Published : 14 Feb 2012, 11:32 AM
সম্প্রতি জেনিভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৪৭তম অধিবেশনে মিয়ানমারে দ্রুত পুনর্বাসনের মাধ্যমে চলমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। 'রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি' শীর্ষক প্রস্তাবটি বাংলাদেশের উদ্যোগে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সব সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়। বিভিন্ন বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মতভেদ দেখা গেলেও দীর্ঘ আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বলা হচ্ছে, এই প্রস্তাবের মাধ্যমে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পক্ষে জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের কোন ফোরামে রোহিঙ্গাবিষয়ক কোন রেজুলেশন সবার সম্মতিতে গৃহীত হলো।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, জেনিভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে ১৯৩টি দেশ এক যোগে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রস্তাব পাস করেছে। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে। তবে প্রস্তাবটি এমন এক সময়ে পাশ হলো যখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান কোনও কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল না। কারণ, দেশটিতে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এক প্রকার অনিশ্চিত হয়ে গেছে। তদুপরি, চীনের টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মিয়ানমারে ফেরতের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন দেশটির সামরিক জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং।
২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনে তথাকথিত আরসা নাটকের মাধ্যমে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হলে পরবর্তী কয়েক মাসে দফায় দফায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশ তখন সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা জাহাজকে ফের সাগরে ঠেলে দিতে পারেনি। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। এছাড়া গত ৫০ বছরে আরও তিন দফায় প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশে ঢুকেছে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে এখন সাড়ে এগারো লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। প্রতিবারই সহিংসতা এড়াতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকলেও এসব সহিংসতা ও নিপীড়ণের অভিযোগ সবসময়ই অস্বীকার করে গেছে মিয়ানমার সরকার।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর চলা জাতিগত নিধন নিয়ে সোচ্চার হলেও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো যারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মোটাদাগে ভূমিকা রাখতে পারতো তারা বাংলাদেশকে আশানুরূপ সহযোগিতা করেনি। তদুপরি বাংলাদেশের মতো এরকম ঘনবসতিপূর্ণ একটা দেশের পক্ষে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরনার্থীর দীর্ঘ মেয়াদে চাপ সামাল দেওয়া অসম্ভব। অন্যদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ধীরে ধীরে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠছে। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মাঠে রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া চীনের ভূমিকার ওপর ভরসা রাখে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রথম থেকেই চীন বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপনের পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় সমাধানের পক্ষে। যেন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ভিন্নখাতে যায়। নিরাপত্তা পরিষদে তারা বার বার ভেটো প্রয়োগ করেছে, প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে।
অন্যদিকে, দেশটি বাংলাদেশকে বারবার আশ্বস্ত করলেও কেবল তাদের আশকারা পেয়েই মিয়ানমার নানা অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে। এক পর্যায়ে চাপ দিয়ে চুক্তি করিয়েছে, অন্তরালে থেকে প্রত্যাবাসন নাটকও করিয়েছে৷
জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও চীন ও রাশিয়ার ভূমিকার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনরকম ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যদিও গাম্বিয়ার আবেদনের প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ণ নির্যাতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে সম্মতি দেয়। তবে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার সময়টাতে মিয়ানমারকে সাহস যোগাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশটি সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তখন মিয়ানমারের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ কয়েক শ কোটি ডলার প্রকল্পের চুক্তিও সই করে চীন। ব্যাপারটা এমন যে যখনই মিয়ানমারের অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক মদদ প্রয়োজন পড়ে, চীন তখনই হাজির। রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় হেগের আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ এসেছিল ২৩ জানুয়ারি, অন্যদিকে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দেশটি সফর করেন ১৭ জানুয়ারি। এসব ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে বুঝতে সমস্যা হয় না যে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট থেকে সেদিনই পরিত্রাণ পাবে, যদি কোনদিন চীন আন্তরিকভাবে চায়। চীন চাইলে, রাশিয়াও চাইবে।
