Published : 24 Jul 2021, 12:53 AM
সংবাদপত্র প্রকাশের প্রথম উদাহরণ সম্ভবত চীনদেশে, ষোড়শ শতকে। এর পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, সপ্তদশ শতকে একাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ফরাসি রাজা, রাশিয়ার জার নাকি একেবারেই চাইতেন না তাদের দেশে কোনো পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হোক। এ বজ্রআঁটুনির মধ্যেও পেশাদার সাংবাদিকার বিকাশ হয়েছিল সেই ফ্রান্সেই, ফরাসি বিপ্লবের সময়ে। বিপ্লবের পক্ষে ও বিপক্ষের লোকজনের উদ্যোগে বহু পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছিল, ১৭৮৯ এবং তৎপরবর্তিকালে, যাতে লেখক-সাংবাদিকেরা একে অপরকে সমালোচনা ও বিদ্রুপ করতেন। রাজা-রাণী-মন্ত্রী-আমলা-বিপ্লবীদের প্রতি শ্লেষাত্মক ইঙ্গিত করে ব্যঙ্গচিত্রও ছাপা হতো এসব পত্রিকায়। সুতরাং ব্যঙ্গচিত্র আর পত্রিকা প্রায় সমবয়সী। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) যদিও কিছু ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন, ব্যাপকভাবে ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হতে থাকে অষ্টাদশ শতকে, অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের শতকে।
মানুষ মাত্রেই ভুল করে। কেউ যদি 'জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব' বা পাবলিক ফিগার হয়ে থাকেন, তবে তিনি কোনো ভুল করলে, নিজের পেশার অঙ্গ হিসেবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তাকে সহ্য করতে করতেই হবে। বিদ্রুপের এ সংস্কৃতি সত্যিকারের গণতন্ত্র নিশ্চিত করে। পৃথিবীর কোনো সরকারই শতভাগ সফল নয়। সুতরাং জনগণের মধ্যে ক্ষোভ থাকবেই। এ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয় বিদ্রুপে, শ্লেষে। প্রথমত, মুদ্রিত বিদ্রুপ আপনি বন্ধ করতে পারেন, কিন্তু লোকজনের আড্ডায়, বাচনে যে বিদ্রুপ হয়, সেটা বন্ধ করবেন কী করে? দ্বিতীয়ত, বিদ্রুপ যাদের করা হচ্ছে, সবাই তারা পাবলিক সার্ভেন্ট, অর্থাৎ জনগণের চাকর-বুয়া, সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন যে পদেই তিনি থাকুন না কেন। শতভাগ গণতন্ত্র নিশ্চিত করা এবং সঠিকভাবে রাষ্ট্রপরিচালনার প্রয়োজনে 'পদস্থ' ব্যক্তিদের 'অপদস্থ' হওয়ার সম্ভাবনা থাকতেই হবে, কারণ পদ কারও পৈত্রিক সম্পত্তি নয় এবং প্রতিটি পদের প্রকৃত মালিক জনগণ।
ফরাসি দেশে বিদ্রুপ করার জন্যে আলাদা কয়েকটি পত্রিকাই আছে। 'ল্য কানার অঁশেনে' এমন একটি পত্রিকা। পত্রিকাটির নামের অর্থ হচ্ছে: 'শেকলবাঁধা হাঁস'। কোমল শরীর তার শেকলে বাঁধা, কিন্তু বিদ্রুপাত্মক প্রতিবাদের প্যাঁক প্যাঁক সে করেই যাবে। ১৯১৫ সাল থেকে আট পৃষ্ঠার এ সাপ্তাহিকটি প্রকাশিত হচ্ছে, প্রতি বুধবার। আরেকটি পত্রিকা: 'শার্লি এব্দো'। কয়েক বছর আগে একটি ব্যঙ্গচিত্রের কারণে এই পত্রিকার খান তেরো সাংবাদিককে খুন করেছিল জঙ্গীরা। ব্রিটেনেও আছে এমন পত্রিকা, যেমন ধরুন, 'প্রাইভেট আই'। ফরাসি ব্যঙ্গ পত্রিকাগুলেতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আমলা, ধর্মগুরু থেকে শুরু করে যীশু-বুদ্ধের মতো মহাপুরুষেরও ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হয়, তাদের সম্পর্কে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করা হয়। আমরা কেন ভুলে যাই যে মহাপুরুষ মাত্রেই পাবলিক ফিগার, কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।
ফরাসি দেশে একাধিক টিভি চ্যানেলে ক্ষমতাসীন লোকদের বিভিন্ন পশুর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাদের আচরণ এবং চেহারার বিচারে: কেউ বাঘ, কেউ খেঁকশিয়াল, কেউ রাজহাঁস, কেউ সাপ, কেউ কুমির, কেউবা গণ্ডার। প্রতি সন্ধ্যায় মিনিট পনেরোর একটি অনুষ্ঠানে তাদের মুখে সংশ্লিষ্ট পশুসদৃশ কণ্ঠে এমন সব সংলাপ দেওয়া হয়, যা তারা সম্প্রতি বলেছেন কিংবা বলতে পারেন। বাংলাদেশের প্রতিবেশে এমন একটি অনুষ্ঠান কেমন জনপ্রিয় হতো ভাবুন দেখি একবার, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়তো আমজনতার চিন্তাশক্তির উপর। কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্যবশত, আগামী শত বছরেও কি বিদ্রুপের এমন সুস্থ ও ফলবান একটি সংস্কৃতি কল্পনা করা যায়, উপর্যুপরি সহজাত স্বৈরাচারের চারণভূমি এই তথাকথিত 'স্বাধীন' বদ্বীপে?
