Published : 12 Aug 2021, 01:18 AM
১২ অগাস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস। এবারে যুব দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, 'খাদ্য ব্যবস্থাকে রূপান্তর করা: মানুষ ও প্রকৃতির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যুব উদ্ভাবন'। অর্থাৎ খাদ্যব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য যুবদের বা তরুণদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারী 'কোভিড-১৯' এটাকে আরো অর্থপূর্ণ করে তুলেছে। কারণ প্রকৃতি ও মানুষের অস্তিত্ব আজ একেবারে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। প্রকৃতির বিপন্নতা থেকে পুনরুদ্ধার এবং জীবন রক্ষায় খাদ্য ব্যবস্থায়ও রূপান্তর ঘটানোর বিকল্প নেই। প্রয়োজন জীববৈচিত্র্যের কথা মাথায় রেখে নতুন নতুন উদ্ভাবনের। কারণ আগামী ৩০ বছরের বিশ্বের জনসংখ্যা আরো ২ বিলিয়ন বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাহলে জীবন ও প্রকৃতির বিপন্নতা রোধসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনের যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জনে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে মাথায় রাখা এখন সময়ের বিবেচনা। বাংলাদেশের জন্য খাদ্যব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশমনের বিষয়টি সমাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
এখন প্রশ্ন হলো, এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় যারা নির্ভরতার ক্ষেত্র সেই যুবরা বিশেষকরে গ্রামীণ জনপদের যুবরা বিগত বেশ কয়েক দশক ধরেই সামাজিকভাবে, সরকারি ও আন্তর্জাতিক নানা প্রতিষ্ঠানের কাছে উপেক্ষিত থেকেছে। ফলে যুবদের ভেতরে যে শক্তি এবং সম্ভাবনা রয়েছে তা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে কৃষিতে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন সম্ভব হয়নি। গ্রামীণ যুবরা বেশিরভাগ সময়েই হয় বেকার থাকে অথবা স্বল্প বেতনে বা বিনা বেতনে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত থাকে। গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত ও শোভন কাজের সুযোগ কম থাকায় তরুণরা শহরে চলে যায়। কৃষকের সন্তানদেরও কৃষিকাজে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে। যারা কৃষিকাজে যুক্ত থাকে, তাদের বেশিরভাগকেই হয় জোর করে সেখানে যুক্ত করা হয়েছে, অথবা তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো সুযোগ না থাকায় তারা কৃষি পেশায় থেকে গেছে। এর ফলে নতুন করে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা হলো কৃষিকাজে নিয়োজিত মানুষের বয়স বেড়ে গেছে। যা ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কথায় কথায় বলে থাকি যুবরাই জাতির ভবিষ্যৎ। যুবরা যদি জাতির ভবিষ্যৎ হয়, তাহলে গ্রামীণ যুবরা হলো কৃষি ও গ্রামীণ শিল্পের চালিকাশক্তি। সেই চালিকা শক্তিকে নিয়ে আমরা কতটুকু গুরুত্বসহকারে ভাবছি? কতটুকু তাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছি? যুবদেরকে গ্রামে থেকে কৃষি ও অন্যান্য গ্রামীণ শিল্পের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছি? তাদের জন্য কী ধরনের নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে তারা এখানে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাবে, গ্রামীণ কৃষি ও শিল্পকে পছন্দ করবে। তারা সেখানে যুক্ত থাকার আগ্রহ প্রকাশ করবে এবং আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করবে?
তরুণরা কৃষি পেশা থেকে সরে যাওয়ার পেছনে কারণগুলো হলো- আমাদের সমাজে কৃষক পরিচয় সম্মান পান না। কৃষিকে সাধারণত কম গুরুত্বপূর্ণ, পশ্চাদপদ, ঔজ্জ্বল্যহীন নিম্নমানের কাজ হিসেবে গণ্য করার একটা প্রবণতা রয়েছে রাষ্ট্রের ও সমাজের। অনেকেই মনে করেন, কৃষিকাজে তেমন কোনো মেধার প্রয়োজন হয় না। ফলে এ কাজের সাথে সংশ্লিষ্টরা কম আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা বোধ করেন।
কৃষকের প্রতি রাষ্ট্রের, সমাজের এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি কৃষির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। কৃষকরা তার সন্তানকে আর কৃষক বানাতে চান না। তারা চান, তাদের শিশু বড় হয়ে চিকিৎসক, প্রকৌশলী অথবা আইনজীবী হোক। সুতরাং বড় হয়ে কৃষক হবে- এমন স্বপ্নও এখন আর কেউ দেখে না। একজন কৃষক দিনভর হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও কৃষি থেকে তার প্রয়োজনীয় আয় করতে পারে না। ফলে তারা পরিবারের বা ব্যক্তিগত সব চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। জমিতে অতিরিক্ত বীজ, সার, কীটনাশকের ব্যবহার এবং তার দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষি থেকে ক্রমান্বয়ে আয় কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারমূল্য কম এবং বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না থাকা, পণ্য পরিবহনে নানা সীমাবদ্ধতা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এবং দ্রব্যমূল্যের অস্থিতিশীলতার কারণে বারবার ক্ষতির শিকার হওয়ায় যুবরা আর কৃষির সাথে সম্পৃক্ত হতে চায় না। কারণ এখানে তারা ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির কোনো চিত্র দেখাতে পায় না।