অন্যদিকে, এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় চীনের পাশাপাশি ভারতও সম্প্রতি এক চরম প্রতিযোগিতার লিপ্ত হয়েছে। এটাও আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। এর ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের মতো ভারতের মতো বন্ধুদেশকেও কখনও পাশে পায়নি বাংলাদেশ। চীন ও ভারত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুটি দেশই কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ দীর্ঘদিনের। দেশ দুইটি বেশ কয়েকবার যুদ্ধেও জড়িয়েছে। ভারতের আকসাই চিন অঞ্চল ও অরুণাচল প্রদেশকে চীন নিজেদের এলাকা মনে করে। সেকারণে দেশটি লাদাখ ও সেভেন সিস্টার্স নিয়ে চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে। এ ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে থাকা শিলিগুড়ি করিডোর। এ করিডোরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সেভেন সিস্টার্সে যোগাযোগের একমাত্র পথ। চীনের দোকলাম থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলোমিটার। দুর্যোগপূর্ণ সময়ে চীনের চুম্বী ভ্যালিতে মোতায়েন থাকা সেনাবাহিনী শিলিগুড়ি করিডোরের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে পুরো সেভেন সিস্টার্স ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে নিরাপত্তা ও যোগাযোগের কথা চিন্তা করে ভারত কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্সে প্রবেশের বিকল্প একটি পথ তৈরিতে উদ্যোগী হয়। ভারতের কলকাতা থেকে সমুদ্রপথে মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দর হয়ে কালাদান নদীপথে পালেতোয়া। সেখান থেকে সড়কপথে ভারতের মিজোরাম তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করা যাবে। সংক্ষেপে এই হল কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের রুট। এটার ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে দ্রুত সংযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ রুট ছাড়াও অন্য একটি বিকল্পও তৈরি থাকলো ভারতের কাছে। এ কারণে ভারতের কাছে দেশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আর রাশিয়ার ব্যাপার হচ্ছে, দেশটি মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজার দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। নজর আছে খনিজসম্পদের দিকেও। ইতিমধ্যে রাশিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান 'গ্যাসপম' মিয়ানমারে অফিস খুলেছে। অন্যদিকে, অং সান সুচির সময়ে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে প্রচুর অর্থ লগ্নি করেছে জাপান। পাশাপাশি রাখাইনের মংডুর কাছাকাছি পরিকল্পিত ইকোনমিক জোনে জাপান বিশাল লগ্নিরও পরিকল্পনা করেছে। জাপান জান্তা সরকারের প্রতি সমর্থন না জানালেও খুব একটা বিরোধিতাও করছে না।
তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন খেলায় মিয়ানমারের পক্ষে মূল খেলোয়াড় হচ্ছে চীন। রাশিয়া স্ট্যান্ডবাই, ডাক পড়লেই মাঠে এসে চীনের শক্তি বৃদ্ধি করে। জাপান বা ভারতের অবস্থান এখানে এখনও তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না। চীনই দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ব মতামত উপেক্ষা করে তাদের টিকিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে, ভারত বা জাপান নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যও নয়। ফলে এ দেশ দুটির চেয়ে চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের জন্য যে চারটি করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছে, মিয়ানমার তা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে ওই আদেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যাবে। এ ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ প্রতিপালন না করার কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে ভোটাভুটি হবে। ওই ভোটাভুটির ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়া আগের মতো ভেটো দিলে পুরো আদেশটিই কার্যত অর্থহীন হয়ে যাবে।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে সৃষ্ট নতুন ভূ-রাজনৈতিক ইকুয়েশনের কারণে চীনও মিয়ানমারের ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়াচ্ছে। আর মিয়ানমারের শাসকেরা এ সুবিধাকেই ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে চীনের বিআরআই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ধরা হয় মিয়ানমারকে। এটা হচ্ছে, ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশদ্বার। এর বিনিময়ে মিয়ানমার যা চেয়েছে, তা-ই দিয়েছে চীন। চীনের নতুন ভূ-কৌশলগত পরিকল্পনা 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' বা বিআরআইয়ের যাত্রা শুরুর পর থেকে মিয়ানমারের বঙ্গোপসাগরতীরের রাখাইন (আরাকান) অঞ্চল বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত ভূমিতে পরিণত হয়েছে। রাখাইন-ইউনান গ্যাস পাইপলাইন ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা তেল পরিবহনের জন্য পাইপলাইন আছে একই পথে। আছে চীনের তৈরি গভীর সমুদ্রবন্দর এবং নির্মাণাধীন রেল ও সড়ক সংযোগ। আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যে এ পথের গুরুত্ব দিন দিন বাড়বে। বলা হচ্ছে, চীনা অর্থনীতির লাইফলাইন হয়ে উঠতে পারে এই প্রবেশদ্বার। এসবের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য চীনের পক্ষে রাখা হবে।
এসব সমীকরণ বলছে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে যত প্রস্তাবই পাশ হোক না কেন জটিল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার মারপ্যাঁচে পুরো পুনর্বাসন প্রক্রিয়াই অনিশ্চয়তায় পড়ে যেতে পারে। তাছাড়া বাধ্য না হলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না, অন্যদিকে যারা মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারে তারাও নিজেদের স্বার্থে সে রাস্তায় হাঁটবে না কিংবা হাঁটছে না। এটা অনেকের কাছেই সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হলেও সব দেশের কূটনীতির মূলই কিন্তু নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ দেশগুলোর 'স্বার্থরক্ষার কূটনীতির' কারণে বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ফিরে ফিরে যেতে কতবছর লাগে সেটা নির্ভর করছে, কিংবা কখনও যেতে পারে কিনা তা নিয়েও বাড়ছে অনিশ্চয়তা।