Published : 10 Aug 2021, 12:39 AM
প্রেমের জন্য প্রাণ দেওয়ার গল্প-কাহিনী লেখকের কল্পনাপ্রসূত নয় শুধু, সাহিত্যের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে তা বাস্তবের জমিন থেকেই। এর পক্ষে ইতিহাসেও সাক্ষ্য মেলে ভূরি ভূরি। কিন্তু আজকের দিনের বাস্তবতা যেন উল্টো পুরাণ। প্রেমের জন্য প্রাণ দেওয়া তো দূরস্থান, বরং প্রেমের ফাঁদ পেতে প্রেমিকার গলায় ফাঁস পরোনোর বন্দোবস্ত করাই যেন 'প্রেমিকের' লক্ষ্য। ডিজিটাল 'মারণাস্ত্র' হাতে এই শ্রেণির প্রেমিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। পত্রপত্রিকায় যতটা যা আঁচ পাওয়া যায়, তা আগুনে পরিস্থিতিরই জোরালো ইঙ্গিত দেয়।
তথাকথিত প্রেমিকদের পকেটে পকেটে থাকা 'মারণাস্ত্র'টির কার্যকারিতা একমুখী, ব্যবহার একলৈঙ্গিক। কেবল নারীকেই তাক করা প্রাণঘাতী অস্ত্রটির নাম 'মোবাইল ফোন'। নারীর প্রতি বিদ্বেষ, বিকৃত কামজ বাসনা, সর্বোপরি সমাজলালিত পৌরুষের ভ্রান্ত ধারণায় সত্যিকার অর্থেই প্রযুক্তির এ আশীর্বাদ যেন নারীর জন্য আজ অভিশাপে পরিণত।
প্রেমের ফাঁদ পেতে কাছে টেনে নিজেদের একান্ত মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করতে পারলেই এই প্রেমিকদের কেল্লাফতে। এবার ইচ্ছামতো প্রেমিকাকে 'ব্যবহার'সহ অর্থকড়ি আদায়ের পথ খুলে যায়। ফাঁদে পা না দিলেও বিকল্প আছে; গোপনে কোনো এক সময়ের ভিডিও বা ছবি তোলার জন্য তক্কে তক্কে থাকা। একদিন না একদিন সেই উদ্দেশ্য হাসিলও হয়। ব্যাস, সেই ভিডিও বা ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে যা খুশি তাই করার 'লাইসেন্স' পেয়ে যান প্রেমিক পুরুষটি।
তেমন লাইসেন্স পেলে পুরুষের স্মার্ট মোবাইল ফোনটি প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রে চেয়েও অধিক ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে বৈকি। এটি কেবল ভুক্তভোগী নারীর প্রাণই কেড়ে নেয় না, তার মান-সম্মানও মাটিতে মেশায়। ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যদের জীবনও হয়ে ওঠে নরকসম; সসম্মানে বেঁচে থাকা তাদের জন্য তখন 'হারাম'।
গত ৪ জুলাই রাজধানীর বাসাবোতে এক স্কুলছাত্রীর (১৪) ঝুলন্ত নিথর দেহ উদ্ধার করা হলো। জানা গেল, এলাকারই এক তরুণ প্রেমের ফাঁদে ফেলে তার সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করেন। সেই ভিডিও প্রচারের ভয় দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে 'ব্ল্যাকমেইল' করে আসছিলেন। দফায় দফায় টাকা আদায়। আরও টাকা চাই তার। দিতে না পারায় ভিডিও ফাঁস, অতএব মেয়েটিরও গলায় ফাঁস।
পরদিন ৫ জুলাই বরগুনার এক স্কুলছাত্রী (১৩) গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ল। চিরকূটে সে লিখে গেছে কেন সে জীবন থেকে 'মুক্তি' চাইছে। 'মা, আমার নামে তারা যে বদনাম উঠিয়েছে, তাতে আমি এ পৃথিবীতে থাকতে পারছি না। আমি একটা খারাপ মেয়ে, আমি নাকি খুব খারাপ। আমাকে কেউ বিশ্বাস করে না। কেউ না, তুমি ছাড়া।' কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কুৎসা রটিয়ে বেড়ায় বাড়ির মালিকের ছেলে। সমাজও তার কথা লুফে নেয়। নারীর বিরুদ্ধে যৌন সুড়সুড়ি জাগানো আলাপে ভাগিদার হওয়ার মানুষের অভাব কোনওকালেই ছিল না; এখন মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিও দেখার 'মজমা' বসে।
চলতি বছরেরই ২১ ফেব্রুয়ারি ফেইসবুকে প্রেমিকের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ভাইরাল হওয়ায় মাদারীপুরের শিবচরের এক ছাত্রী (১৭) কীটনাশক পানে নিজের জীবনে দাঁড়ি টানে। কে তাদের ছবি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন? স্বয়ং প্রেমিক। কী অদ্ভূত, দুজনের ছবি প্রকাশ পেলে, নারীর মৃত্যু ভিন্ন গতি নেই, কিন্তু পুরুষটি হয়ে ওঠেন 'হিরো'। এই হিরোগিরি আরও 'উচ্চ সংস্করণ'ও আছে।
