Published : 11 Dec 2021, 01:40 AM
"সিরাজ।। তাই যদি সত্য জান, সত্যই যদি বুঝে থাক তােমাদের সাথে আমার সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য, তাহলে এসাে ভাইসব, এসাে, আর একবার চেষ্টা করে দেখি, পলাশীর প্রান্তরে যে রত্ন আমরা হেলায় হারিয়ে এসেছি, বঙ্গ জননীর কনককিরীটে আবার তা পরিয়ে দিতে পারি কি না।
মােহাম্মদী বেগ।। সে চেষ্টা আর তােকে করতে দেব না শয়তান।"
বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটক 'সিরাজউদ্দৌলা'র শেষ দৃশ্যের বহুশ্রুত কতিপয় সংলাপ। যে সংলাপ শুনলে যে কোনও বাঙালি সন্তান এককালে থমকে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেবেছে। ভাবতে ভাবতে অজান্তে উৎসারিত দীর্ঘশ্বাসে পাঁজর ভেঙ্গেছে। অবনত মস্তকে আবার হেঁটে গেছে পথ। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত কারাগারে শৃংখলবন্দি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত চেয়েছিলেন বাংলার জনগণকে আবার একতাবদ্ধ করে হৃত স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু সে সুযােগ সেদিন আর তাকে দেওয়া হয়নি। বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর চক্রের নিয়ােজিত ঘাতক মােহাম্মদী বেগ ছুরিকাঘাতে তাঁকে হত্যা করেছিল নিষ্ঠুরভাবে। আমিনা-দুলাল সিরাজের স্বপ্ন- তার অন্তিম বাসনা আর পূর্ণ হয় নি। তারই বক্ষ রক্তে রঞ্জিত হয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্যটা সেদিন ডুবে গিয়েছিল অস্তাচল পটে। সে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের ঘটনা। সেই থেকে ১৯৭১- এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘটনাবলী লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। আমি ইতিহাসবিদ নই। তবু একাত্তরের ডিসেম্বরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রক্তস্নাত বিজয় নিশানটার দিকে তাকিয়ে কেন যেন ইতিহাস মনে পড়ে গিয়েছিল। আর কাটাসুরের বধ্যভূমির পাশে দাঁড়িয়ে নৃশংসভাবে নিহত কয়েকটি বিকৃত মৃতদেহ দেখে চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সিরাজউদ্দৌলা নাটকের শেষ দৃশ্যটি। মনে পড়ে গিয়েছিল প্রথমে আমিনা-দুলাল হতভাগ্য নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার কথা। পরে সিরাজুদ্দীন হােসেন আমাদের সিরাজ ভাইয়ের কথা। মনে হয়েছিল, নবাব সিরাজের বুকের রক্তে লাল হয়ে বাংলার যে স্বাধীনতা সূর্যটা অস্ত গিয়েছিল সেদিন, সিরাজ ভাইয়ের বুকের নিষ্পাপ রক্তে সিক্ত হয়ে সেই সুর্যটাই যেন উদয়াচলের পথ বেয়ে জেগে উঠেছে আবার। এক সিরাজের মৃত্যুর সাথে লুণ্ঠিত বাংলার স্বাধীনতা-রত্ন বাঙালি জাতি ফিরে পেল, আরেক সিরাজের মৃত্যুর মাঝ দিয়ে। এক সিরাজ ইতিহাস হয়ে আছেন, আরেক সিরাজ ইতিহাস সৃষ্টি করে স্মৃতি। লিখতে গেলে হৃদয় যন্ত্রণায় ভরে যাবে ভয়ে যে স্মৃতিমুখরতা থেকে সবসময় সখেদে দূরে দূরে থাকতেই চেয়েছি, তার খণ্ডিতাংশও কোনদিন লিখতে হবে, ভাবিনি। আর তাই সিরাজ ভাই সম্পর্কে যখন কিছু লিখতে অনুরুদ্ধ হই, তখন রুদ্ধ আবেগে নিদারুণ বিব্রত হয়ে পড়ি। হাজার স্মৃতির তােলপাড়- উন্মনা বুঝিবা উন্মাদ করে তুলতে চায়। তাছাড়া রাজনীতিক হিসেবে, সাংবাদিক হিসেবে, মানুষ হিসেবে যে কোনও শ্রদ্ধেয় জনের ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণের যােগ্য আমি নই। তবু সিরাজ ভাইয়ের দীর্ঘ সান্নিধ্যের কিছু ঘটনার উল্লেখ করে স্মৃতিকথায় একটা অধ্যায় সংযােজনের প্রয়াস পেতে চাই। রােজনামচা রাখার কোন অভ্যাস ছিল না বলে আজ আক্ষেপ হয়। কিন্তু স্মৃতি নির্ভর ঘটনাগুলাে তবু কত ভাস্বর।
১৯৫৪ সাল। তৎকালীন সারা পূর্ব বাংলা যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের আনন্দে এবং আমাদের থানা বন্যায় প্লাবিত। সে বছরই কলেজে পড়ার পাট চুকিয়ে দিয়ে এলাম ঢাকায় এক আত্মীয়ের মেসে। রহমান চাচা তখন সরকারী মৎস্য বিভাগে দিনের বেলায় এবং রাতে দৈনিক সংবাদ- এ সংশােধনী বিভাগে পার্টটাইম চাকরি করেন। তাকে ধরলাম একটা চাকরির জন্য। সাহিত্যের ভূত আগে থেকেই সওয়ার হয়েছিল ঘাড়ে। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেল সংবাদপত্র অফিসে। সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাস থাকলেও কী করে সংবাদপত্র ছাপা হয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছে, সে বিষয়ে তার আগে অনেকের মতাে আমিও ছিলাম নিতান্ত অজ্ঞ। সব দেখে প্রথম দিনই ভাল লেগে গেল। সেই যে নেশায় ধরল, ঘােরে ঘােরে কেটে গেল কতদিন। কত বিচিত্র চরিত্রের মানুষ দেখলাম, কত প্রতিভাবানের সাক্ষাৎ পেলাম। পেলাম তাদের সান্নিধ্য। রাজনৈতিক কত উত্থান-পতনের সাক্ষী হলাম। স্মৃতির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হলাে।
প্রথমে দৈনিক মিল্লাত তারপর সংবাদ- এর সংশােধনী বিভাগে শিক্ষানবীশী শুরু করলাম। চাচা বললেন, না। শিক্ষানবীশী-ই যখন করতে হবে, তখন সংবাদে কেন! ইত্তেফাক- এর ভবিষ্যৎ ভাল। চলাে ইত্তেফাকে। | চলে এলাম। নয় নম্বর হাটখােলার প্যারামাউন্ট প্রেস ছিল তখন ইত্তেফাক- এর মুদ্রণালয় ও অফিস। অফিস বলতে চার-পাঁচ খানা টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার। বড় দুইটি টেবিলের একটি বার্তা এবং অপরটি সংশােধনী বিভাগের। সংশােধনী আর হিসাব বিভাগের কাজ চলত একই সংকীর্ণ টিনশেডের নিচে বসে। এখন সেখানটায় ফুটপাত। বিজ্ঞাপন, সাধারণ ও প্রচার বিভাগের কাজ চলত লােক স্বল্পতা ও স্থান সংকীর্ণতার মধ্য দিয়েই। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার (মােসাফির) নিজস্ব কোন টেবিল ছিল না। তার সম্পাদকীয় দপ্তরটি ছিল প্যারামাউন্ট প্রেস-মালিকের টেবিলটি। প্রতিদিন বিকেলের দিকে তিনি তার টেবিলটি ছেড়ে দিতেন মানিক মিয়ার জন্য। এ টেবিলে বসেই মানিক মিয়া লিখেছেন তার অগ্নিক্ষরা যুগান্তকারী অনেক লেখা। | ইত্তেফাক- এর বার্তা-সম্পাদক তখন খােন্দকার আবদুল কাদের। ১৯৫৩ সনে সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে রূপান্তরের সময় থেকেই তিনি বার্তা-সম্পাদক।
