Published : 20 Aug 2021, 01:02 AM
১৯৩০ সাল থেকে প্রতি বছর অগাস্টের ২০ তারিখে 'বিশ্ব মশা দিবস' হিসেবে পালিত হচ্ছে। 'বিশ্ব মশা দিবস ২০২১' এর প্রতিপাদ্য 'শূন্য ম্যালেরিয়া লক্ষ্যে পৌঁছানো'। ('Reaching the zero malaria target') ।
মানুষের বিভিন্ন ভয়াবহ অসুখের মধ্যে মশা বাহিত ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া, জিকা, ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস উল্লেখযোগ্য। তাই মশাবাহিত রোগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে বিশেষভাবে সচেতন করার জন্য এই দিবস সারা বিশ্ব জুড়ে পালিত হয়। মশাবাহিত রোগ থেকে সাবধান হওয়ার জন্য, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এই দিনে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয়।
মশাবাহিত রোগ হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের ইতিহাসে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। উনিশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারেনি যে মশা রোগের ভেক্টর ছিল। প্রথম সাফল্য আসে ১৮৭৭ সালে যখন ব্রিটিশ ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসন আবিষ্কার করেছিলেন যে একটি কিউলেক্স প্রজাতির মশা মানুষের ফাইলেরিয়াল রাউন্ডওয়ার্ম বহন করতে পারে। পরবর্তী দুই দশকে তিনি এবং ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য গবেষকরা ম্যালেরিয়াতে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন, যা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলিতে একটি প্রধান ঘাতক। তারা আস্তে আস্তে মানুষ এবং মশার মধ্যে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ এবং জীববিজ্ঞানের জটিল সমীকরণ বুঝতে শুরু করেন।
১৮৯৪ সালে, ম্যানসন ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের সম্ভাব্য ভেক্টর হিসেবে 'মশা বিষয়ক অধ্যয়ন' করতে ভারতীয় মেডিকেল সার্ভিসের মেডিকেল অফিসার রোনাল্ড রসকে রাজি করান। বছরের পর বছর নিরলস গবেষণার পর রস শেষ পর্যন্ত ১৮৯৭ সালে প্রমাণ করেন যে অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া পরজীবী বহন করতে পারে। তিনি তার আবিষ্কারের দিন, ২০ অগাস্ট, ১৮৯৭-কে 'মশা দিবস' বলে অভিহিত করেছিলেন। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন পরে তার আবিষ্কারের তাৎপর্য চিহ্নিত করতে ২০ অগাস্ট বিশ্ব মশা দিবসের নামকরণ করেন, যা প্রতি বছর পালিত হয়।
অ্যানোফিলিস মশার সাথে এ জটিল যোগসূত্রটিও দেখিয়েছে যে মশার কামড় রোধ এবং মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা– ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ– ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে তারমধ্যে বর্তমান ঢাকাতে আমরা পাই ১৪ প্রজাতির। উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া থাকার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। বাংলাদেশ মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস।
১৯৬৪ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত হলেও সেটিকে তখন 'ঢাকা ফিভার' বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ আক্রান্ত হন। এরপর প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গু হয়েছে তবে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেশবাসী সবচেয়ে বেশি দেখেছে ২০১৯ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব অনুযায়ী এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ১৭৯ জন মারা যান। ২০২১ সালের অগাস্ট মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ২৬ জন মারা গেছেন। ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী, এডিস মশার দুটি প্রজাতি। যার একটি হলো এডিস ইজিপ্টি, আরেকটি হলো অ্যালবোপিকটাস। এডিস ইজিপ্টিকে শহরে মশা বা নগরের মশা অথবা গৃহপালিত মশা বলা হয়। আর অ্যালবোপিকটাসকে বলা হয় এশিয়ান টাইগার মশা অথবা গ্রামের মশা। এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে জন্মায় ও বর্ষাকালে এর ঘনত্ব বেশি হয়। তাই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এ সময়টায় বেড়ে যায়।
২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে যেটি ডেঙ্গুর মত একটি রোগ। এ রোগটি চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্ত হয়। ঢাকাতে সবচাইতে বেশি চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয় ২০১৬–২০১৭ সালে।
বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীব্যাপী মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হলো ম্যালেরিয়া। অ্যানোফিলিস মশার সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এর মধ্যে চারটি প্রজাতিকে প্রধান বাহক বলা হয়। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা এবং বর্ডার এরিয়ার মোট ১৩ জেলায় ৭২ টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০০০ সালের পর সবচাইতে বেশি ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ২০০৮ সালে । ২০০৮ সালে ৮৪ হাজার ৬৯০ জন মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন এবং ১৫৪ জন মারা যান। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এ সংখ্যাটি কমে রোগী হয় ১৭ হাজার ২২৫ জনে। ম্যালেরিয়া বাহক অ্যানোফিলিস মশা গ্রীষ্ম–বর্ষায় বেশি জম্মায় এবং এ সময়ে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
ফাইলেরিয়া রোগে মানুষের হাত–পা ও অন্যান্য অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। স্থানীয়ভাবে এই রোগটিকে গোদ রোগ বলা হয়। ফাইলেরিয়া বাংলাদেশের উত্তর–পশ্চিম– দক্ষিণের প্রায় ৩৪টি জেলাতে কম বেশি পাওয়া যায়। একসময় এরোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল তবে বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ফাইলেরিয়া এলিমিনেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। ফাইলেরিয়া নেমাটোড জাতীয় কৃমি; ইউচেরিয়া ব্যানক্রফটি বাহিত মশার দ্বারা সংক্রমিত হয়। কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি ও ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে বাংলাদেশ এ রোগ ছড়ায়।
জাপানিজ এনসেফালাইটিস নামক মশাবাহিত একটি রোগ বাংলাদেশে হয়ে থাকে। এ রোগটি কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এ রোগটি বাংলাদেশের প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৭৭ সালে মধুপুর বন এরিয়া থেকে। এরপর বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী–রংপুর চট্টগ্রাম খুলনা অঞ্চলে এই রোগটি পাওয়া যায়।
সারা বিশ্বব্যাপী মশা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মশা ও মশা বাহিত রোগ সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলা। মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারি–বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ের সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। করোনাভাইরাস অতিমারীর এ সময়ে ডেঙ্গু যেন আমাদের কারো পরিবারে আর হানা দিতে না পারে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সপ্তাহে একদিন আমরা আমাদের বাড়ির ভেতর এবং বাইরে ঘুরে দেখি কোথাও কোন পাত্রে পানি জমা আছে কিনা, যদি থাকে তাহলে সেটি ফেলে দেই অথবা উল্টিয়ে রাখি অথবা সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। সাধারণ মানুষের সচেতনতা এবং সম্পৃক্ততা মশা নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে এবং মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকবে পরিবার ও দেশ।