Published : 02 Nov 2021, 11:19 PM
১৯৭৫ সালে আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতি নজর ছিল স্বাভাবিকভাবেই। স্বাধীনতার আগে থেকেই ছাত্র আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কারণে অনেক কিছুই কাছে থেকে দেখার যেমন সুযোগ হয়েছে, তেমনি দেশের বামধারার রাজনীতির অনেক বিশিষ্ট নেতার নিকট-সান্নিধ্যে যাওয়ার সুবাদে তাদের কাছ থেকে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় জানার সুযোগও আমার হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব যে গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে তার সময়ের অন্য সব নেতাদের ছাড়িয়ে মানুষের আস্থা-বিশ্বাসের কেন্দ্রে পরিণত হয়ে উঠছিলেন সেটা তো চোখের সামনেই দেখেছি।
৬-দফা ঘোষণা, তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে জেলে পোরা, তারপর আগরতলা মামলা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, শেখ সাহেবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা, আইয়ুব খানের পতন, দৃশ্যপটে ইয়াহিয়ার আগমন, সত্তরের নির্বাচন, নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়, ইয়াহিয়া-ভুট্টোর নতুন ষড়যন্ত্র, ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা, অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ এবং সবশেষে ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া বাহিনীর বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯ মাসের মরণপণ লড়াই শেষে বিজয় অর্জন। এর প্রতিটি বিষয় চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি।
এ সময়কালের ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে সাধারণ মানুষের মনোভাবের অদলবদল যেমন দেখেছি, তেমনি রাজনীতির মোড় পরিবর্তনে কার কী ভূমিকা তা-ও দেখেছি। স্বাধীনতার আগে এবং পরের সময় যে একরকম ছিল না, থাকার কারণ ছিল না – সেটা না বুঝে কিছুটা আবেগ ও স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর ভর করে চলার খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে। মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবই আমাদের এগিয়ে চলার পথে সমস্যা তৈরি করেছে। পরাধীন দেশের রাজনীতি আর স্বাধীন দেশের রাজনীতি যে এক ধারায় চলে না, এটা আমাদের অনেকেই বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। বিরোধিতা এবং না-মানার রাজনীতি যে একটি নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের প্রয়োজন পূরণে অবদান রাখতে পারে না– এই সত্য বুঝে ওঠার আগেই আমাদের বিজয় হাতছাড়া হওয়ার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে না। তার কথা সবাই একভাবে মেনে চলছে না। তারপরও তিনি কঠোর হতে পারেননি। কারণ তিনি ছিলেন হৃদয়বান মানুষ। মানুষের ওপর ছিল তার অপরিসীম বিশ্বাস। যাদের জন্য তিনি তার জীবনের সুবর্ণ সময় জেলজুলুম সহ্য করলেন, তারা তাকে ভুল বুঝবে, তার জীবননাশের কারণ হবে, এটা তিনি ভাবতে পারেননি। এমনকি দলের মধ্যে যে ঘাপটি মারা বদমাশদের উপস্থিতি ছিল, তা জেনেও তিনি তাদের দমনের চেষ্টা করেননি। উদারতা ও উদাসীনতার ফল হয়েছে চরম বিপর্যয়।
স্বাধীনতার পর প্রথম বড় অঘটন হলো আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিভক্তি এবং তার ধারাবাহিকতায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের জন্ম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা যায়, এটা যখন বাস্তবে ঘটলো, তখন সব আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি প্রাণ ফিরে পায়। যারা ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে গেলেন, জাসদ গঠন করলেন তারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন। তারা যখন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিরুদ্ধে মুখ খুললেন, তখন আত্মগোপনকারী বা মুখ লুকানো পরাজিত ব্যক্তিরা স্বস্তি বোধ করেছে, সংগঠিত হওয়ার জায়গা পেয়েছে।