প্রেমিকাকে 'মেরে ফেলা'র দুই মাস পর নিজেদের একান্ত সময়ের ভিডিও ফাঁস করার নজির গড়েছেন রংপুর বদরগঞ্জের এক প্রেমিক। প্রেমের 'নাটক' করে দিনের পর দিন মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন। বন্ধুকে দিয়ে গোপনে সেসব মুহূর্তের ভিডিও করান। বিয়ের কথা বলতেই ফোঁস করে ওঠেন। নিরুপায় মেয়েটি নিজের জীবন কেড়ে নেওয়াকেই 'সহজ' সমাধান ভাবে। প্রেমিকটি কিন্তু অতটা সহজ ভাবনার নন, তিনি অন্য ধাতুতে গড়া। মৃত্যুর পরও মেয়েটিকে অপমানিত, লাঞ্ছিত করার সাধ তার যায় না। ছড়িয়ে দেন ভিডিও। এবং বলাই বাহুল্য, নিজের পৌরুষেরও বিজ্ঞাপন হয়ে যায় তাঁর! এখানেই শেষ নয়, প্রভাবশালী প্রেমিক পুরুষটির হুমকি-ধমকিতে মেয়েটির অসহায় মা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতেও বাধ্য হন। ইউপি সদস্যের ছেলে বলে কথা।
প্রেমে পড়লি তো মেয়ে তুই মরলি! প্রেমে না পড়লেও তোর বাঁচার উপায় নেই। খাগড়াছড়ি দীঘিনালার কলেজছাত্রীর অপরাধ ছিল প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়া। ব্যস, রাস্তায় তিনজন মিলে মেয়েটিকে মারধর করেন এবং যথারীতি এ ঘটনার ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেন। দুনিয়ায় নরক ভোগ করার চেয়ে পরকালের নরকে যাওয়াকেই বেছে নেয় মেয়েটি! গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে প্রকাশ্যে রাস্তায় নির্যাতিত হন, রাতে সবার অগোচরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়েন।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় ফটোশপের মাধ্যমে নগ্ন দেহের সঙ্গে এক কিশোরীর মুখ লাগিয়ে ছড়িয়ে দেন 'প্রেমপ্রত্যাশী' এক তরুণ। ভুক্তভোগী মেয়েটির পরিবার পুলিশেরও দারস্থ হয়েছিল। প্রতিকার মেলেনি। আত্মহত্যা করে ভুক্তভোগী মেয়েটি। গত বছরের সেপ্টেম্বরের ঘটনা এটি।
উদাহরণ ভূরি ভূরি। প্রতিকারের হিসাব কড়ে গোনা যায়। প্রভাবশালীদের হুমকি-ধমকি, সালিস বৈঠকের প্রহসন, নেতা-পাণ্ডা-মাতব্বরের নিদান এবং সর্বোপরি নিপীড়ক, ধর্ষকের আস্ফালন। এর বিপরীতে লোকলজ্জা, অপমান, সামাজিক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, এমনকি একঘরে বা সমাজচ্যুত হতে হয় ভুক্তভোগী নারীসহ পরিবারকে। কিছু ক্ষেত্রে মামলা হলেও নিষ্পত্তির সংখ্যা আণুবীক্ষণিক। অতএব নানাভাবে প্রশ্রয়-পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে দাপিয়ে বেড়ান 'প্রেমিক' নামের বখাটে, লম্পট। প্রেমের নামে নারীর নিগৃহীত-নিপীড়িত হওয়া তাই যেন 'নিয়তি'ই। কেউ কেউ আত্মহত্যা করে বাঁচছেন! বাকিরা বয়ে বেড়াচ্ছেন মানসিক ক্ষত, বৈকল্য। অসম্মানের জীবন।
দণ্ডবিধির ২৯৪ ধারা বলছে, কোনো ব্যক্তি কোনো নারীকে উত্ত্যক্ত করলে সেই ব্যক্তি তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড পাবেন। যদি কেউ কোনো নারীর শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে কথা, অঙ্গভঙ্গি বা কোনো কাজ করে, তাহলে দায়ী ব্যক্তিকে এক বছর পর্যন্ত সাজা বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন (দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা)। আর ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধানও কার্যকর হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মামলার পথও খোলা। কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, আর্থিক সঙ্গতি না থাকাসহ সামাজিক-রাজনৈতিক চাপে অনেক ভুক্তভোগীই আপসরফায় বাধ্য হন।
জীবনকে ভালো লাগার, ভালোবাসার, ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে মগ্ন হওয়ার সময়ে, যখন নাকি এক এক করে পরত খুলছে বিস্ময়ের, মোহের, বোধের, তখন পুরুষনিয়ন্ত্রিত দিনদুনিয়ার কদর্যতা মুছে দিচ্ছে কত শত মেয়ের জীবনের রঙ, রূপ। কীভাবে বাঁচবে ওরা?