Published : 19 Aug 2021, 09:55 PM
তালেবান কর্তৃক মার্কিন ও পশ্চিমা সমর্থিত আশরাফ গানির 'ইসলামিক স্টেট অব আফগানিস্তানের' পতন ঘটবার পর বাংলাদেশের প্রায় সব ঘরানার 'ইসলামপন্থি'দের কাছে এটি তাদের রাজনীতির বিজয় বলে মনে হয়েছে।
রাজনীতিতে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়া 'ইসলামপন্থি'রা আঞ্চলিক এবং জাতীয় রাজনীতির সমীকরণের দিকে না তাকিয়ে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে এক ধরনের আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন। এটি অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, তালেবানদের হাতে কাবুলের পতন তাদের নৈতিক মনোবল বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ইতোমধ্যে "ইসলামপন্থি" দল এবং গোষ্ঠীগুলোর সাথে যুক্ত, জাতীয় রাজনীতি নিয়ে হতাশগ্রস্ত কিছু তরুণ সেই আশির দশকের মত তালেবানদের সাথে যোগ দেবার জন্য আফগানিস্তান যাবার চেষ্টা করেছেন—কেউ কেউ আবার দেশ থেকে বের হয়ে যেতেও সমর্থ হয়েছেন।
বহু দল এবং উপদলে বিভক্ত 'ইসলামপন্থি'দের কাছে শিয়া ইরান নয়, তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান একটি 'মডেল রাষ্ট্র'। দলের ম্যানিফেস্টোতে যাই লেখা থাকুক, এ সমস্ত দলের সাথে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীদের বড় অংশটি তালেবানি শাসনকে মডেল ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র এবং সমাজের 'শরীয়া-ভিত্তিক' রূপান্তর ঘটাতে চান। এখন প্রশ্ন হল, তালেবানদের এ বিজয় তাদের স্বপ্ন পূরণের সহায়ক, না প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে?
'ইসলামপন্থি'দের প্রভাবে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের অনেকেও তালেবানদের হাতে কাবুলের পতনে উল্লসিত। তালেবানদের এ আপাত বিজয় বিএনপির রাজনীতির জন্য ইতিবাচক, না এটি আগামী দিনে তাদের রাজনীতিকে আরো কঠিন করে তুলবে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আফগানিস্তান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে সোভিয়েত বাহিনীর আফগানিস্তানে উপস্থিতির সময় থেকে। এর আগে নানাভাবে আফগানিস্তানের সাথে যোগাযোগ থাকলেও রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা ছাড়া এ দেশটির খুব একটা গুরুত্ব বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছিল না।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশের পর থেকে পরস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাবশালী প্রভাবক না হলেও, মার্কিন- সোভিয়েত-চীন-ভারতের পাশাপাশি আফগানিস্তানও বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা ভাবে আলোচিত হতে শুরু করে। 'ইসলামপন্থি'রা বিশেষত জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির, আফগানিস্তানে সোভিয়েত উপস্থিতিকে পুঁজি করে রাজনীতিতে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। জামায়াতসহ 'ইসলামপন্থি'দের ভূমিকা আফগান প্রশ্নে মার্কিন নীতির সহায়ক হয়।
'ইসলামপন্থি'দের এ ভূমিকা জেনারেল জিয়া এবং এরশাদ—এ দুই সামরিক শাসকের রাজনীতিরও সহায়ক হয়। পূর্বের সরকারের ভারত-সোভিয়েত ঘেঁষা নীতি থেকে বের হয়ে এসে জিয়াউর রহমান দেশকে মার্কিন-চীনমুখী করেন। সামরিক শাসক এরশাদও সেই একই পথে হাঁটেন। সোভিয়েতবিরোধী চীনের দিকে ঝুঁকবার কারণেই প্রায় সব ঘরানার 'চীনপন্থি'দের সমর্থন পান জিয়া ।
সবকিছু ঠিকমত জিয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ীই চলছিল। 'ইসলামপন্থি'রা সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগান নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। জনগণের একটা বড় অংশ মার্কিন এবং 'ইসলামপন্থি'দের সুরের সাথে সুর মিলিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েতের ভূমিকাকে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর 'নাস্তিক্যবাদী' কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের আগ্রাসন হিসেবেই দেখছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ভিন্ন সুরে কথা বলে উঠে সিপিবি।
