তুলনায় একটু বেশিই মানসিক সম্পৃক্তি থাকে আমাদের। অদর্শনের প্রেম সাংঘাতিক। আর একটা কারণ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অসুবিধা এবং ঘুষ-দুর্নীতির গল্প শুনি বটে, আমরা কিন্তু তা চোখে দেখি না। এই যে সকালে চোখে খুললেই ধর্ষণ-বলাৎকার, অপরাধ-অনিয়মসহ নানা কুঘটনা এগুলো আমরা শুনি, বিরক্ত বা ব্যথিত হই, কখনো রাগে অপমানে জ্বলে উঠি, কিন্তু বাস্তবে তার ভেতরে তো আর বাস করি না। এই দূরবর্তী অবস্থান এক ধরনের নির্মোহ দৃষ্টি তৈরি করে দেয়। সে কারণেই বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপন একদিকে যেমন আনন্দের ঢেউ বইয়ে দিয়েছে, আরেকদিকে আছে প্রশ্ন।
একথা মানতেই হবে দেশের চেহারা আমূল পাল্টে গেছে। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের অর্জন আর ইমেজ তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। যে গল্প আমরা শুনি বা যে সব দেখি তার প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা রেখেই বলি, অতোটা না হলেও দেশ এগোচ্ছে। দুনিয়ায় মানুষ বাংলাদেশকে চিনতে শিখছে। একের পর এক সূচকে এগিয়ে থেকে বাংলাদেশ তার জন্মদুশমন পাকিস্তানকে ফেলে এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। ৫০ বছর পর পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম বা সাধারণ মানুষের সাথে বৈরিতার কারণ আছে কি নেই, সে কথা থাক। পাকিস্তানের নাম উঠল এই কারণে যে, তারা বলে দিয়েছিল স্বাধীন হয়ে নাকি বড় ভুল করেছে বাঙালি। চিরকাল অশ্রদ্ধা আর খাটো করে দেখা বাঙালিকে কাঁধের সমান ভাবতে পারেনি তারা। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরই বলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ চিরকাল থাকার জন্য জন্ম নেওয়া এক দেশ। তার ভাষায়, দাবায়ে রাখতে পারবে না কেউ।
এটা সত্য হয়েছে। তার কন্যার শাসনামলে পাকিস্তানের নাক উঁচু বুদ্ধিজীবীরাও ইমরান খানকে অনুরোধ জানিয়ে বলে, আমাদের সুইজারল্যান্ডের স্বপ্ন দেখিয়ে লাভ নাই বাংলাদেশের সমান করে দেখাও। এসব কথাতেই স্পষ্ট আমাদের অগ্রযাত্রা। ভারতের মতো বিশাল ও শক্তিশালী প্রতিবেশীও বিস্মিত হয় আমাদের অর্জনে। পাশের বাংলা থেকে অনেকদূর এগিয়ে বলিষ্ঠতায় তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া দেশের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানও কি তেমন আকাশের মতো বড় আর উদার হওয়ার দরকার ছিল না? আর কোনওকালে কি ৫০ বছরের বিজয় দিবস ফিরে আসবে? আসবে না বলেই দু একটা কথা বলা জরুরী।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তার ৭ই মার্চের ভাষণ, তার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির ফসল বাংলাদেশ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তো তিনি ছিলেন না। তাকে বন্দি করে পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রেখেছিল পাকিস্তানি জান্তারা। সেই সময়কালে তার অনুগামী নেতৃত্ব যে সাহস আর প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন তার কি কোন তুলনা হয়?
