Published : 07 Sep 2021, 01:04 AM
মার্ক টোয়েনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- স্বর্গ না নরক ভালো? মার্ক টোয়েন চিন্তা না করেই উত্তর দিয়েছিলেন- কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না। কারণ দু-জায়গাতেই আমার অনেক বন্ধু বান্ধব রয়েছে!
সত্য-মিথ্যা পুরোপুরি নির্ণীত না হলেও জিম্বাবুয়ের প্রয়াত একনায়ক রবার্ট মুগাবেকে নিয়ে অনেক গুজব ছিল। তার একটা এমন- "জেল ভালো না জামিনে থাকা ভালো? মুগাবের উত্তর: দু-জায়গাতেই প্রচুর লোক আছে যারা আগে আমার দল করতো। ওরাই ভালো বলতে পারবে কোনটা ভালো। তবে আমার কথাটা ওদের বরাত দিয়ে লিখে দাও যে জেলখানাই ভালো। সরকার খাওয়া থাকার খরচ বহন করে এবং জেলে থেকে কেউ সরকারকে ডিস্টার্ব করতে পারে না।"
দার্শনিকদের অনেকে বলে থাকেন পৃথিবী নাকি একটা জেলখানা। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি বিশ্ববরেণ্য নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা সাতাশ বছর জেল খাটার পর মুক্তি পেলে বিখ্যাত একটি দৈনিক শিরোনাম করেছিল- ম্যান্ডেলা, বদ্ধ কারাগার থেকে মুক্ত কারাগারে।
পৃথিবীটা কী তাহলে মুক্ত কারাগার?
কারাগারে না যেতে হলে জামিনের দরকার হয়। জামিনের সাথে চিন্তারাম দারোগা বাবু কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট শামসুল হকের একটা 'গানগত' সম্পর্ক আছে। চিন্তারাম দারোগা বাবু জামিন দিতে চান না। আসলে চিন্তা যারে খায় প্লেটশুদ্ধা খায়, কোন জামিন নাই চিন্তার বেড়াজাল থেকে। তাই গানে আছে- 'আমার জেল হবে কি ফাঁসি হবে কিছুই জানি না/চিন্তারাম দারোগা বাবু জামিন দিলো না'।
অন্যভাবেও আছে এই গান। 'ছয়জনাতে করলো চুরি দোষী হইলো একজনা/ মিজিরিস্টার(ম্যাজিস্ট্রেট!) শামসুল হক জামিন দিল না।'
মামলা মোকাদ্দমায় জামিন দুই ধরনের। আগাম জামিন আর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন। আপনি প্রেম অথবা বিয়ে-শাদী যদি না করেন, তাহলে আপনি মুক্ত থাকবেন বলেই মানুষ ধারণা করে। এটা নাকি আগাম জামিন। আর ধুন্দুমার প্রেম বা বিয়ে নাকি পরিপূর্ণ জেল, সেখানে বিচ্ছেদ বা ছ্যাকা হচ্ছে অন্তর্বতীকালীন জামিন। তাহলে প্রত্যাখান বা ছ্যাকা খাবার 'পজেটিভ' দিকও আছে। যেমন আছে জামিনেরও। 'জামিন হয়েছে' শব্দযুগল আমাদের মধ্যে তেমন প্রচলিত নয়। বরং আমরা বেশি করে বলি যে- 'জামিন পেয়েছে'। মানে হতে পারে জামিন একধরনের প্রাপ্তিযোগ। যেন মুক্ত থাকার শর্তসাপেক্ষ ও সাময়িক আনন্দ আদেশ।
আর আছে রিমান্ড। যদি কেউ গ্রেপ্তার হওয়ার পর একদিনের ভেতর তদন্ত কাজ শেষ না হয় তবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ বা অধিকতর তদন্তের জন্য রিমান্ড চাওয়ার বিধান রয়েছে এবং ১৫ দিন পর্যন্ত রিমান্ড চাওযা যেতে পারে। পুলিশ রিমান্ড চায় এবং রিমান্ড নিয়ে বহু বেদনার গল্প প্রচলিত আছে। রিমান্ডের বাংলা 'পুলিশ হেফাজতে থাকা'। সারাবিশ্বে পুলিশি হেফাজতে যেমন মৃত্যুর ঘটনা আছে তেমনি আছে নির্যাতনের কিছু গা শিউরে ওঠা বর্ণনা। এর ভেতর গিটা থেরাপি, কম্বল থেরাপি, বাদুড় থেরাপি, জল থেরাপি, ডিম থেরাপি ও ইলেকট্রিক শক থেরাপির ঘটনা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। ইলেকট্রিক শকের আরেক নাম 'ডিস্কো ডান্স' পদ্ধতি। শক খেয়ে আসামি যেভাবে তড়পায় সেটাই নাকি ডিস্কো ডান্স। গিটা থেরাপি হলো- গিটায় গিটায় পুলিশের পেটানো, মারা হবে মাগার রক্ত বের হবে না। কম্বল প্যারেড করানো হয় গরমের সময়। ঘামতে ঘামতে আসামীর অবস্থা শেষ হয়ে যায়। আর ওয়াটার থেরাপি ভয়ংকর এক প্রথা। নাক-মুখে গরম বা ঠাণ্ডা পানি ঢালা হয় অনর্গল, স্বীকার না করে কোনও উপায় আছে? আছে গরম বা ঠাণ্ডা পানি ভর্তি বোতল দিয়ে পেটানো। উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানোর যে থেরাপি সেটার নাম বাদুড় থেরাপি। আর আছে বিখ্যাত ডিম থেরাপি।