জমির মালিকানায় নিরাপত্তাহীনতা একটা বড় সমস্যা। জমি এখন এমন এক পণ্যে পরিণত হয়েছে যা যেকোন সময় বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করা যায়।
বাজারমুখী ভূমি সংস্কারের কারণে জমির দাম বেড়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে কৃষিজমি দখল হয়ে যাচ্ছে। জমি দখল করে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, ইটভাটা, বিল্ডিং তৈরি ইত্যাদি চলছে হরহামেশা। ফলে জমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন কৃষক। অন্যদিকে যারা কৃষি জমি চাষ করে তারা সে জমির মালিক না। জমির মালিক তারা যারা তা চাষ করতে জানে না। জমিতে মালিকানা না থাকায় কৃষির প্রতি তরুণদের অনীহা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ জমিতে সে তার মত করে পরিকল্পনা করতে পারে না। কৃষির মূল ভিত্তিভূমি গ্রামীণ জনপদে অবকাঠামোগত ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। দেশের অনেক গ্রামে এখনো সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, বিনোদন কেন্দ্র, ইন্টারনেট সংযোগ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের বাজার অথবা কৃষিভিত্তিক ছোট বা মাঝারি আকৃতির শিল্প প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট পরিমাণ গড়ে ওঠেনি। এখনো কৃষিপণ্য পরিবহনের সময় বিভিন্নস্থানে চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় বা উৎকোচ দিতে হয়।
কৃষিপণ্য পরিবহণের জন্য কেন এখনো স্থায়ীভাবে ট্রেনের একটা বগি যুক্ত করতে পারছি না? পচনশীল দ্রব্যের জন্য নেই ভালো কোনো সংরক্ষণ ব্যবস্থা। এখনো অঞ্চলভেদে উৎপাদনের প্রকৃতি অনুযায়ী যুবদের সংগঠিত করে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর ব্যবস্থা করতে পারিনি। আম-কাঁঠালের মৌসুমে সেগুলো পঁচে যাচ্ছে, টমেটো, দুধ ইত্যাদি পচনশীল দ্রব্যের সুরক্ষায় যথাযথ বিনিয়োগ সম্ভব হয়নি।
সরকারি নীতি-কৌশল বা কর্মসূচি দুর্বলতার কারণে পারিবারিক কৃষি মুখ থুবড়ে পড়ছে। কৃষকরা ক্রমান্বয়ে জমির স্বল্পতা, পুঁজি বা যথাযথ বাজারের অভাব অনুভব করছে। আমাদের যে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পদ্ধতি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ রয়েছে তারা মূলত বাণিজ্যিক কৃষিকেই সহায়তা করছে। বাজার অর্থনীতির সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার জন্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবসা বিভিন্ন বিষয়ে যে জ্ঞান ও দক্ষতা থাকা প্রয়োজন সেখানে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষি অর্থনীতিভিত্তিক হলেও উন্নয়নের মহাসড়কে যে তোলপাড় চলছে সেখানে তা উপেক্ষিত। কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে নেই কোনো বিনিয়োগ প্রচেষ্টা। এ সমস্ত অনেক কারণে যুব কৃষক এখন আর কৃষিকাজের মধ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছি, কিন্তু এখনো যুবকৃষকদের কথা বিবেচনায় রেখে ভূমি বা কৃষি ব্যবস্থায় কোনো সংস্কার করা হয়নি। পূর্বসূরিদের কাছ থেকে জমির মালিকানা পাওয়ার জন্য একজন তরুণকে বহু বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। জমিতে নিজের মত করে কোনো পরিকল্পনা করার কোনো অধিকার সে ভোগ করে না। ভূমিহীন এসব তরুণদের বেশিরভাগ সময়ই মৌসুমী কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়। তরুণদের নামে জমি বা সম্পদের মালিকানা না থাকায় কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের সহায়তা করে না। সুতরাং আজকে যদি যুবদের কৃষিতে আকৃষ্ট করতে হয় তাহলে তাদের সামর্থ্য বৃদ্ধি ও নেতৃত্ব উন্নয়ন-এর উপর জোর দিতে হবে। উন্নত জীবনযাপনের অংশ হিসেবে স্থিতিশীল, পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক কৃষি ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। পাশাপাশি ভূমির মালিকানা, কৃষি সম্পর্কিত নানা প্রযুক্তি ও অন্যান্য সুবিধা গ্রহণের সুযোগ, ভূমি ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণ এবং ভূমির ব্যবহার ও কৃষকদের অধিকার বিষয়ক নীতি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নে একটি যৌক্তিক অবস্থান নেওয়া এখনই দরকার।
যুব কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা এবং স্থিতিশীল পরিবেশবান্ধব কৃষি পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে বহুমুখী কৃষি সমবায় প্রতিষ্ঠায় শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করতে হবে। সম্ভাবনাময় নারী কৃষকদের প্রতি সমাজের যে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে তা পরিহার করে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যুব কৃষকদের সুরক্ষায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার, গ্রামীণ জনপদের উন্নয়ন, স্থিতিশীল কৃষি পণ্য উৎপাদন, কৃষক নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং কৃষিপণ্যের জন্য কার্যকর বাজার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের প্রয়োজন। যুবরাই জাতির ভবিষ্যৎ, আর গ্রামীণ যুবরা হলো কৃষি ও গ্রামীণ শিল্পের ভবিষ্যৎ।