'মস্কোপন্থি' হিসেবে পরিচিত দলটি প্রচলিত প্রভাবশালী চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েতের ভূমিকাকে 'সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদী' দায়িত্ব বলে সমর্থন করে। শুধু তাই নয়, দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ নারায়ণগঞ্জে এক জনসভায় বাংলাদেশে আফগান স্টাইলে বিপ্লব ঘটান হবে বলে হটকারীভাবে বক্তব্য রাখেন।
এটি একটা মাঠের বক্তৃতা হলেও জিয়া একে খুব সিরিয়াসলি নেন। তার বিরুদ্ধে একের পর এক ক্যু সংগঠিত হবার ফলে এমনিতেই তিনি মানসিকভাবে ভীত ছিলেন। এর ওপর হঠাৎ এ ধরনের বক্তব্যে তিনি শঙ্কা বোধ করেন।
যেহেতু এর আগে জাসদের গণবাহিনীর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাই তিনি সন্ত্রস্ত বোধ করেন এ ভেবে যে, আরেকটি বামপন্থি দল হয়ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে। বস্তুত এ চিন্তার ফলেই তিনি কমরেড ফরহাদকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাবন্দি করেন।
আফগানিস্তানকে কমিউনিস্ট শাসন মুক্ত করবার জন্য মার্কিন অর্থ এবং অস্ত্র প্রাপ্ত মুজাহিদরা 'বিশ্ব জেহাদের' ডাক দেয়। সারা বিশ্ব থেকে এ জিহাদে মুসলিম তরুণদের অংশগ্রহণ করবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার চালায়।
ওই সময় আশির দশকে 'জেহাদের' ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ থেকেও বেশ কিছু তরুণ আফগানিস্তানে পাড়ি জমায়। এরশাদের প্রছন্ন সমর্থন এদের আফগানিস্তান যেতে সাহায্য করে। প্রায় ৮০ টির মত দল উপদলে বিভক্ত মুজাহিদ বাহিনীর হাতে ১৯৯২ সালে ড. নজিবুল্লাহ সরকারের পতনের পর এ তরুণরা দেশে ফেরত আসতে শুরু করে। উল্লেখ্য, সোভিয়েত বাহিনী দেশ ছেড়ে চলে যাবার প্রায় আড়াই বছর পরে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর ড. নজিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটে।
এ আড়াই বছর পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তানের (পিডিপিএ) সদস্যরা মুজাহিদ বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে সমর্থ হয়। কিন্তু এ কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাতের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো পশ্চিমা দুনিয়া এবং সৌদি আরব, পাকিস্তানসহ আরব উপসাগরের ধনী দেশগুলি সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালায়। মুজাহিদদের অর্থ, অস্ত্র, গোয়েন্দা সহযোগিতা, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা ইত্যাদির পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি করা হয়।
এত কিছুর পরেও পিডিপিএর সদস্যরা তাদের লড়াই জারি রাখে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়। যার ফলে শেষ পর্যন্ত তারা মুজাহিদদের সাথে টিকে থাকতে পারেনি।
কিন্তু নজিবুল্লাহ আশরাফ গানির মত পালিয়ে যান নাই। পরে তিনি কাবুলে জাতিসংঘের কম্পাউন্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তালেবনরা যখন এ মুজাহিদ বাহিনীকে কাবুল থেকে ১৯৯৬ সালে উৎখাত করে, তখন তারা নজিবুল্লাহকে ধরে এনে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে হত্যা করে তার লাশ কয়েকদিন রাস্তায় ঝুলিয়ে রাখে।
নজিবুল্লাহর কমিউনিস্ট সরকার যেখানে সোভিয়েত বাহিনীর সাহায্য ছাড়া প্রায় আড়াই বছর মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারল, সেখানে মার্কিন সেনারা কাবুল ত্যাগ করবার পূর্বেই আশরাফ গানির সরকারের পতন ঘটল কেন?