ভয়ংকর এক আসামীকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তার জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এমন সময়ে থানায় এসেছে মানবাধিকার সংস্থার লোকজন। তারা আসামীর কাছে জানতে চাইলো কী খবর আপনার? আসামী জানালো- এরা ডিম খুব ভালোবাসে। দুইবেলা গরম ডিম দেয়। কথায় কথায় তাই বলা হয় মানুষ ডিম কেনে খেতে আর পুলিশ কেনে দিতে।
দর্শনগত দিক থেকে জামিনের মতো রিমান্ডও ফেলনা নয়। মৃত্যু পরবর্তীকালে স্বর্গ ও নরকে যাবার জন্য যে পাপ-পুণ্যের বিচার সেটা আসলে বিধাতার রিমান্ড। ছোটকাল থেকেই মানুষের জীবন কাটে রিমান্ডে। শিশুকালে মানুষ থাকে বাবা মা আর পরবর্তীকালে স্কুলের শিক্ষকদের রিমান্ডে। কলেজ ইউনিভাসিটিতেও শিক্ষক আর প্রেমিক বা প্রেমিকার রিমান্ডে থাকতে হয়। চাকরি আর বিবাহিত জীবনে অফিসের বস আর বউয়ের রিমান্ডে কাটে জীবন। অবসরের পরেও সুখ নেই। সেখানে ছেলে মেয়েদের রিমান্ডে কাটে বৃদ্ধ বাবা-মা এর জীবন। আর পরকালের নাকি পুরোটাই জিজ্ঞাসাবাদ বা রিমান্ড, শেষমেষ শেষ বিচার এবং স্বর্গ বা নরক লাভ।
রিমান্ড নিয়ে যেমন বেদনা বা ভয়ের গল্প আছে, আছে যেমন দার্শনিক তত্ত্ব,তেমনি গালগপ্পো বা কৌতুকও কম নেই। হাল আমলে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিয়োগের জন্য এক 'ভাইবার গল্প' সারাদেশে ভাইরাল হয়েছিল। একজন এসপি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন একজন সাব-ইনসপেক্টর পদপ্রার্থীর। এসপি জিজ্ঞাসা করলেন- গীতাঞ্জলী কে লিখেছিলেন? এসআই পদপ্রার্থী কিছু বলার আগেই কর্কশ স্বরে টেলিফোন বাজলো। এসপি সাহেব 'স্যার' 'স্যার' বলে সবকিছু শুনলেন। এরপর একজন ইনসপেক্টরকে ডেকে বললেন- ওর কাছ থেকে জেনে নাও গীতাঞ্জলী কে লিখেছিলেন?
একথা বলেই বেরিয়ে গেলেন এসপি সাহেব। ফিরলেন কয়েকঘণ্টা পর।এসে দেখলেন এসআই পদপ্রার্থীর অবস্থা খুব খারাপ। উঠে দাঁড়াতেও পারছে না। ইন্সপেক্টর দম্ভ ভরে বললেন- "স্যার আমি যতবার জিগাই গীতাঞ্জলী কে লিখছে, ক্রিমিনালটা বলে, 'স্যার আমি লিখি নাই, রবীন্দ্রনাথ লিখেছে'। এরপর রিমান্ডে নেওয়া মতো করে দিলাম নলি ছুটাইয়া। এখন কয় সেই লিখছে গীতাঞ্জলী আর এই কাজে তারে সাহায্য করছে তার ভাই।"
আসলে পুলিশ রিমান্ডের এ গল্প নতুন নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা ভোলার নয়। সেখানকার একদলীয় শাসন ও পুলিশি ঘটনা নিয়েও প্রচুর গল্প আছে। আগে লেখা সাব-ইন্সপেক্টর পদপ্রার্থী ও রবীন্দ্রনাথের গল্পের আইডিয়া নিচের গল্প থেকেই এসেছে।
মেজর সাহেব ক্লাশে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার মেজাজ খিচড়ে গেল। দরোজার পাশেই সিগারেটের পুচ্ছাংশ জ্বলছে। মেজর সাহেব চিৎকার করে বললেন- কে খেয়েছে সিগারেট? কে? কেউ কোন উত্তর দিল না। মেজর সাহেব ক্লাশে না ঢুকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকের কাছে গিয়ে নালিশ করলেন। পরদিন সকালে তাকে জানানো হলো- এগার জন ওই সিগারেটটা খেয়েছিল বলে রিমান্ডে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।
অন্যরকম রিমান্ডের গল্পও আছে। আজ তেমন একটা গল্প বলে এই লেখা শেষ করা যায়। জন আর জেরিনের বিয়ে হয়েছে দশ বছর। তাদের ছেলেমেয়ে হয়নি। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন জনের পক্ষে বাবা হওয়া সম্ভব না। জেরিন এক ভণ্ড পীরের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। পীর সাহেব তাকে রিমান্ডে নিয়ে বললেন- "বাচ্চা হবে। অবশ্যই হবে। শুধু মাঝে মাঝে এসে আমার রিমান্ডে থাকতে হবে।"
দু-বছর পর জেরিনের সন্তান হলো। পাড়া-পড়শি আত্মীয় স্বজন সবাই বেজায় খুশি। শুধু জন মন খারাপ করে জানতে চাইলো- পীর সাহেব যে তোমাকে রিমান্ডে নিয়েছিলেন সেখানে কী পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল? হোমিওপ্যাথি না এলোপ্যাথি?
জেরিন মজা করে উত্তর দিল- সিমপ্যাথি।
জামিন আইনের মারপ্যাচে আর রিমান্ড নাকি জিজ্ঞাসাবাদের নির্মমতায় বন্দি। এখানে আর যাই থাকুক বিশেষ করে যারা স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের জন্য কোন 'সিমপ্যাথি' নেই। আইনের কাছে তারা মাকড়সার জালের মতো বন্দি হয়ে যায়।