একদিকে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর 'তিন বছর কিছু দিতে পারবো না'- আহ্বানকে উপেক্ষা করে স্বাধীনতার সুফল ঘরে তোলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে মানুষের মন বিষিয়ে দিচ্ছিল, অন্যদিকে জাসদ মুজিববিরোধিতার পাগলা ঘোড়া ছুটিয়ে সব কিছু চুরমার করে দিতে মাঠে নামে।
স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় বড় অঘটন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বিশ্বস্ত সহচর তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ হাল ধরেছিলেন 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু পাড়ি' দেওয়ার। সফলও হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগে একটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল। খোন্দকার মোশতাক ছাড়া এই গ্রুপে আরও কয়েকজন ছিলেন যারা আড়াল থেকে কৌশলে খেলা খেলেছেন। তবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনকে সমর্থন করায় বিরুদ্ধবাদীরা জুৎ করতে পারেননি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে এলে তাজউদ্দীনবিরোধী চক্রটি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করার কাজটি ভালোভাবে করতে থাকে।
তাজউদ্দীন ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন অথবা পরিস্থিতির কারণে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। তার আগেই তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদও হারান। বাকশাল গঠনের পরও তিনি নেতৃত্বের বাইরেই ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ তার ঘনিষ্ঠ দু-একজনের কাছে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'আমি কি এমন অপরাধ করলাম যার জন্য বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো সম্পর্কে আমার কাছে কিছুই জানতে চাইলেন না'। সত্যি, কে বা কারা এই অবস্থা তৈরি করেছিলেন, তা এখনও জানা হলো না আমাদের। অথচ বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে এই দূরত্বের সুদূরপ্রসারী কুফল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ওপর পড়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের ইতিহাসবিদরা সত্যসন্ধানী হওয়ার গরজ বোধ করেননি। তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধু কাছে রাখতে পারেননি অথচ তাজউদ্দীনও মৃত্যুবরণ করলেন বঙ্গবন্ধুরই ঘাতকদের হাতে।
স্বাধীনতার পর মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পরিকল্পিতভাবেই বিভিন্ন গুজব এবং কেচ্ছাকাহিনী প্রচার করতে কারা উৎসাহী ও উদ্যোগী ছিল সেটাও অদেখা বা অজানা নয়। আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর সরকার সম্পর্কে কত ভাবে যে মানুষের মনে বিষ ছড়ানোর চেষ্টা হয়েছে তা লক্ষ করেছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে মানুষ ভারত কেন আমাদের মুক্ত করে দেয় না, কেন সরাসরি পাকিস্তান আক্রমণ করে না বলে আক্ষেপ করেছেন, সেই মানুষই কীভাবে ছুতানাতায় ভারতবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন, তা-ও দেখেছি। যিনি সত্তরের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নাচানাচি করে আমাদের ছাতুখোরের (আমরা ন্যাপের সমর্থক ছিলাম, ন্যাপের সভাপতি ছিলেন ওয়ালী খান, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি, তাই আমরা তার সমর্থক হওয়ায় আমাদের ছাতুখোর বলে গাল দেওয়া হতো) দল করায় তিরস্কার করেছেন, সেই মানুষকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়ে বাঙালি নিধনে ভূমিকা রাখতে দেখেছি। তিনি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন, বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, পাকিস্তান ভাঙার জন্য নয়। তাই সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে যারা ভোট দিয়েছেন, তারা সবাই স্বাধীনতার পক্ষে- এমন ঢালাও ধারণা যে ভ্রান্তিপূর্ণ তা আমি তখনই অনুভব করেছি। আবার এমন মানুষও তখনই দেখেছি, যিনি পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা পছন্দ করেন না, আবার বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করুক তা-ও চাননি। এই যে মানুষের মধ্যে নানা ছায়া সেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার প্রধান দল আওয়ামী লীগ বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হয়েছিল এ কারণে নয় যে, তিনি এক দল করেছিলেন অথবা দেশ শাসনে ব্যর্থ হয়েছিলেন অথবা দেশে দুর্নীতির বিস্তার ঘটছিল। আসলে তাকে হত্যা করা হয়েছিল তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বলেই। শেখ মুজিবের প্রতি পাকিস্তানমনাদের ক্রোধ ছিল, জ্বালা ছিল। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা বা রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে তাকে সরানোই যদি লক্ষ্য হতো তাহলে শুধু তাকেই হত্যা করা হতো। কিন্তু তা তো হয় বাহাত্তর থেকে মধ্য-পঁচাত্তর পর্যন্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। মানুষকে বিদ্বিষ্ট করে তোলার জন্য পরিকল্পিত চেষ্টা করা হয়েছে। ১৫ অগাস্টের ট্রাজেডি যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। নিজেকে রক্ষার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু ভাবনায় নেননি। কিছু যে ঘটানোর চেষ্টা চলছে, সে ব্যাপারে কোনো সতর্কতা বঙ্গবন্ধু কানে তোলেননি। এমন কি নিজের বাসস্থানের নিরাপত্তার দিকটিও উপেক্ষিত হয়েছে। এর সুযোগই নিয়েছে ঘাতকচক্র। ১৫ আগস্ট ঘটলো এবং ইতিহাসের উল্টোযাত্রা আরম্ভ হলো।
এরই ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয় ৩ নভেম্বর জেলহত্যার মতো চরম বর্বর ঘটনা। জেলের ভেতরে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর চার বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহযোদ্ধাকে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জানকে হত্যা করা হয়েছিল নিরাপদ কারাকক্ষে। আওয়ামী লীগ যাতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেটাই ছিল ঘাতকদের উদ্দেশ্য। তাজউদ্দীন আহমদ তখন ক্ষমতার বাইরে ছিলেন, তারপরও কেন তাকে হত্যা করা হলো? কারণ একটাই। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি আপসকামী ছিলেন না। তিনি শূন্যস্থান পূরণ করার ক্ষমতা রাখতেন। তিনি জীবিত থাকলে আওয়ামী লীগের হাল ধরতে পারেন। তাই তাকে হত্যা না করে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা নিরাপদ বোধ করেনি।
শেষ করতে চাই আর একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। সেটা হলো জিয়াউর রহমানের অবস্থান ও ভূমিকা। জিয়াকে বলা হয় ভাগ্যের বরপুত্র। তিনি সুযোগ খুঁজেছেন, পেয়েছেন এবং দেশের রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেছেন। জনপ্রিয়তাও কম পাননি। আওয়ামী লীগ জিয়াকে পছন্দ না করলেও অনেকেরই তিনি পছন্দের তালিকায়। ১৫ অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে মনে করে আওয়ামী লীগ। আর জিয়ার সমর্থকরা জোর গলায় বলে থাকেন ১৫ অগাস্টের ঘটনায় জিয়ার কোনো দায় নেই । কারণ তখন সেনাবাহিনী তার কমান্ডে ছিল না। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। কিন্তু জেলহত্যার বিষয়টি কি জিয়ার অজানা ছিল? সে সময় তো তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। ১৫ অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীদের কাছের মানুষ ছিলেন বলেই তো তাকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করা হয়েছিল। তিনি সেনাপ্রধান থাকতেই তো জেলহত্যার মতো নৃশংসতা ঘটেছে। তিনি কিছুই জানতেন না- এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? যদিও বলা হয়, খালেদ মোশাররফের ক্যু-চেষ্টার সময় জিয়াকে গৃহবন্দি করা হয়েছিল, ওই সময় খোন্দকার মোশতাকের নির্দেশে জেলহত্যা সংঘটিত হয়েছিল এবং ঘাতকদের নিরাপদে দেশত্যাগ করতে দেওয়া হয়েছিল।
এই বয়ান সত্য হলে প্রশ্ন আসে, খালেদ মোশাররফ ব্যর্থ হলে জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসার পরও আগস্ট ও নভেম্বরের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা জিয়া কোন নীতিনৈতিকতার জোরে করেছিলেন?
আমরা রহস্য করতে বা রাখতে পছন্দ করি। রহস্য ভেদ করতে চাই না। কিন্তু এখন বোধহয় সময় এসেছে, কিছু রহস্য ভেদ করে কঠিন সত্যের মুখোমুখী হওয়ার।