নামে বার্তা-সম্পাদক হলেও তাকে দেখেছি একাধারে বিজ্ঞাপন ম্যানেজার কাম সার্কুলেশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করতে। তেমনি ওয়াদুদ ভাইকে দেখেছি বার্তা-বিজ্ঞাপন-অনুবাদ থেকে শুরু করে সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লিখতে, এমন কি কাগজ বিক্রি করতেও। সিরাজ ভাইকে দেখেছি অনুবাদ, রাইট আপ, রিপাের্ট, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় লিখতে, সংবাদ সম্পাদকীয় সম্পাদনা করতে। মানিক মিয়া শুধু ইত্তেফাক- এর সম্পাদকই ছিলেন না, ছিলেন মালিকও। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ব্যাপারে 'সব মালিকের চরিত্র এক'- এমন একটা ধারণা শ্রমিকদের মধ্যে প্রচলিত থাকলেও মানিক মিয়া ছিলেন আশ্চর্য ব্যতিক্রম। অন্য মালিকদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা তার চরিত্র, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা। ব্যবসা নয়, দেশের কথা বলতে হবে, দশের কথা বলতে হবে, দেশবাসীকে জাগাতে হবে, স্বৈরাচারী ঔপনিবেশিক শাসনের শোষণ আর ধোঁকাবাজি সম্পর্কে অজ্ঞ দেশবাসীকে সচেতন করে তুলতে হবে- এই ছিল তার লক্ষ্য, ইত্তেফাক এর নীতি। এ লক্ষ্য হাসিলে কোন কথা কিভাবে দেশবাসীকে জানাতে হবে, সিরাজ ভাই তা যেন বহু আগেই স্থির করে রেখে দিতেন। মানিক মিয়ার চোখ দেখে সিরাজ ভাই বুঝে নিতে পারতেন কোন্ সংবাদ কিভাবে পরিবেশিত হবে। একই লক্ষ্যের অভিসারী বলে, একই মহান মিশনের অভিযাত্রী বলেই হয়ত এমনটি হতে পেরেছিল। গড়ে উঠতে পেরেছিল তৎকালীন ইত্তেফাক কর্মীদের মাঝে একটি 'সেনাবাহিনী সুলভ অহমিকাহীন সুষ্ঠু টিম-ওয়ার্ক'। সে কথা থাক। পরের কথা পরে।
কাদের সাহেবের অনুমতি নিয়েই সংশােধনী বিভাগে শিক্ষানবীশী শুরু করলাম। কয়েকদিন পরই অবশ্য কাদের সাহেব তার নিজস্ব সাপ্তাহিক 'নতুন দিন' এর জন্যে ইত্তেফাক ছেড়ে চলে গেলেন। শুনলাম নতুন বার্তা-সম্পাদক আসছেন। কে? কে? সারা অফিসে ঔৎসুক্য। সিরাজুদ্দীন হােসেন, আমাদের সিরাজ ভাই। দৈনিক আজাদ থেকে তিনি এলেন। এলেন এবং জয় করলেন। তার আগমনে ইত্তেফাক- এর আঙ্গিক পরিবর্তন ঘটে যেমন তাতে নতুন প্রাণের স্পন্দন সঞ্চারিত হলাে, তেমনি সিরাজ ভাইও ঠাঁই করে নিলেন শুধু ইত্তেফাক কর্মীদেরই নয়, বাঙালি জাতির মনের মণিকোঠায়।
'সােনায়' সােহাগা বলে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে আমাদের দেশে। তৎকালীন ইত্তেফাককে যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে সিরাজ ভাই তার উপযুক্ত বার্তা-সম্পাদক। একদিকে মানিক মিয়া, অন্যদিকে সিরাজ ভাই। মনি-কাঞ্চনের অপূর্ব যােগাযােগ। এই দুই অনন্য ব্যক্তিত্বের যুগ্ম পরশে ইত্তেফাক- এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি পেল জীয়নকাঠির সন্ধান। ইত্তেফাক যেন নিমজ্জমান জাতির জীবনতরী। বেঁচে থাকবার, অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবার অবহেলা, বঞ্চনা আর হতাশার সাগরতল থেকে ভেসে উঠবার একমাত্র অবলম্বন। আমার চাকরি তখনাে হয়নি। উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করলেও একটা হতাশাবােধ আমাকে গ্রাস করছিল ধীরে ধীরে। এরই মাঝে ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের ভরাডুবি এবং নিজের সেই অর্ধ-বেকারত্বের মিশেলে 'ক্যানভাসার' নামে ব্যঙ্গাত্মক একটা রচনা লিখেছিলাম। সাহিত্যবিভাগের ভারপ্রাপ্ত সহ সম্পাদক শামসুল হককে একদিন দিলাম লেখাটা। হক ভাই পরের রােববারই লেখাটা ছেপে দিলেন।
সে স্মৃতি আজ ঝরা বকুল। কিন্তু ঝরে যাওয়া বকুলেরও কিছুটা গন্ধ থাকে। ভ্রমর গুঞ্জন নাই বা তুলুক। সিরাজ ভাই লেখাটা পড়ে লেখক সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন। হক ভাই বলেছিলেন, আমি যেন তার সাথে একবার দেখা করি। সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বলা বাহুল্য, সেদিন থেকে আমার শিক্ষানবীশীর কালও শেষ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য সুপারিশ আর সাহায্য পেয়েছিলাম বিভাগীয় প্রধান কাজী শহীদুল ইসলাম, আসির উদ্দীন আহমদ, হক ভাই ও বন্ধুবর শামছুল আলমের। দিন কাটছিল।
তখনকার দিনে ম্যাট্রিক কিংবা আইএ পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা ছিল পত্রিকাগুলাের দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম। পত্রিকার কাটতির জন্যও বটে। তাই এটা ছিল প্রায় একটি পারস্পরিক প্রতিযােগিতার পর্যায়ভুক্ত। যে পত্রিকা সবার আগে ফল প্রকাশ করতে পারত, দু-একদিনের জন্য হলেও তার বিক্রি প্রকৃত প্রচার-সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি হতাে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পত্রিকায় ফল সরবরাহ করতে দেরি হয়ে যেত বলে পত্রিকা অফিস থেকেই আগে-ভাগে লােক গিয়ে ফল লিখে নিয়ে আসত। সিরাজ ভাইয়ের উদ্যোগে দৈনিক ইত্তেফাকই প্রথম এবং পরে অন্যান্য পত্রিকা এ পন্থার আশ্রয় নেয়। পরে এ রেওয়াজ অবশ্য বদলে গেছে। তখনকার প্রচার-সংখ্যার দিক দিয়ে সম্ভবত দৈনিক আজাদ ছিল সবার শীর্ষে। ইত্তেফাক- এর বয়স তখন সবে দেড়-দুই বছর। কিন্তু আজাদ পরীক্ষার ফল প্রকাশ করত না। একবার নাকি ভালভাবে পাস করা কোনও একটি ছেলের রােল নম্বর আজাদ- এ ভুল ছাপা হয়। সত্যাসত্য যাচাই না করেই ছেলেটি আত্মহত্যা করে বসে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা প্রতিভাধর একটি তরুণের সেই করুণ পরিণতির প্রতিক্রিয়ায় আজাদ কর্তৃপক্ষ তারপর থেকে পরীক্ষার ফল প্রকাশ একেবারেই বন্ধ করে দেয়। হাতের লেখাটা সুন্দর আর স্পষ্টাক্ষর ছিল বলে একবার সিরাজ ভাই আমাকে তিনজন সাহায্যকারী আর পরিচয়পত্রসহ পাঠিয়েছিলেন বোর্ড অফিসে ফল আনতে। ভুল করে যাতে অন্য কোনও তরুণ জীবনের অকালমৃত্যুর কারণ না হয় দৈনিক ইত্তেফাক, সেজন্যেই আজাদ- এর ঘটনার কথা বলেছিলেন আমাদের। আমরা গিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যাবধি খুব দ্রুত এবং নির্ভুলতার সাথে লিখে একদিনেই সবগুলাে কেন্দ্রের ফল নিয়ে অফিসে ফিরে এলে সিরাজ ভাই খুশি হয়েছিলেন। ফকির চান হােটেলের পােলাও খাইয়ে দিয়েছিলেন আমাদের কয়েকজনকে। বলা বাহুল্য, সবার আগে সেবার ইত্তেফাক- এ ফল ছাপা হয়েছিল। সুখের বিষয়, ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত ফলদৃষ্টে কোন তরুণ কোনদিন আত্মহত্যা করেছে বলে শােনা যায় নি। সেই যে সিরাজ ভাই এসেছিলেন, তারপর আমৃত্যু তিনি কর্মরত ছিলেন। ইত্তেফাক- এ। মাঝখানে মানিক মিয়ার সাথে সামান্য মতানৈক্য ঘটায় চাকরি ছেড়েছিলেন। কিন্তু জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী নিজে ফিরিয়ে এনেছিলেন সিরাজ ভাইকে। ফলে অভিমান সিরাজ ভাইয়েরও টেকেনি, মানিক