যখন আমাদের মাথার ওপরে আকাশসম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেই, তখন দিশেহারা জাতিকে কারা শক্তি দিয়েছিলেন? মুজিবনগর সরকার না হলে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের হাল ধরত কারা? এই যে হাজার হাজার মুক্তিসেনা, সেক্টর কমান্ডাররা, সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী সবাই তখন একযোগে কাজ না করলে, ভারত পাশে না দাঁড়ালে ১৬ই ডিসেম্বর কি আসত বাঙালির জীবনে? আসুন একবার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক আগ দিয়েই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন। আর ওদিকে জাতির পিতার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া তাজউদ্দীন আহমদসহ বাকিদের আত্মগোপনে চলে যেতে দিক-নির্দেশনা দেন। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর পরামর্শক্রমে আত্মগোপন করেন নিজের পরিবারকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে। ২৭শে মার্চ তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। এরপরের গল্পটা তাজউদ্দীন আহমদের- পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়া। ২৮শে মার্চ তিনি আমির-উল ইসলামসহ মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারত যান। সেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াপূর্বক তাদের ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ৪ঠা এপ্রিল যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেন।
ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে দেখা হওয়ার শুরুতেই প্রশ্ন করেন, "মুজিব কেমন আছে? সে ঠিক আছে?" জবাবে তাজউদ্দীন বলেন, "২৫শে মার্চের পরে তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি, বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে এখানে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যেকোনো মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজন আশ্রয় ও খাদ্য।"
ওই বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে আশ্বস্ত করেন যথাসময়ে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে। ওই বৈঠকে তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। ৫ই এপ্রিল তিনি আবার ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনায় বসেন। ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে ভারতে অবস্থানের অনুমতিসহ সরকার পরিচালনায় সহায়তা, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সহায়তা, শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তা প্রদান, বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সহায়তা প্রদান ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিমান প্রদানসহ অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
একদিকে ভারত, রাশিয়া অন্যদিকে পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এসব দ্বন্দ্ব কিন্তু সহজ কিছু ছিল না। সেগুলো সামাল দিয়েছিলেন কে? কাদের নেতৃত্বে শত অর্ন্তকোন্দল বা ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আমরা স্বাধীন হতে পেরেছিলাম? এবারের বিজয় দিবসের বড় অনুষ্ঠান বিশেষত সরকারি আয়োজনে তাদের নাম কি উচ্চারিত হয়েছিল? আর যদি হয়েও থাকে তার কি কোনো গুরুত্ব ছিল? আবারও বলছি, বঙ্গবন্ধু যে আকাশের সূর্য বা চাঁদ সে আকাশের তারাদের ভুলে থাকা কি কাজের কথা?
কথায় কথায় রাজনীতি মনে করিয়ে দেয় আমাদের ইতিহাস বিকৃতির দায় জামায়াত-বিএনপির। কথা সত্য। এরশাদ আমলেও তাই হতো। বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত বলা যেত না। মুক্তিযুদ্ধের দুশমনদের নাম পরিচয় বলাও ছিল অপরাধ। সে কাল গত হয়েছে। তারা আজ বিপাকে। এখন একচ্ছত্র আধিপত্যের পরও সঠিক ইতিহাস সবাইকে নিয়ে বলার বাধা কোথায়? কিসের ভয়? কেন এই বিস্মরণ?
বিজয়ের অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ সকলের অবদান স্বীকার করলে ইতিহাসই গর্বিত হতো। বলশালী হতো আমাদের দেশের ইমেজ। এতবড় আর বিশাল একটা অনুষ্ঠানে বানান ভুল নিয়ে যারা সামাজিক মিডিয়া গরম করে তুলছেন তাদের জন্য বলি, তার চেয়ে জরুরী ছিল সবাইকে নিয়ে ইতিহাসের সকল চরিত্রকে স্মরণ করে অতীতের প্রতি সম্মান জানানো। কেন আওয়ামী লীগের আমলে এটা হবে না?
এক ফুলে আর যাই হোক মালা তো গাঁথা হয় না। সে বরমাল্য গলায় দিতে না পারলে বাংলা মাকে কি অসাধারণ মনে হতে পারে। কুর্নিশ বঙ্গবন্ধু ও তার অনুগামী যোদ্ধা, নেতা, সহকর্মীদের। যাদের অবদানে আজ আকাশের সমান হতে চাইছে স্বদেশ।