আমেরিকান অস্ত্রে সজ্জিত গানির সেনাবাহিনীর সংখ্যা তিন লাখের মতো। বিমান বাহিনীও ছিল তাদের। অন্যদিকে তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ হাজারের মতো, যাদের হাতে গানির বাহিনীর মত এত আধুনিক অস্ত্র নেই।
গানির সরকারের তালেবান যোদ্ধাদের সাথে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পেরে না উঠবার কারণ খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন আমেরিকান সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কার্টার মাকাসিয়ান তার জুলাই মাসে প্রকাশিত গ্রন্থ The American War in Afghanistan: A History তে। এ গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন তালেবান যোদ্ধাদের মূল শক্তি তাদের নৈতিক মনোবল, যুদ্ধাস্ত্র নয়।
এটি তিনি বুঝেছেন বিভিন্ন তালেবান যোদ্ধাদের সাথে কথা বলে। তিনি লিখেছেন, তালেবানরা জান্নাতে যাবার জন্য এবং গাজী হবার জন্য যুদ্ধ করে। অপরদিকে, গানি সরকারের সৈন্যরা যুদ্ধ করে অর্থের জন্য। বস্তুত এ নৈতিক মনোবলের অভাবের জন্যই গানির এত বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনী তালেবানদের সামনে টিকে থাকতে পারেনি।
আবার এ নৈতিক মনোবলের জন্যই নজিবুল্লাহর কমিউনিস্ট সরকার পশ্চিমা দুনিয়া এবং পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের বিপুল সমর্থন পুষ্ট মুজাহিদ বাহিনীকে সোভিয়েত সাহায্য ছাড়া ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল আড়াই বছর। নৈতিকতাবিহীন মুজাহিদ বাহিনী নজিবুল্লাহকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করবার পর ব্যাপক লুটপাট, দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়। তাদের প্রথম শাসনামলে ব্যাপক নারী ধর্ষণ থেকে শুরু করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জন্ম লাভ করে।
এতে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনীর একটা অংশ বের হয়ে গিয়ে কান্দাহারে তালেবান বাহিনী গঠন করে। তারা পাকিস্তানের সাহায্য এবং সমর্থন নিয়ে খুব অল্প সময়ের মাঝে মুজাহিদদের 'ইসলামিক স্টেট অব আফগানিস্তানের' পতন ঘটিয়ে 'ইসলামিক এমিরেট অব আফগানিস্তান' প্রতিষ্ঠা করে।
এসময় থেকেই জামায়াতসহ বাংলাদেশের 'ইসলামপন্থি'রা শ্লোগান দিতে থাকে, "আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান।" বিশ্বব্যাপী সুন্নি-ওয়াহাবী ধারার 'ইসলামপন্থি'রা প্রথমবারের মত আধুনিক সময়ে একটি 'শরীয়া-ভিত্তিক' ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্রের মডেল খুঁজে পায়। ৯/১১ এর পরে মার্কিন বাহিনী এবং পশ্চিমা বিশ্ব তালেবানি শাসন উচ্ছেদ করে আবার তাদের প্রিয় মুজাহিদদের ক্ষমতায় বসায় এবং 'ইসলামিক স্টেট' পুনর্প্রতিষ্ঠা করে।
মুজাহিদ এবং তালেবানের মধ্যে পার্থক্যটা আসলে কোথায়? দুই পক্ষই 'ইসলামপন্থা'র রাজনীতি করে। উভয়েই সশস্ত্র পন্থায় দুইবার ক্ষমতা দখল করেছে, 'ইসলামী রাষ্ট্র' কায়েম করেছে এবং তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী শরীয়া আইনের প্রয়োগ ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের পার্থক্যের তুলনাটা জামায়াত আর হেফাজতের মাঝে যে তফাত—অনেকটা সেরকম।
জামায়াতের অনেকেই যেমন শরীয়া আইনের কথা বলেও পাশ্চাত্যের স্টাইলে জীবন যাপন করে—মুজাহিদদের অনেকেই তাই। অপরদিকে, তালেবানরা অনেকটা হেফাজতের মত ট্র্যাডিশনাল পোশাক, আধুনিক জীবন-যাপন বিমুখ এবং শরীয়া আইনের অধিক রক্ষণশীল ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে আগ্রহী। জামায়াতের মত মুজাহিদরাও মার্কিন এবং পশ্চিমা দুনিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত। অপরদিকে, পশ্চিমা দুনিয়া এবং সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে বিকশিত হয়েছে তালেবান আন্দোলন।
৯/১১ পরবর্তী হামিদ কারজাই, আশরাফ গানির নেতৃত্বে মুজাহিদদের শাসন অনেকটা শিয়া ইরান ধাঁচের। তবে তাদের দ্বিতীয় মেয়াদের ২০ বছরের শাসনেও তারা ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির পুনর্জন্ম দেয়। এর পাশাপাশি যে মুজাহিদরা এক সময় অনেকের কাছে মুক্তিসংগ্রামী হিসেবে প্রতিভাত ছিল, সেই তারাই জনগণের বড় অংশের কাছে আমেরিকার দালাল এবং নব্য-উপনিবেশবাদের দোসর হিসেবে প্রতিভাত হয়।
ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এতে তাদের প্রতি বিরক্ত এবং বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে। মুজাহিদ বিরোধী আর কোন বিকল্প শক্তি না পেয়ে তারা তালেবানদের সমর্থন করে। ফলে প্রথমবার শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশতুন জাতিগোষ্ঠী নির্ভর তালেবান বাহিনী ক্ষমতা দখল করলেও, এবার তারা তাদের সমর্থন, সদস্য এবং নেতৃত্ব তাজিক, উজবেক এবং অন্য জাতিগোষ্ঠীর মাঝেও বিস্তার ঘটাতে সমর্থ হয়েছে।
তালেবানরা নারীর প্রতি আগের মত আচরণ করবে কিনা, এ বিষয়টা নিয়ে পাশ্চাত্যের মিডিয়া কাবুলের পতনের পর সরব হয়ে উঠেছে। অথচ সেই তারাই কমিউনিস্টরা যখন ক্ষমতায় এসে আফগানিস্তানের মত একটি অতীব রক্ষণশীল সমাজে আইন করে নারী-পুরুষের সমনাধিকার ঘোষণা করে, তখন এর বিরোধিতা যারা করেছিল, সেই মুজাহিদ বাহিনীকে অকুণ্ঠ সমর্থন করেছিল।
শুধু কাগজে কলমে নয় বাস্তবে নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসারসহ সব ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত করবার ফলেই কমিউনিস্ট আমলে আফগান সমাজে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। এ বিষয়টাতে হাত না দিয়ে সমাজে নারীর অধস্তনতার রক্ষণশীলতা বজায় রাখলে কমিউনিস্টদের এত ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হত না। কিন্তু একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে তারা সমাজকে ধাক্কা, দিয়েছিলেন, এর পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাদশাহ আমানুল্লাহ খানও। তিনিও স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সমাজকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন—যার খেসারত তাকেও দিতে হয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত হয়ে। আমানুল্লাহ খানের উদাহারণ থাকা সত্ত্বেও কমিউনিস্টরা রিস্ক নিয়েছিল এবং পরিণতিতে তার মতই ব্যর্থ হয়েছিল।
কমিউনিস্টরা আফগানিস্তানে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসেনি। তারা বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করেছিল। সব সংস্কার উপর থেকে সমাজের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আফগান ইতিহাসে বর্তমান তালেবান পর্যন্ত কোন শাসকই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসেননি।
আফগানিস্তানে ক্ষমতার পরিবর্তন সব সময় গায়ের জোরেই হয়েছে। সমাজ সংস্কার থেকে শরীয়া আইন, সব কিছুই উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মার্কিনিরাও বলপূর্বকই তাদের পুতুল মুজাহিদ সরকারকে ৯/১১ এর পর কাবুলে বসিয়েছিল।
মুজাহিদ এবং তালেবানদের সাথে কমিউনিস্টদের মূল পার্থক্য যে জায়গাটাতে সেটা হল তারা নারী-পুরুষের সমঅধিকারে বিশ্বাসী এবং সেক্যুলার। আর মিলের জায়গাটা হল মুজাহিদ এবং তালেবানদের মত তারাও অগণতান্ত্রিক ছিল।
পশ্চিমা আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে পুঁজিবাদ, সেক্যুলারিজম এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে। আমেরিকাসহ সারা পশ্চিমা দুনিয়া সারা পৃথিবীকে এ রূপেই দেখতে চায়। সুতারাং এটা আশা করাই স্বাভাবিক ছিল যে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে তারা আফগানিস্তানে সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক পক্ষকে মদদ দিবেন।