মিয়ারও থাকেনি। দিন কয়েক পরেই সিরাজ ভাই আবার এসে বসেছেন তার ডেস্কে। প্রজ্বলন্ত দেশপ্রেমের শিখা যাদের অন্তরে, বৃহত্তম ব্রত উদযাপনের একই অগ্নিমন্ত্রে যারা উদ্বুদ্ধ, সামান্য মতপার্থক্য তাদের অভীষ্ট সাধনে অন্তরায় সৃষ্টি করে রাখতে পারে না। পারে না লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে। যুদ্ধমান কোন সেনাদলের সেনাপতির মৃত্যুতে একই নীল নকশা নিয়ে যেমন অন্য সেনাপতি তার স্থলাভিষিক্তি হয়ে একই লক্ষ্যার্জনের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সেনা পরিচালনা করেন, মানিক মিয়ার অনুপস্থিতিতেও সিরাজ ভাই পালন করে গেছেন ঠিক সেইরূপ দায়িত্ব। একবার মানিক মিয়া জেলে গেলেও তার 'মােসাফির' ছদ্মনামে লেখা 'রাজনৈতিক মঞ্চে'র মূল বিপ্লবী সুর বজায় রেখে 'নবীশ মােসাফির' ছদ্মনামে তালেব ভাইকে দিয়ে সিরাজ ভাই শুধু 'মঞ্চ' নামে ওই কলামটি লিখিয়েছেন কিছুদিন। কিন্তু মনঃপুত না হওয়ায় সিরাজ ভাই নিজেই 'অনামী' ছদ্মনামে মঞ্চে নেপথ্যে উপসম্পাদকীয় কলামটি লিখতে শুরু করলেন এবং তা রাজনৈতিক মঞ্চের বিকল্প হিসেবে তেমনি জনপ্রিয়তা লাভ করল। জেলখানায় বসে কিংবা সপ্তাহ পক্ষকালের বিদেশ সফরে থেকেও মানিক মিয়া নিশ্চিন্ত থাকতে পারলেন।
শুধু সিরাজ ভাই নন, লক্ষ্যার্জনের তাপস সাধনা নিয়ে অগ্রসরমান দৈনিক ইত্তেফাক-এর তৎকালীন কর্মরত সাংবাদিক কর্মচারীদের নিজস্ব দায়িত্বের বাইরেও অনেককে অনেক কিছু করতে হয়েছে। আজ সাংবাদিকদের সংজ্ঞা আর সম্পাদনার রীতিবদল হয়ে সংবাদপত্রের কর্মধারায় ব্যবচ্ছেদ ঘটেছে। আগের সেই মিশনারী চরিত্র নেই বলে দায়িত্বও হয়ে পড়েছে খণ্ডিত ও নির্দিষ্ট। আজকাল সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, সহ-সম্পাদক, প্রতিবেদকরা ছাড়াও বিভিন্ন কলামনিস্ট, চিফ সাব-এডিটর, চিফ রিপাের্টার, সিটি এডিটর, স্পেশাল করেসপণ্ডেন্ট, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, বৈদেশিক ভাষ্যকার, কূটনৈতিক ভাষ্যকার, সাহিত্য সম্পাদক, ফিচার সম্পাদক, সংস্কৃতি সম্পাদক, মফস্বল সম্পাদক, বাণিজ্য সম্পাদক, অর্থনীতি সম্পাদক, ক্রীড়া সম্পাদক ইত্যাকার বহুতর ব্যক্তিত্বের সমাবেশে পত্রিকার অফিস মুখর। কিন্তু সিরাজ ভাইকে দেখেছি একাই এক শ। সংবাদপত্রের সব বিভাগ সম্পর্কেই তার ছিল প্রগাঢ় জ্ঞান। সাংবাদিকতার প্রতিটি শাখায় দেখেছি তার স্বচ্ছন্দ সুনিপুণ বিচরণ। এখনকার সংবাদপত্র আর আগেকার দিনের সংবাদপত্রের আঙ্গিক, কাজকর্ম ও চিন্তাধারায় আকাশ-পাতাল ব্যবধান। অনেক অসামঞ্জস্য। মানুষের রুচি-চাহিদার পরিবর্তন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, মুদ্রণ যন্ত্রের উন্নতি প্রভৃতি কারণে সংবাদপত্র শিল্পে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এক কথায় সময়ের প্রয়ােজন ও চাহিদায় সেদিনে-এদিনে রচিত হয়েছে এই ব্যবধান। দেশ স্বাধীন হয়েছে, শিক্ষা-দীক্ষার সম্প্রসারণ ঘটেছে, খরচের সংখ্যা বেড়েছে, দেশবাসীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক চেতনা প্রখরতর হওয়ার ফলে পত্রিকার প্রচার সংখ্যা বেড়ে গেছে কল্পনাতীত। তাই সংবাদপত্র শিল্পের স্বার্থেই আগের চাইতে অনেক বেশী অভিজ্ঞ লােকের প্রয়ােজন সংবাদপত্র অফিসে। কিন্তু এত উৎকর্ষ সত্ত্বেও কেন যেন মনে হয় আগেকার সাংবাদিক নিষ্ঠা আর সাধনা ম্লান হয়ে গেছে অনেকখানি। সাংবাদিক, সংবাদপত্র মালিক- সকলের ব্যবসা বুদ্ধির প্রখরতায় আগের সেই মিশনারী আদর্শ যেন স্লানিমায় ঢাকা পড়ে গেছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে, তাদের নেতৃত্ব দিয়েও পারল না কেউ জাতিকে সঠিক পথ নির্দেশ দিতে। না ইত্তেফাক, না অন্য কোন পত্রিকা। ১৯৫৮ সালের জুন মাসে প্যরামাউন্ট প্রেস থেকে দৈনিক ইত্তেফাক চলে এসেছিল ১নং রামকৃষ্ণ মিশন রােডের বর্তমান বাড়িতে। ইংরেজি 'দৈনিক নিউ নেশন' বন্ধ হয়ে গেলেও মানিক মিয়ার স্বপ্ন বেঁচে রইল ইত্তেফাক-এর ছাপাখানার নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস নামকরণে। ইত্তেফাক- এর মাধ্যমেই মানিক মিয়া তার সেই নতুন জাতির স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে চাইলেন। আর তার এই কর্মসাধনায় সিরাজ ভাই যােগ্য সহকারীর দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করে গেছেন নিরলসভাবে। ১৯৫৮- এর ১৫ জুন থেকে নিজস্ব নিউ নেশন প্রেস থেকে ইত্তেফাক বেরোতে শুরু করল। তখন কি আর কেউ ভেবেছিলাম ওই বিশেষ তারিখ এবং মাসটা দৈনিক ইত্তেফাক আর মানিক মিয়ার জীবনে অপয়া হয়ে দেখা দিবে। ছেষট্টি সনের ১৫ জুন রাতে মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল আইয়ুব সরকার। পরদিন আর এক হুকুমে নিউ নেশন প্রেস হলাে বাজেয়াপ্ত। আর উনসত্তুরের জুন মাসে মানিক মিয়া চিরবিদায় নিলেন এবং ১৯৭৫- এর ১৫ জুন তারিখটিতেই ইত্তেফাক কুক্ষিগত করলো তৎকালীন সরকার। হায়রে অপয়া জুন!
১৯৫৮-তে ইত্তেফাক যখন এ বাড়িতে এলাে তখন এটা একটা একতলা বাড়ি। উপরে একটা চিলেকোঠাসহ সাড়ে পাঁচটা কামরা। ঢােকার মুখের অপেক্ষাকৃত বড় কামরাটায় কিছুদিন বার্তা, কিছুদিন বিজ্ঞাপন বিভাগের কাজ চললাে। পরে স্থান সংকুলানের জন্যে ছাদে টিনের ছাউনি দিয়ে দোতলা বানিয়ে বার্তা-সংশােধনী আর বিজ্ঞাপন বিভাগ সেখানে স্থানান্তরিত হয়েছিল। এই বাড়িতে এসে মানিক মিয়ার প্রাত্যহিক জীবন-ধারায় কিছুটা পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছিল। অফিসে আসা-যাওয়া এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা নিয়ম মানার চেষ্টা করেছেন তিনি। একদিন অফিসে ঢুকতেই তালেব ভাই কলরব করে উঠলেন।
সিরাজ ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন- "নে। সিরাজ, তাের মুশকিল আছান হয়ে গেছে। আগে তালুকদারকে এবং সেই সাথে আমাকেও এক কাপ চা খাওয়া।"
সিরাজ ভাই জবাব দিলেন, "তা না হয় খেলি। কিন্তু…"
তালেব ভাই বললেন, "ও আর ভাবিস নে। ভাবনা সে তাে ফাঁকির বােঝা…। বন্দুকটা তালুকদারের কাঁধে রেখে আয়, শিকার যাত্রায় বেরিয়ে পড়ি। ওর হাতের লেখা সুন্দর— চলবে। চা-টা খেয়ে নিয়ে চল বাবা 'জয় মা তারা' বলে এ বেলা কেটে পড়ি। আমার লেখাটা এই শেষ হয়েছে।"
কিছুই বােধগম্য হচ্ছিল না। একবার তালেব ভাই আর একবার সিরাজ ভাইয়ের দিকে চাইছিলাম। তালেব ভাই ছােট্ট একটা রিপোের্ট লিখছেন। সিরাজ ভাই ড্রয়ারে কী খুঁজছেন। জিজ্ঞেস করলাম- "ও কি ব্যাপার সিরাজ ভাই?"
