Published : 02 Nov 2021, 08:21 PM
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দমনে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি উঠেছে। সরকারি মহল থেকে তার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। ধরে নেওয়া হচ্ছে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের আশংকা কমে আসবে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। বিচার এবং দণ্ডের ভয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস করা থেকে বিরত থাকবে সন্ত্রাসীরা। এটা যদি হয়, অবশ্যই তা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
কিন্তু সমস্যাটি অন্যখানে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের অপরাধ তদন্ত যারা করবেন তারা আসলে কতখানি আসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় লালন-পালন করেন তার ওপর নির্ভর করবে বিচারের ফলাফল। যদি তদন্তকারী কর্মকর্তা বা বিচারপতি নিজে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ না হয়ে থাকেন, তাহলে তদন্ত ও বিচারের আশানুরূপ ফলাফল আসবে না। প্রকারান্তরে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিচার হবে ঠিকই কিন্তু অপরাধীরা আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে বেরিয়ে পড়বে।
একই সাথে ধর্মভিত্তিক অপরাধের নতুন সংজ্ঞায়ন এবং দণ্ডবৃদ্ধি খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের 'লাইব্রেরি অব কংগ্রেস'-এর মতে ২০১৭ সালে ৭৭টি দেশের আইনে 'ব্লাসফেমি, ধর্ম অবমাননা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও অনুরূপ আচরণ'কে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
ধর্ম অবমাননা কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার বিষয়গুলো আমাদের দেশের বিদ্যমান আইনেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে বহু বছর আগে থেকেই। দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের বিভিন্ন ধারায় ধর্ম অবমাননার যে শাস্তি ছিল ২০০৬ সালে এসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সেই শাস্তি আরো বাড়ানো হয়েছে।
কোনো ধর্মীয় স্থানের ক্ষতি সাধন, অসম্মান করা, লিখিত বা মৌখিকভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা তৈরি, অসম্মান করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় স্থানে অনধিকার প্রবেশ বা ধর্মীয় বাক্য বা শব্দের বিকৃতি ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ২৯৫-ক ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া অসৎ উদ্দেশ্যে লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য দ্বারা কিংবা দৃশ্যমান অঙ্গভঙ্গি দ্বারা সংশ্লিষ্ট ধর্মটিকে বা কারো ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অবমাননা করে বা অবমাননার চেষ্টা করে, সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিকে দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড কিংবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে।
এই ধারার অভিযোগ প্রমাণ করতে হলে প্রয়োজন:
ক. অভিযুক্ত ব্যক্তি কিছু বলেছিলেন বা কোনো শব্দ লিখেছিলেন বা কোনো ভাবভঙ্গি করেছিলেন।
খ. অভিযুক্ত ব্যক্তি ওইরকম কাজ করে কোনো ধর্মকে বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করেছিলেন।
গ. অভিযুক্ত ব্যক্তি উক্ত শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত আনার অভিপ্রায়ে ইচ্ছাকৃত এবং বিদ্বেষাত্মকভাবে করেছিলেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, কোনো কাজ ইচ্ছাকৃত হতে পারে কিন্তু বিদ্বেষাত্মক নাও হতে পারে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ২৯৫-ক ধারার অপরাধের জন্য এ দুই প্রকার অভিপ্রায়ই থাকা প্রয়োজন। অন্য কথায়, জেনে, শুনে, দেখে, বুঝে এবং বিদ্বেষাত্মকভাবে যে ব্যক্তি কোনো ধর্মকে আঘাত করে, সেই ব্যক্তি এই ধারায় দোষী হবে।
'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' ব্যাপারটি অনেক ব্যাপক এবং আপেক্ষিক। এই বিষয়ে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার অভাব রয়েছে। এমনকি, 'বিদ্বেষাত্মক' বলতে কী বোঝায় তার একটা সুস্পষ্ট আইনি সীমারেখা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। একই সাথে দাবি জানাই, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস করে অন্যের 'ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত' হেনে মাত্র দুই বছরের শাস্তির বিধান বর্ধিত করা হোক।
দণ্ডবিধির ১৫৩-ক ধারায় বলা হয়েছে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে কোনো উচ্চারিত বা লিখিত কথা দ্বারা শত্রুতার মনোভাব বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করলে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে। এই বিধানটিরও আইনি সংশোধন হওয়া জরুরী। যে লোকটি ওয়াজের মাধ্যমে অন্য ধর্মের মানুষদের বিরুদ্ধে অনবরত বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তার শাস্তি মাত্র দুই বছর হতে পারে না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হবে একটি অপরাধ।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
(৩) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয় বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১০ (দশ) বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ২০(বিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বাংলাদেশের আইন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য নয়। সব ধর্মের অনুসারীরাই তাদের ধর্মানুভূতি আহত হলে এসকল আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন। তবে সাধারণত দেখা যায়, ইসলাম ধর্মবিশ্বাসীরাই এই আইনের আশ্রয় বেশি নিয়েছেন। অথচ পরিসংখ্যান অনুযায়ী হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের ওপরেই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জের বেশি হয়েছে। কিন্তু আইন ও বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতার জন্য বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় আইনের দ্বারস্থ হওয়া থেকে বিরত থেকেছে। একই সাথে রয়েছে সাক্ষী সুরক্ষার অভাব। সংখ্যালঘু হওয়ার যাতনা থেকে মুক্তি পাওয়া এত সহজ নয় মোটেও।
তাহলে, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দমণে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর নতুন ভোর আসবে কি?