কিন্তু সেটা না করে তারা এমন রাজনৈতিক পক্ষকে মদদ দেয়, যারা পশ্চিমা রাজনৈতিক মূল্যবোধের বিরোধী মতবাদকে ধারণ করে। শুধু তাই নয়, এ মতবাদের বিকাশের ভিত্তিভূমি তৈরি করবার জন্য USAID এর অর্থ সহায়তায় নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারী-স্বাধীনতা বিরোধী মাদ্রাসার সিলেবাস তৈরি করে—যা এখন বিভিন্ন তালেবান মাদ্রাসার পাঠ্য।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্থক্যের জায়গাটা এখানেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন সারা দুনিয়াতে তাদের প্রভাব বলয় বিস্তার করতে চেয়েছে তাদের মতাদর্শ অনুসারী মানুষজনের ওপর নির্ভর করে। আর আমেরিকা আফগানিস্তানসহ অনেক দেশেই চেষ্টা করেছে এমন পক্ষের ওপর নির্ভর করে, যারা পশ্চিমা মতাদর্শের ঘোর বিরোধী। মুসলিম প্রধান দেশগুলিতে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির ব্যর্থতার এটি অন্যতম কারণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির ইতিহাস হচ্ছে ব্যর্থতার ইতিহাস। একের পর এক তারা ব্যর্থ হয়েছে কোরিয়াতে, ভিয়েতনামে, কম্বোডিয়াতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া থেকে শুরু করে ইরানে।
বিশ্ব রাজনীতির জটিল সমীকরণ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে না পারা হচ্ছে এসব ব্যর্থতার মূল কারণ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে মার্কিন অজ্ঞতা কতটা প্রবল সেটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন দীর্ঘ ২০ বছর আফগানিস্তানে থেকেও তারা বুঝে উঠতে পারেনি, তালেবানরা সামরিকভাবে কতটা শক্তিশালী অথবা তারা চলে গেলে, আশরাফ গানির পুতুল সরকার কতদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনাম বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই তাদেরকেই আজকে সায়গনের চেয়েও খারাপ অবস্থায় কাবুল ছাড়তে হচ্ছে। কাবুল না ছেড়ে তাদের সামনে আর কোন উপায় খোলা ছিল না।
মার্কিন অর্থনীতি কোভিড মহামারী মোকাবেলার ব্যর্থতার কারণে সংকুচিত হয়েছে ১৯ শতাংশের বেশি। তার উপর গত বিশ বছরে 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের' নামে ইরাক এবং আফগানিস্তানে ব্যয় করা হয়েছে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার। কয়েক হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে বিপুল সংখ্যক সৈন্য।
মার্কিনিদের 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের' ব্যস্ততায় বিশ্ব রাজনীতিতে সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে উঠে এসেছে রাশিয়া এবং চীন। এ বিষয়টা মার্কিন প্রশাসনকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। ফলে তারা যেকোনওভাবে ইরাক, আফগানিস্তান থেকে বের হবার পথ খুঁজতে থাকে।
'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ'কে প্রতিস্থাপন করে রাশিয়া, চীনকে প্রধান শত্রু ধরে নতুন সমর নীতি প্রণয়ন করেন ট্রাম্প। ইরাক, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ছকও তৈরি করেন তিনি। বস্তুত, তার দেখানো পথ ধরেই বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন।
আফগানিস্তানে প্রচণ্ডভাবে ব্যর্থ হলেও খুব বিস্ময়করভাবে একে ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে নারাজ কিছু বামপন্থি। তারা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আশ্রয় নিয়ে এখনো একে মার্কিন নীতির বিজয় বলে সাফাই গাইছেন। কিছু নিবন্ধ লিখে তারা বলতে চাইছেন, মার্কিন—তালেবান দুই পক্ষের 'win-win situation' এর মধ্যে আমেরিকা কাবুল ত্যাগ করেছে।
বামপন্থিদের মার্কিন পরাজয় বিশ্বাস করতে না পারবার কারণ মূলত দুটো। প্রথমত, মাও সেতুং আমেরিকাকে "কাগুজে বাঘ" বললেও, দেশটিকে কল্পনা মিশ্রিত করে সব ক্ষেত্রে বাস্তবের চেয়েও অতীব শক্তিশালী হিসেবে বিশ্বে উপস্থাপন করেছে বামপন্থিরা।
সারা দুনিয়ার বামপন্থিদের মূল শ্ত্রু হচ্ছে 'মার্কিন সাম্রজ্যবাদ'।এখন এ শত্রু যদি পরাজিত হয় সেটি বামপন্থার রাজনীতি বিশ্লেষণের মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। দ্বিতীয় কারণটি হল, বামপন্থার রাজনীতির আদর্শগত শত্রু 'ইসলামপন্থি'দের হাতে মার্কিনিদের পরাজয় মেনে নেওয়া বামপন্থিদের জন্য মনস্তাত্বিকভাবে কঠিন।
মার্কিনিদের পরাজয়ে 'ইসলামপন্থি'দের পাশাপাশি খুব প্রছন্নভাবে স্বস্তি দেখা দিয়েছে আরেকটি দেশে। দেশটি হল রাশিয়া। পশ্চিম দেশগুলি যখন দূতাবাস গুটাতে ব্যস্ত তখন রাশিয়া এবং চীন জানিয়েছে তারা কাবুলেই থাকছে। কাবুলে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আরেক ধাপ এগিয়ে তালেবানদের নিয়ন্ত্রিত কাবুল আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে নিরাপদ বলে মন্তব্য করেছেন।