"আরে হতচ্ছাড়া (হতচ্ছাড়া আর হতভাগা শব্দ দুটিতে সিরাজ ভাই প্রায়ই আমাদের সবাইকে আদূরে সংবোধন করতেন) এক জায়গায় যাব বলে 'আমি আর তালেব বাসা থেকে বেরুলাম, অফিসে এসে দায়ে ঠেকলাম। এডিটর সাবের মঞ্চের ডিক্টেশন নিতে হবে। পারবি? যা তাে দেখি।"
আগে 'মােসাফির' তার সব লেখাই স্বহস্তে লিখতেন। তার নিজের লেখাও খুব সুন্দর ছিল। একটু ছােট ছাঁদের টানা অক্ষরে লিখতেন। তৎকালে আজকের দিনের মতাে শীষকলমের প্রচলন ছিল না। ঝরনা কলম দিয়ে নিউজ প্রিন্টের প্যাডে লিখতে গেলে কাগজে কালি চুষে সুন্দর লেখাও অস্পষ্ট হয়ে যেত। ছােট ছাঁদের লেখা ছিল বলে অনেক সময় তার লেখা কম্পােজিটররা যথাযথ পাঠোদ্ধার করতে না পেরে ভুল কম্পােজ করতেন। ফলে প্রুফ সংশােধনে খুব বেশি কাটাকাটি হতাে এবং সংশােধনে বেশি সময় লাগতাে। সময়ের এ অপচয় রােধ এবং পরে স্বাস্থ্যগত কারণেও মানিক মিয়া মঞ্চ লেখার ডিক্টেশন দিতেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অফিসে আসতেন। ওই দিনের সবগুলাে কাগজ দেখতেন। তারপর এক সময় ডিক্টেশন নেয়ার জন্যে সিরাজ ভাই কিংবা ওয়াদুদ ভাইকে ডাকতেন। অবসর থাকলে তারা নিজেরা, না থাকলে অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিতেন। তালেব ভাইয়ের কথামতাে সেদিন বন্দুকটা আমার ঘাড়েই তুলে দিয়েছিলেন সিরাজ ভাই।। তারপর থেকে সকালের শিফটে ডিউটি থাকলে কিংবা বিনা কাজে অফিসে এলে মাঝে মাঝে মঞ্চের ডিক্টেশন নিতে হতাে। বহুদিন ডিক্টেশন নিয়েছি।।
১৯৬৬ সনের ১৬ জুন যখন শেষবারের মত ইত্তেফাক বন্ধ করলো আইয়ুব সরকার, তার মাসখানেক আগের কথা। রাতের শিফটের সবাই যার যার কাজ করছি। দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়িতে অকস্মাৎ কয়েকটি ভারী পদশব্দ শােনা গেল। একটু পরেই বার্তাকক্ষে সপারিষদ প্রবেশ করলো গভর্নর আবদুল মােনেম খান। নারায়ণগঞ্জের দিকে কোথায় গিয়েছিলেন এক অনুষ্ঠানে। ফিরতি পথে পদধূলি রাখতে এসেছেন ইত্তেফাক অফিসে।
সবাই তটস্থ হয়ে পড়েছিলাম। মোনেম খান সিরাজ ভাইয়ের সামনের চেয়ারে বসলেন। বঙ্কিম হাসি আর তির্যক কটাক্ষে সিরাজ ভাইকে বললেন, "ও আপনেগর বাড়িতে বেড়াইতে আইলাম। ক্যামুন আছেন, কন। কী খাওয়াইবান?" সিরাজ ভাই কম যাননি। বিনয় সহকারে বলেছিলেন, "গরীবের বাড়ি হাতির পাড়া। আপনাদের খেয়ে-পরেই তাে বেঁচে আছি। প্রতিবেশীর বাড়ি কোনদিন আসেন না। এমন সময় এসেছেন, যখন চা-বিস্কুট ছাড়া আর কিছু খাওয়ানাে এ গরীবদের পক্ষে সম্ভব নয়।"
খান সাহেব অন্তরঙ্গ হওয়ার ভান করেছিলেন। বলেছিলেন, "চা-বিস্কুটই খামু। খাওয়ান।"
মােল্লার ক্যান্টিন থেকে চা-বিস্কুট এসেছিল। খেয়েছিলেন। খেতে খেতে অনুযােগ করেছিলেন- তার ছবি ইত্তেফাক- এ ছাপা হয় না বলে। এ তার মনের দারুণ এক ক্ষোভ ছিল বটে। গভর্নরগিরি প্রাপ্তির পরদিনই বােধ করি তার একটা ছবি ইত্তেফাকের পাতায় ছাপা হয়েছিল। তারপর আর নয়। তার ছবি না ছাপানোর ব্যাপারে সিরাজ ভাইয়ের প্রতি মানিক মিয়ার নির্দেশ ছিল। হতে পারে ইত্তেফাকে ছবি না ছাপানাের ব্যাপারটাও গভর্নর মােনেম খানের মর্মপীড়া এবং ইত্তেফাক বিদ্বেষের অন্যতম কারণ ছিল। চা খেয়ে মােনেম খান চলে গিয়েছিলেন। সিরাজ ভাই আশঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, "অন্য চাকরি বােধ হয় খুঁজতে হবে রে।" সেই গভীর রাতেও বাসায় ফোন করে মানিক মিয়াকে জানিয়েছিলেন এই অভাবিতপূর্ব ঘটনার কথা। মােনেম খানের চলে যাবার পরে এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে সিরাজ ভাইয়ের পয়সায় রাতের শিফটের সবাই চা খেয়েছিলাম। কাপে কাপে ঠেকিয়ে সেটা ছিল আমাদের 'গভর্নরের স্বাস্থ্যপান'। গভীর রাতে খােদ গভর্নরের সেই আকস্মিক ইত্তেফাক অফিস পরিদর্শনের মাসখানেক পরেই মানিক মিয়া গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ইত্তেফাক- এর নিউ নেশন প্রেসে তালা ঝুলেছিল। সিরাজ ভাইয়ের সে রাতের আশঙ্কা এমনিভাবেই বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করেছিল। আর সেই সাথে আমাদের সকলের ভাগ্য ঝুলে পড়েছিল এক অনিশ্চিতের মাঝে। পথে পথে ঘুরে আয়ু ক্ষয় করতে হয়েছে অনেককে। কেউ কেউ অন্য পেশায় জীবন ধারণের পন্থা খুঁজেছেন। মােনেম খান অবশ্য তার পত্রিকা 'পয়গাম'- এর দ্বার আমাদের জন্যে উন্মুক্ত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার সেই দয়ার দান গ্রহণ করার মানসিকতা আমাদের অনেকেরই ছিল না। সে শিক্ষা মানিক মিয়া বা সিরাজ ভাইয়ের কাছ থেকে আমরা পাই নি।
পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববােধের ফলে ইত্তেফাক গ্রুপের আমাদের কতিপয় চাকরি হয়েছিল সান্ধ্য 'দৈনিক আওয়াজ'- এ। ইত্তেফাক বন্ধ ঘােষণার কিছুদিন পর আইয়ুব-মােনেম বিরােধী ভূমিকা নিয়েই হয়েছিল 'আওয়াজ'- এর নবজন্ম। সে এক নতুন অভিজ্ঞতাও বটে। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদের মমার্থ না বুঝেন, এমন লােক বিরল। প্রবাদটি হলাে- 'সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারাে নয়'। কিন্তু আমাদের সেই অসময়ের দুঃখময় দিনগুলােতে পারস্পরিক বন্ধুত্ব সম্পর্ক এত নিবিড়তর হয়েছিল যে, প্রবাদটির প্রচলিত সারার্থ অসার ছিল আমাদের কাছে। সে সময় একজনের আয় দিয়ে চলতে চেষ্টা করেছি কয়েকজন। কিংবা কয়েকজনের চেষ্টা দ্বারা বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছি একজনের আদর্শকে।
সিরাজ ভাই আওয়াজ- এ যােগ না দিলেও সকলকেই তিনি সাহায্য করেছেন। পরামর্শ দিয়ে, সুপারিশ দিয়ে, কাজের জোগাড় করে দিয়ে, এমনকি নিজের টানাটানি সত্ত্বেও অর্থ দিয়ে। গাজী গিয়াস উদ্দীন নামে এক সহকর্মীর ভরণ-পােষণ তাে প্রায় তখন সিরাজ ভাই নির্বাহ করতেন। অপূর্ব ধৈৰ্য, অসাধারণ বাৎসল্য আর অতুলনীয় সহমর্মিতার অকৃপণ দাক্ষিণ্যে অনেকের অনেক রকম আব্দার সিরাজ ভাইকে হাসি মুখে সহ্য করতে দেখেছি। দেখেছি রেডিও থেকে পাওয়া ষাটটি টাকা একজনকে দিয়ে দেওয়ার পর ভাঙা সাইকেল ঠেলে ঠেলে নর্থব্রুক হল রােডের বাসায় ফিরতে। সহকর্মীর সিগারেট খাওয়ার পয়সা নেই জেনে নিজের আস্ত সিগারেটের প্যাকেটটা তার হাতে তুলে দিয়ে সময়ে সময়ে অবলীলায় তিনি পাতার বিড়ি টেনেছেন। বন্ধুদের ভালবেসেছেন। সন্তানদের ভালবেসেছেন। দেশ আর দেশবাসীকে ভালবাসতে গিয়ে সাংবাদিকতার দারিদ্র্য নিয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন সিরাজ ভাই। অথচ এই পেশার সুবাদেই সিরাজ ভাই বহু মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসমাজের সর্বোচ্চ স্তরের সান্নিধ্য পেয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই তার ব্যক্তিগত বন্ধু ও সত্যিকার শুভানুধ্যায়ীও ছিলেন। ইচ্ছে করলেই সিরাজ ভাই হয়তো প্রাচুর্যময় না হােক স্বচ্ছল নিরুপদ্রব জীবন অনায়াসে যাপন করতে পারতেন। কিন্তু সে সাধারণ পন্থা তিনি অনুসরণ করতে চাননি। আগেই বলেছি, বৃহৎ এবং মহৎ কিছু উদযাপনের জন্যেই যাদের জীবন, হীন স্বার্থবুদ্ধি কখনাে তাদের লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে না। দেশকে ভালবাসতেন বলে সিরাজ ভাই দেশবাসীর সাথে এমন একাত্ম হতে পেরেছিলেন। দেশের বঞ্চিত শােষিত আপামর মানুষের মর্মবেদনার বিন্দু থেকে উৎসারিত ভাষাকেই তিনি দিয়েছেন ক্ষুরের ধার। দেশবাসীর অভাব, অভিযোেগ আর ইচ্ছাকে শাসকদের কাছে তুলে ধরতে সাংবাদিক হিসেবে সিরাজ ভাই ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কোন রাজনৈতিক নেতা, বাকপটু কোন বক্তাও বােধ হয় এমনটি পারেন নি। আর তাই লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সে সময়ের বিরােধী দলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইত্তেফাক এর ভাষা আর সুর কণ্ঠস্থ করে জনসভাকে সম্মােহিত করেছেন, রাজনৈতিক বাজি মাৎ করেছেন। বিপরীতক্রমে, কোন নেতার বক্তৃতা জনসভায় যে আবেদন সৃষ্টি করতে না পারত, সিরাজ ভাইয়ের ভাষায় রূপ দেওয়া সেই একই বক্তৃতা মুদ্রিত আকারে ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করেছে জনগণের মধ্যে। প্রাদেশিক তথা জাতীয় ইস্যুতে অনুষ্ঠিত বিরােধী রাজনৈতিক দলীয় সভা-শোভাযাত্রার রিপাের্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিরাজ ভাই নিজে লিখতেন। কিংবা অন্য প্রতিবেদকরা লিখলেও আদ্যোপান্ত সম্পাদনা করে প্রেসে দিতেন। ১৯৬২ পরবর্তী মিছিল মুখর শহর বন্দর জনপদে গুলি-গােলার ঘটনা-কলুষিত দিনগুলােতে সিরাজ ভাই সব জায়গায় উপস্থিত থাকতে না পারলেও প্রতিবেদকদের মারফত ঘটনার বিবরণ জেনে, কিভাবে তা লিখতে হবে, সে বিষয়ে তাদের প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিয়ে দিতেন। স্বভাবতই এসব খবরের ব্যাপারে সরকারী বিধি-নিষেধের কড়াকড়ি ছিল এবং থাকত। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিরাজ ভাই চতুরতার সাথে সে বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে নিষিদ্ধ খবর পরিবেশন করতেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর সে মুহূর্তে ওই ধরনের চাতুর্য ধরতে না পারলেও পরবর্তীতে তারা অধিকতর সজাগ হতেন। ফলে দৈনিক ইত্তেফাককে সংযত রাখতে ঘন ঘন জারি হতাে নানা ধরনের হ্যান্ড আউট, তৈরি হতাে নতুন অর্ডিন্যান্স। আইয়ুব সরকারের বিশেষ দপ্তরটিকে তালেব ভাই বলতেন 'অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি' আর সিরাজ ভাই সােজাসুজি বলতেন 'অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি।' আসলেও সে সময়ের অর্ডিন্যান্সগুলাে তাে ইত্তেফাককে কাবু করার অস্ত্রস্বরূপই ছিল। সেই অর্ডিন্যান্সগুলাে আবার ছাপাতেও হতাে বাধ্যতামূলকভাবে। সিরাজ ভাই অবিকল সেগুলাে ছেপে দিতেন। কাব্য করে বলতেন, 'ওদের বাঁধন যত শক্ত হবে মােদের বাঁধন টুটবে।' সেই বাঁধন টুটার সাধনায়ই যেন মানিক মিয়া আর সিরাজ ভাই কলম ধরেছিলেন। এবং সেই শক্ত বাঁধন সত্যই টুটে গিয়েছে।
পূর্ব বাংলার আন্দোলনমুখর দিনগুলােতে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক ঘটনা ও পরিস্থিতির ওপর রির্পোট লেখার ভার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিরাজ ভাই নিজে নিতেন। সে সময় প্রায় প্রতিদিনই রাজনৈতিক সংগঠনের ছাত্র এবং নেতারা আসতেন সিরাজ ভাইয়ের কাছে। কোন পরিস্থিতিতে কী ধরনের বিবৃতি দিতে হবে কিংবা কী ধরনের বিবৃতি দিয়ে কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, তার ভাষা কেমন হবে, সে সব বিষয়ে নির্দেশ, পরামর্শ, এমন কি বিবৃতির মূল কাঠামােটা পর্যন্ত সিরাজ ভাই দাঁড় করিয়ে দিতেন।
একবার তারিখটা মনে নেই। কিন্তু মনে আছে, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান বিকেলে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি পেয়ে জেলগেইট থেকেই সােজা যােগ দেবেন পল্টনের জনসভায়। বিকেল সাড়ে তিন-চারটায় জনসভার সময়। তখনকার দিনে খবরের উৎসকেন্দ্র করাচি-ইসলামাবাদ ছিল বিধায় রাত তিনটের আগে বাইরের ফর্মা অর্থাৎ প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠার কাজ শেষ করা সম্ভব হতাে না। তাছাড়া দৈনিক ইত্তেফাক- এর যান্ত্রিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থাকায় ভেতরের পৃষ্ঠাগুলাের ছাপার কাজ সন্ধ্যার আগেই শেষ করে রাখতে হতাে। এই অবস্থায় শেখ সাহেবের বক্তৃতায় বিশেষ বিশেষ অংশের জন্য বাইরের পাতায় স্থান সংরক্ষিত রেখে ১১টায় ভেতরের পৃষ্ঠার জন্যে বক্ততার পূর্ণ বিবরণ লিখতে বসে ২টায় শেষ করে প্রেসে পাঠিয়ে জনসভায় গিয়েছিলেন সিরাজ ভাই। যথাসময়ে বক্তৃতা শুরু করার আগেই ওইদিকে ছাপা হয়ে গেছে শেখের বক্তৃতা। এবং অত্যাশ্চর্য ব্যাপার এই যে, সিরাজ ভাই সকাল ১১টায় যে বক্তৃতা লিখে গেছেন, চারটায় বক্তৃতা মঞ্চে উঠে এক নাগাড়ে দুই ঘন্টা বক্তৃতা দিয়েও শেখ মুজিব তার বাইরে বিশেষ কিছু বলেননি। চিন্তা ও কর্মে, সাধনা ও লক্ষ্যে একই সমতলে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই এমনটি ঘটতে পেরেছে। | আজকাল পত্রিকায় স্কুপ নিউজ বিশেষ দেখা যায় না। কালে ভদ্রে কোন সাংবাদিক কোন নিউজ স্কুপ করতে চাইলেও হুমকি খেয়ে চেপে যান। এ জাতীয় সাংবাদিক দায়িত্ব পাশ কাটিয়ে যাবার ফলেই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বহুবিধ সমস্যার জন্ম হয়েছে, বহু জাতীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। স্কুপ নিউজ এবং হেড লাইন তৈরিতে সিরাজ ভাই ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার চাতুর্যপূর্ণ হেডলাইন এত বলিষ্ঠ, নির্ভীক ও ব্যাপক আবেদনময় ছিল যে, শুধু হেডলাইন দেখে খবরের মূল বক্তব্য সম্পর্কে পাঠক অনেক কিছু আঁচ করে নিতে পারতেন। সেইসময়ে রকে, রেস্তোরাঁয়, রেলে স্টীমারে, পথে-ঘাটে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করেছে- আজকের ইত্তেফাক- এর হেডিংটা কি ছিল ভাই? দেখেছেন?