এ স্বস্তির মূল কারণ হচ্ছে প্রথমত, মার্কিনীদের আফগানিস্তানে তাদের চেয়েও করুণ পরিণতি বরণ করা। আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, যে সমস্ত আফগান মুজাহিদ রুশ (সোভিয়েত) বিরোধী যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, গত ২৫ বছরে তালেবান কর্তৃক তাদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা। ফলে রাশিয়া তালেবানদের সাথে কৌশলগত নৈকট্য বাড়িয়েছে। তালেবান নেতারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কয়েক বার মস্কো সফরও করেছেন।
নৈকট্য বাড়িয়েছে চীনও। খনিজ সেক্টরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে চীনের রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ। আফগানিস্তানে রাশিয়ার স্বার্থ মূলত ভূ-রাজনৈতিক (geo-strategic) আর চীনের অর্থনৈতিক।
আফগান অর্থনীতির ৮০ শতাংশই বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর। তালেবানরা এটা বুঝতে পেরেছে যে বিদেশি সাহায্য সমর্থন ছাড়া আজকে তাদের পক্ষে কাবুলে টিকে থাকা মুশকিল। জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে তারা যে কাবুল বেশিদিন দখলে রাখতে পারবে না, এটা তারা অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পেরেছে। তাই তারা চীন, রাশিয়াসহ সবার সহযোগিতা চাচ্ছে।
তালেবানদের সাথে চীন, রাশিয়ার সম্পর্ক হচ্ছে কৌশলগত, মতাদর্শগত নয়। এ দুই দেশই চায় না যে আফগানিস্তানের বাইরে আর কোন দেশে তালেবানরা প্রভাব বিস্তার করতে পারুক। তালেবান রাজনীতি তারা আফগানিস্তানের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী।
আফগানিস্তানে পরাজয় বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিনিদের প্রভাব সামনের দিনগুলোতে ব্যাপক ভাবে ক্ষুণ্ণ করবে। বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া আর আঞ্চলিক রাজনীতি বিশেষত, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব আরো বৃদ্ধি পাবে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতেও চীনের ভূমিকা বৃদ্ধি করবে।
অর্থনৈতিক, সামরিকসহ সব ক্ষেত্রেই চীন ইতিমধ্যে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে যে ভূমিকা পালন করত, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার চেয়ে অনেক বেশি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেকটা সেরকম ভূমিকায় এখন অবতীর্ণ চীন।
সেই চীন কোনওভাবেই চায় না 'ইসলামপন্থা'র রাজনীতি বাংলাদেশে শক্তিশালী ভিত্তি লাভ করুক। রাশিয়াও বাংলাদেশকে এ ভুমিকায় দেখতে আগ্রহী নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'ইসলামপন্থা' আফগানিস্তানের মত মূল ধারা নয়। আফগানিস্তানের লড়াইটা ছিল মূলত 'ইসলামপন্থা'র দুই পক্ষের লড়াই—যার এক পক্ষকে সমর্থন করেছে আমেরিকা। বাংলাদেশেও 'ইসলামপন্থি'দের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতে নানাভাবে সমর্থন করে গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় দেশটি শক্তভাবে জামায়াতের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
মার্কিন ভূমিকা দুর্বল হবার ফলে আগামী দিনে তাদের পক্ষে এ ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে না। তৃতীয় দুনিয়ায় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ও সমস্ত দেশের সরকার সমূহকে চাপে রাখার কৌশল আমেরিকা সব সময় করে এসেছে। বাংলাদেশ সরকারের উপর এ ধরণের চাপ বিএনপির রাজনীতিকে অতীতে সুবিধা দিয়েছে।
আফগানিস্তানে পরাজয়ের ফলে আগামী দিনগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আর এ ধরনের ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন ভূমিকা যত দুর্বল হবে চীন তত প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। আর চীন যত প্রভাবশালী হতে থাকবে বিএনপির ওপর সরকারের চাপ তত বৃদ্ধি পাবে এবং 'ইসলামপন্থি' দলগুলোকে আরো কোণঠাসা করবার চেষ্টা করা হবে।