শুধু হেডলাইন এর আকর্ষণ সৃষ্টিতেই নয়, আইন সভায় বিরােধী দলীয় সদস্যরা ক্ষমতাসীন সরকারকে বা সরকারী দলের সদস্যদের যেভাবে নাজেহাল করতে থাকেন, সে সময় প্রতিদিন তার চমকপ্রদ বর্ণনা দিতেন সিরাজ ভাই তার নিজস্ব স্টাইলে। ফলে পরিষদের সাধারণ কোন ঘটনাতেও ইত্তফাক- এর পাঠক মহলে অসাধারণ উত্তেজনা সৃষ্টি হতাে। তখন মনে হত সিরাজ ভাইয়ের সেই স্বতন্ত্র স্টাইল সংবাদ পরিবেশনাকে যেন একটা শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। সিরাজ ভাইয়ের আরাে একটি দূরদর্শিতা প্রায়ই লক্ষ্য করতাম। বহু আগে সরকার কর্তৃক পূর্ব বাংলার 'পূর্ব পাকিস্তান' নামকরণ করা সত্ত্বেও সিরাজ ভাই ইয়াহিয়ার আমল- অর্থাৎ বাংলাদেশ নাম হবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এ দেশকে 'পূর্ব বাংলা' হিসেবে লিখে গেছেন। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যাপারে সিরাজ ভাইয়ের মধ্যে ভাবাবেগের প্রাবল্য থাকলেও কখনাে অতিকথনের আশ্রয় নেননি তিনি। আবেগপ্রবণতাকে যথাসম্ভব সংযত রাখতেন। সিরাজ ভাই জানতেন, একটি প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রের প্রতিটি কলম-ইঞ্চি অনেক মূল্যবান। তাই অতি অল্প কথায় বেশি কিছু প্রকাশের চেষ্টা করতেন সিরাজ ভাই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সংবাদাদি সম্পাদনাও করতেন। এসব ব্যাপারে উপদেষ্টা বা শিক্ষক ছিলেন মানিক মিয়া। যে যে বিভাগেই কাজ করি না কেন, প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে অফিসে ঢুকতাম সকলে। ছাত্রজীবনে যেমন করে কড়া কোন শিক্ষকের ক্লাসে ঢুকতাম। মানিক মিয়ার রিপাের্ট পাবার জন্য তৈরি থাকতাম। কোন নিউজ মিস, ট্রিটমেন্টে ত্রুটি, এমন কি ফের অশুদ্ধির প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে মানিক মিয়া অম্লমধুর ভাষা প্রয়ােগ করতেন। এবং তাতে মাথা নত করতাম সকলে। মহান ও উচ্চ আদর্শ সামনে রেখে ত্রুটিবিহীনভাবে যার যার দায়িত্ব পালন করার দিকে সকলের আগ্রহ ও প্রচেষ্টা ছিল নিবদ্ধ। তাই যে কোনও ভুল বা গাফিলতিতে হতাে লজ্জা। মালিক বা শিক্ষকের ভৎর্সনায় নয়, সাংবাদিকতার ক্রটিতে অপরাধী মনে হতাে। সেই শিক্ষা আজ কোথায় কার কাছে পাওয়া যাবে।
আজ দেশে সাংবাদিকতা শেখার জন্যে প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। দেশে সংবাদপত্র আগের চাইতে বরং বেশিই আছে। সাংবাদিক আছেন। সাংবাদিকের ভেকধারী কিছু স্বার্থবাদী লােকও আছে। কিন্তু সাংবাদিকের ভুল ধরিয়ে দিতে কেউ নেই। সাংবাদিকতার ক্রটিতে কোন সাংবাদিককে আজ মাথা নত করতে হয় না কারাে কাছে। না কোন মালিকের কাছে, না নিজের বিবেকের
কাছে। খবরের সংখ্যাধিক্যে এবং সম্পাদনার রীতিবদলে যুক্তিগ্রাহ্য ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে সাংবাদিকদের কৈফিয়তও দিতে হয় না কারাে কাছে। শােনা যায়, ব্ল্যাকমেইল-এর ক্রমপ্রসার ঘটায় স্কুপ নিউজ আর তৈরি হয় না। কড়া কড়া সম্পাদকীয় মন্তব্যের চাবুক খেয়েও সংশ্লিষ্ট মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। সম্পাদকীয় লেখা অরণ্য রােদনেই পর্যবসিত হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আজকাল সংবাদ শিকারের জন্যে সুত্রের পিছনে রিপাের্টারদের হন্যে হয়ে ছুটতে হয় না। টেবিলে বসেই তারা রাজা-উজির মারতে পারেন কিংবা তাদের মন জোগাবার যােগ্য রিপাের্ট তৈরি করে আলতাে হাতের পিঠ চাপড়ানি পেয়ে কৃতার্থ হতে পারেন অথবা পৃষ্ঠপােষকতা নিয়ে এক ধরনের গােপন এজেন্সিও খুলে বসতে পারেন। হায়রে সাংবাদিকতা। অথচ সিরাজ ভাইকে দেখেছি, শত হুমকির মুখে অকুতােভয়, হাজার লােভের হাতছানিতে অচঞ্চল। প্রলােভন আর মােহের জাল সামনে রেখেও নির্বিকার। রাজনৈতিক দল, সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রধানের বহু লােভনীয় টোপ সিরাজ ভাই সাবধানতার সাথে এড়িয়ে চলেছেন। আজ আমাদের দেশে বিভিন্নমুখী অবক্ষয়ের মাঝে সাংবাদিকরা উল্লেখযােগ্য না হলেও বিভিন্ন মহলে যেটুকু সম্মান পান, তার মূলে পূর্বসূরী সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত দৃঢ় ও নিষ্ঠাবান চরিত্রের প্রভাব রয়েছে অনেকটা। আজকাল দেখা যায়, সাংবাদিকরা কোন বিষয় নিয়ে বার বার লিখেও সংশ্লিষ্ট মহলে সাড়া জাগাতে না পেরে হাল ছেড়ে দেন সখেদে। কিন্তু হাল ছাড়ার লােক ছিলেন না সিরাজ ভাই। দুঃস্থ মানবতার সেবার তাগিদে একবার দৈনিক সংবাদ- এর জনৈক সাংবাদিক নুর জালাল এবং আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক নূরুল ইসলামের চিকিৎসার জন্যে সিরাজ ভাই বলিষ্ঠ হাতে কলম ধরেছিলেন। দুইজনই দুরারােগ্য বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। মহাখালী হাসপাতালে ভর্তি করে নেয়ার জন্যে প্রথমে আবেদন, কাজ হলাে না দেখে রাজনৈতিক রং চড়িয়ে দিলেন, শেষে উপ-সম্পাদকীয় লিখে এমন ব্যাপক এক মানবিক আবেদন সৃষ্টি করলেন যে, কর্তৃপক্ষ তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে নিয়ে দীর্ঘদিনের সুচিকিৎসায় উভয়কে নিরাময় করেছিল। খুঁজে দেখলে এমন নজির হয়তাে আরাে পাওয়া যাবে।
শুধু চমক সৃষ্টি নয়, নিতান্ত সাধারণ একটি সংবাদকেও পরিবেশনার বৈশিষ্ট্যে সিরাজ ভাই অসাধারণের পর্যায়ে উন্নীত করতে পারতেন। উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। প্রতিদিনকার কাগজে দুয়েকটা নিখোঁজ সংবাদ হরহামেশাই ছাপা হয়ে থাকে। পাঠক মহল অনেক সময় এ খবর পড়েনই না। ফলে সমাজের কোন স্তরেই এই ছােট সংবাদ তেমন গুরুত্ব পায় না। এই আপাত গুরুত্বহীন নিখোঁজ সংবাদগুলাে সিরাজ ভাই একবার এমন আলােড়ন সৃষ্টি করলেন যে, পুলিশ বাহিনী তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন। নিখোঁজ সংবাদের সূত্র ধরেই এর পিছনে আবিষ্কৃত হলাে আন্তর্জাতিক ছেলেধরা দলের সক্রিয় কালােহাত। 'ইন্টারপােল' এর কর্মসূচিতে সম্পূর্ণ নতুন ও অভাবিতপূর্ব একটি বিষয়ের সংযােজন করে দিয়ে সিরাজ ভাই আন্তর্জাতিক সমাজের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সে কতদিন আগের কথা। আমরা তা ভুলে গেছি। কিন্তু বিদেশিরা ভোলেননি।
১৯৭৬ সালের শেষের দিকে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রখ্যাত কয়েকজন সাংবাদিক একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা কোর্সে অংশ নিতে গিয়েছিলেন সেসময়ের পশ্চিম জার্মানিতে। কোর্সের একটি বক্তৃতার বিষয় ইনভেস্টিগেটিং রিপােটিং। এই বিষয়ের উপর বক্তৃতা করতে লণ্ডনের সুবিখ্যাত 'সানডে টাইমস'- এর সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্স দৈনিক ইত্তেফাক- এর এককালীন বার্তা-সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হােসেনের নামােল্লেখ করে তার সেই আন্তর্জাতিক সাড়া জাগানাে 'ইনভেস্টিগেটিভ রিপাের্ট' দিয়ে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন। সেই কোর্সে অংশগ্রহণকারীদের অন্যতম ছিলেন বাংলাদেশ থেকে দৈনিক ইত্তেফাক- এরই রাহাত খান। জানি, হ্যারান্ড ইভান্সের সেই বক্তৃতার সময় গর্বে স্ফীত হয়ে উঠেছিল তার বুক। নিভৃতে ফেলেছেন হয়তাে দুই ফোটা আনন্দাশ্রুও। | ১৯৬২ সালের আগের কথা। ১৯৫৮-তে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। 'মােসাফিরের রাজনৈতিক মঞ্চ' বিভাগটি হয়ে গেল শুধু 'মঞ্চ'। মুখর পল্টন মূক হলাে। রাজনৈতিকভাবে বিরােধিতা করার সুযােগ না থাকায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই শুরু হলাে আইয়ুব সরকারের বিরােধিতা। ভাষা ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক সেই আন্দোলন এক সময় এমন উগ্র রূপ পরিগ্রহ করল যে, আইযুব খান পূর্ণ নতি স্বীকার করলেন না বটে, কিন্তু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর দাবি কিছুটা শিথিল করে 'ছব জবানকো মিলিজুলি কর এক পাকিস্তানি জবান' বানাবার অপরূপ ফর্মুলা পেশ করলেন। বশংবদ খাজা শাহাবুদ্দীন-মোনেম খান বাঙালি কবিকূলের প্রতি আহ্বান জানালেন 'রবীন্দ্র-সংগীত (!) রচনা'র। কিন্তু কোন কবি 'রবীন্দ্র-সংগীত' রচনায় এগিয়ে এলেন না। বাঙালিকে খুশি করার মানসে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম সফরে এসে পল্টনের এক জনসভায় বাংলায় বক্তৃতা করার আপ্রাণ কোশেশ করলেন। ব্যর্থ হয়ে এক 'খুশিকি বাত' 'অ্যালান' করলেন। উর্দুতে বললেন, "পরবর্তী প্রদেশ সফরে এলেই তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করবেন। আইয়ুবের সেই বায়বীয় প্রতিশ্রুতিতে পল্টন সেদিন ব্যঙ্গ হেসেছিল"।
বাষট্টি সনের ৩১ জানুয়ারি। জনাব সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করে রেখে পরদিনই আইয়ুব খান ঢাকা এসেছিলেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে। 'পাকিস্তানের ত্রাণকর্তা' হিসেবে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা এখানে তার ভাগ্যে জোটেনি। বরং এ দেশের সচেতন জনগণের রাজনৈতিক মৌনতা চার-চারটি বছরের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ নিয়ে আগ্নেয়গিরির আক্রোশে ফেটে পড়েছিল। হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপাের্টের প্রতিবাদ, রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের দাবিতে মুখর থেকেছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, গুলি চলেছে, মৃত্যুবরণ করেছে অনেকে। মিছিল আর হরতাল। হরতাল আর মিছিল। ওই বছরটাই শুধু ছিল হরতাল আর মিছিলের। আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে চেয়েছিলেন। বলেছেনও। কিন্তু মানিক মিয়া আর সিরাজ ভাইয়ের কলমের ভাষার কাছে তার অস্ত্রের ভাষা পরাজয় বরণ করেছে বারবার। এবং শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খান ইত্তেফাকই বন্ধ করে দিয়েছিলেন ছেষট্টির জুনে। অর্থ আর পদের প্রলােভন দেখিয়ে বশ করতে চেয়েছিলেন মানিক মিয়া আর সিরাজ ভাইকে। তাতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি।
সেই ৯২ (ক) ধারার পর থেকে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার আমল পর্যন্ত কত ধারা-উপধারা, আর সরকারি নীতির বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাককে। আবার অধিকার-বঞ্চিত জনগণের একমাত্র মুখপত্র হিসেবে তাদের কথাও বলতে হতাে। এই ধরনের সম্পূর্ণ অসম দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সিরাজ ভাই মাঝে মাঝে যে সুনিপূণ চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন, তেমন দৃষ্টান্ত শুধু আমাদের দেশেই নয়, সাংবাদিকতার জগতে অল্পই খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৬২-তে শুরু আইয়ুব-বিরােধী গণবিক্ষোভকে প্রশমিত করার জন্যে সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। গদি রক্ষার জন্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার জন্যে জাতীয় সংহতি রক্ষার ধোঁয়া-দোহাই তােলা হয়েছে। কিন্তু নাজুক অবস্থা থেকে নিস্তার নাই দেখে প্রতিবেশী ভারতের সাথে গায়ে পড়ে একটা যুদ্ধ বাঁধাবার উপক্রমণিকা হিসেবে ১৯৬৪ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে সরকারী মদদে এক বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার বুলি আউড়িয়ে পরােক্ষভাবে সরকার-ই অবাঙ্গালিদের উস্কিয়ে দেয় হিন্দু নিধন যজ্ঞে। সে দাঙ্গায় অনেক হিন্দু তাে বটেই, দাঙ্গা থামাতে গিয়ে কিছু নিরপরাধ বাঙালিও প্রাণ হারান। এদের মধ্যে আন্তর্জাতিক নজরুল ফোরামের চেয়ারম্যান জনাব আমীর হােসেন ও নটর ডেম কলেজের ঋষিতুল্য অধ্যাপক ফাদার নােভাক ছিলেন অন্যতম। ইত্তেফাক- এর ওপর হামলার আশংকা করে আমরাও অফিসে জড়াে করেছিলাম ইট-পাটকেল আর সােডার বােতল। এক নলা একটা বন্দুকও বােধ হয় জোগাড় হয়েছিল। সে কি উত্তেজনা! বিকেলের পড়ন্ত রােদে অবাঙালি গুণ্ডা মিছিলের 'ইয়া আলী' হাঁক আর ছােরা-তরবারির ঝলসিত আস্ফালন দেখে আমরাও অস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ভাগ্য ভাল, মিছিল ইত্তেফাক-এ চড়াও হয়নি। মতিঝিল ধরে এগিয়ে গিয়েছিল কমলাপুরের দিকে। এ পরিস্থিতির হয়ত আরাে অবনতি ঘটতাে। কিন্তু মানিক মিয়ার ত্বরিত উদ্যোগ ও সভাপতিত্বে 'দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি' গঠিত হয়ে দাঙ্গা বন্ধের জন্যে নয় নেতার একযুক্ত আবেদন ছাপা হলাে কয়েকটি দৈনিকে। ইত্তেফাক- এ সিরাজ ভাই তার শিরােনাম দিয়েছিলেন- 'পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও'। আর কিছু নয়, একটি। হেডিং- যা পড়ে প্রথমেই মনে হয়, এ যেন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধমান কোন সেনাদলের প্রতি সেনাধ্যক্ষের নির্দেশ। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ রমনা রেসকোর্সে বজ্রনির্ঘোষে।
মানবতাবাদী কয়েজন নেতা ও কর্মীর চেষ্টায় উত্তেজনা সেবারের মতাে প্রশমিত হয়েছিল। কিন্তু ভারতের সাথে যুদ্ধ আইয়ুব খান ঠিকই শুরু করেছিলেন। পরের বছরই। পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার কোন প্রস্তুতি না নিয়েই বরং পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর বিমান দিয়ে প্রদেশের কয়েক স্থানে বােমাবর্ষণ করিয়ে এখানকার জনমতকে তার পক্ষে নিতে এবং ভারতকে প্রথম আক্রমণকারী হিসেবে আখ্যায়িত করার অজুহাত খাড়া করে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছিল আইয়ুব খান। প্রথমত, আইয়ুব খানের এ পদক্ষেপের কঠোর সমালােচনা করলাে দৈনিক ইত্তেফাক এবং আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমানসহ কতিপয় নেতা। পরে যুদ্ধ যখন শুরু হয়ে গেলই, তখন অবশ্য তথাকথিত জাতীয় সংহতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আইয়ুবের ভ্রান্ত পদক্ষেপকেই সমর্থন করতে হলে সবাইকে। কিন্তু আইয়ুব খান ভুললেন না সেই প্রাথমিক বিরােধিতার কথা। পশ্চিমের রণাঙ্গনগুলােতে দুঃসাহসী বাঙালি সৈনিকের মৃতদেহের পাহাড় তৈরি করে ভারতীয় বাহিনীকে ঠেকিয়েছিলেন আইয়ুব খান। শেষে তাসখন্দে নাকে খত্ দিয়ে ফিরে এসে আইয়ুব খান নিয়েছিলেন স্ব-প্রদত্ত ফিল্ড মার্শাল খেতাব এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়েও জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো খুঁজে পেয়েছিলেন পরবর্তীকালে পাকিস্তানি রাজনীতিতে হিরাে হবার পথ। কিন্তু ইতিহাসের পথ বড় পিচ্ছিল। বিধান তার অমােঘ। ক্ষমাহীন। কেউ সে নিয়তিকে এড়িয়ে থাকতে পারে না। পারেন নি লৌহমানব আইয়ুব খানও। যুদ্ধ বিরােধী প্রাথমিক ভূমিকার প্রতিশােধ হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দাঁড় করিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদককে জেলে পুরে, ইত্তেফাক-এর প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে আইয়ুব খান চেয়েছিলেন পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি তার অনুকূলে রাখতে। কিন্তু বিধি ছিল তার প্রতিকূলে। ওই মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লােকেরা ক্যান্টনমেন্টে গুলি করে হত্যা করায় বাঙালি হৃদয়ের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। প্রচণ্ড গণজাগরণের জোয়ারে ইতিহাসের ছােবল খেয়ে আইয়ুব খান ভেসে গেলেন। যাওয়ার আগে ১৯৬৯- এর ২২ ফ্রেব্রুয়ারি এক আকস্মিক ঘোষণায় প্রত্যাহার করে নিলেন কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ইত্তেফাক- এর নিউ নেশন প্রেসের বন্ধ তালাও কিছুদিন আগে খুলে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার আসামী এবং গ্রেপ্তারকৃত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিনাশর্তে মুক্তি দিয়েছিলেন আইয়ুব খান। শেখ মুজিবের মুক্তিতে সেদিন দেখেছি আনন্দোদ্বেল জনতার উল্লাস মিছিল। আবেগজড়িত ভাষায় সিরাজ ভাই সেদিন লিখেছিলেন, "পূর্ব বাংলার মাটিতে অবশেষে বাস্তিলের কারাগার ধসিয়া পড়িয়াছে। জনতার জয় হইয়াছে…।"
বস্তুত পূর্ব-বাংলার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই। আইয়ুব খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে এলেন আরেক জেনারেল- ইয়াহিয়া খান। জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতিতে সত্তুরের ডিসেম্বরে নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করে আপাতত কিছুদিনের জন্য তিনি পরিস্থিতি শান্ত করলেন।
ডিসেম্বরেই পূর্ব আর পশ্চিমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ জনতার আরেক বিজয়। অভূতপূর্ব। অভাবিতপূর্ব। নির্বাচনী ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংখ্যক ভােট পেয়ে জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া সেই অপূর্ব গণজাগরণ দেখে যেতে পারে নি। '৬৯- এর পয়লা জুন তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আর সিরাজ ভাই আওয়ামী লীগের সেই নির্বাচনী বিজয়ে যে ভূমিকা পালন করলেন, তা অনবদ্য। গণজাগরণ সিরাজ ভাই দেখে গেলেও অল্পের জন্য স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখে যেতে পারলেন না। একাত্তরের ডিসেম্বর পাকবাহিনীর অত্মসমর্পনের মাঝ দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলাে। এর মাত্র পাঁচদিন আগে ১০ ডিসেম্বর রাতে হানাদার বাহিনীর দোসররা তাকে চামেলীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে নির্মমভাবে।
১৭৫৭ সালে মােহাম্মদী বেগ নিষ্ঠুরতায় হত্যা করেছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। ২৫শে মার্চের পর থেকে সেই ভয়াল ভয়ঙ্কর নয়টি মাসের প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশংকা নিয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে থাকতে পারলেও আর মাত্র পাঁচটি দিন সিরাজ ভাই বেঁচে থাকতে পারলেন না। অন্য বন্ধুদের আত্মগােপন করার পরামর্শ দিয়েও নিজে আত্মগােপন করলেন না। মৃত্যুর আশংকা নিয়েও সেই নয় মাসে ওপারে মুক্তিবাহিনীর সাথে যােগাযােগ রক্ষা করেছেন। প্রয়ােজনীয় খবর সরবরাহ করেছেন। কিন্তু পারলেন না দেখে যেতে মুক্তিসেনাদের বিজয়ােল্লাসে ঢাকা প্রবেশ। তার আগেই মীরজাফর নিয়ােজিত ঘাতকরা ধরে নিয়ে গেল তাকে। দেশপ্রেমের তাড়না, স্বাধীনতার কামনা এবং জীবন পরিণতির দিক দিয়ে সাংবাদিক সিরাজ, নবাব সিরাজের কাছাকাছি ছিলেন। নবাব সিরাজ 'পলাশীর প্রান্তরে যে রত্ন হেলায় হারিয়েছিলেন, সাংবাদিক সিরাজ সেই রত্নই খুঁজে এনে দিয়ে গেলেন বাঙালি জাতিকে। স্বাধীনতার কয়েকদিন পর কাটাসুর বধ্যভূমির তীরে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল ঐতিহাসিক সিরাজউদ্দৌলা নাটকের শেষ দৃশ্য। একে একে মনে পড়ছিল ইতিহাস। আর আমার নিজের অস্তিত্বের মতাে সত্য হয়ে মনে পড়েছিল সিরাজ ভাইয়ের সেই কথা- "পূর্ব বাংলার মাটিতে অবশেষে বাস্তিলের কারাগার ধসিয়া পড়িয়াছে।"
ভাবছিলাম বাস্তিল-চুনী ফরাসী বিপ্লবের কথা। দুনিয়া কাঁপানাে সেই বিপ্লবের পটভূমি রচনায় রুশশা আর ভলতেয়ারের লেখনী ভূমিকা পালন করেছিল, সাংবাদিক লেখক মানিক মিয়া আর সিরাজুদ্দীন হােসেনের দীপ্র লেখনীও সেই একই ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ব অর্জনের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। রুশো-ভলতেয়ার শুধু ফরাসি জাতির কাছেই নয়, সারা দুনিয়ার মানুষের হৃদয়ে এখনাে শ্রদ্ধার আসনে রয়েছেন। আবহমানকাল পেয়েও যাবেন। আর আমরা মূল্যায়ন তাে দূরের কথা, মাত্র কয়েকটি বছরের ব্যবধানে প্রায় ভুলে যেতে বসেছি মানিক মিয়া আর সিরাজুদ্দীন হােসেনকে। কিন্তু ভুলতে চাইলে কি ভােলা যায়। অন্তত এই আমি কোনদিনই ভুলতে পারব না যে, একদিন প্রতিদিন সিরাজের কাছাকাছি ছিলাম।