ভারতে আড়িপাতার প্রয়োজনে পেগাসাসের মতো ইসরায়েলি অ্যাপস ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে এ সপ্তাহে। জনমত নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা অবশ্যই আছে, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার মতোই আছে, তবু এটাওতো ঠিক যে ভারতে প্রচুর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়, সরকারের সমালোচনাও কম হয় না। পাকিস্তানে কথার জবাবে গুলি চলে, তবু হামিদ মীরেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সরকার কিংবা প্রতিপক্ষের সমালোচনা করে থাকেন। বাংলাদেশে চারুকলার শিশির ভট্টাচার্য ব্যঙ্গচিত্র আঁকছেন না আজ কত বছর? বাকিরাও কি আঁকছেন, আঁকতে পারেন? ব্যঙ্গচিত্র আঁকা কিংবা বিদ্রুপাত্মক সমালোচনা করা কি নিরাপদ 'স্বাধীন' বাংলাদেশে, সে সরকারের দিক থেকেই হোক, কিংবা হোক আমজনতার দিক থেকে? ১৯৯৬-২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজের ব্যঙ্গচিত্র দেখে কৌতুক অনুভব করতেন বলে শিশির ভট্টাচার্যের এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম। তার পর থেকে বুড়িগঙ্গায় অনেক নোংরা জল গড়িয়েছে।
যত দোষ, সরকার ঘোষ। 'বাবু যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুন'। বাবুর যেমন দায় আছে, পারিষদদেরও দায় আছে বৈকি, দায় আছে জনগণেরও। আমাদের দেশে সরকার যারা চালান, তাদের মাথা থেকে এখনও ব্রিটিশের ভুত, পাকিস্তানের জ্বিনের আছর কাটেনি। আমলারা এখনও ব্রিটিশ-টাইপ প্রশিক্ষণই পায়। জনগণের বন্ধু হতে আমলাদের উপদেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রথমত, চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী, দ্বিতীয়ত, বেয়াদব, পিতৃহন্তা জাতি বাপের উপদেশ শুনবে কেন! সুতরাং প্রজাদের সঙ্গে রাজার মতো আচরণই করে আমলারা, পাকিরা যেমন বলতো: 'কুছ বোলো মাৎ, শির কুচল দেঙ্গে!' সরকার বাহাদুর নিরুপায়, দেখেও না দেখার ভান করে। বঙ্গবন্ধু পাবলিক সার্ভেন্ট বা গণভৃত্যদের সমালোচনা করতেন, আমাদের সময়ে জান-মান বাঁচাতে কিংবা বেয়ারা ভৃত্যদের খুশি রাখতে অহেতুক প্রশংসাই বরং বেশি শোনা যায় বেচারা মালিকপক্ষের মুখে।
এমন ধারা শাসন দীর্ঘদিন চলার ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হয়েছে বাংলাদেশের, সেটা হচ্ছে একদিকে ক্ষমতাবান লোকজন স্বৈরাচার এবং অন্যদিকে ক্ষমতাহীন লোকজন অতিমাত্রায় স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেল্ফসেন্সরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বিরোধী দল বিরোধিতা করা ছাড়া আর সব কিছুই করে বাংলাদেশে। উচিৎ প্রতিবাদ করতে পারে না, কিন্তু ক্ষমতা দখলের লোভে বাসে পেট্রোল বোমা মেরে নিরপরাধ জনগণকে ঠিকই হত্যা করতে পারে। যাই ঘটুক, যে যাই বলুক, আমার কী! কেউ প্রতিবাদ করে না, সবাই গা বাঁচিয়ে চলে। পরিস্থিতি ভালো নয়, বুঝলাম, কিন্তু পরিস্থিতি কি পাকিস্তান আমলে এর চেয়ে ভালো ছিল? বঙ্গবন্ধুর জীবন কি আমাদের চেয়ে সহজ ছিল? তিনিতো প্রতিবাদ করতে জানতেন, পারতেন। আমরা কেন প্রতিবাদ করতে পারি না, জানি না? পরিস্থিতির ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে নিশ্চয়ই পার পাওয়া যাবে না।
ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাহীন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী একেকজন ভিক্টোরিয়ান পিউরিট্যান পদিপিসি। 'ছিছি' ছাড়া এদের মাথায় আর কিছু আসে না। নিজেতো প্রতিবাদ করতে জানেই না, পারে না, অন্যে প্রতিবাদ করলেও সেটাকে 'কুরুচিসম্মত', 'বাজে', বলে ফতোয়া দেয়। যা বাজনযোগ্য, তাতো বাজবেই, ঢোল হলে বাজবে, কুমড়োপটাশ হলে 'ঢ্যাব-ঢ্যাবাবে'। ক্ষমতার বাদাম চিবোতে চিবোতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সাধারণত গ্যালারিতে বসে খেলতে ভালোবাসেন। উত্তেজিত হয়ে বলে মাঝেমধ্যে বলে একটা লাথি যখন মেরেই ফেলেন, লাথিটা গিয়ে লাগে সামনের সিটের বেচারা দর্শকের মাথায়।
ঢিল মারলে পাটকেলটিতো খেতেই হবে। ঢিল যখন কেউ মারে, তখন সাহস করে কেউ কিছু বলে না কেন? আবার ঢিলের প্রতিবাদে মারা পাটকেলেরইরা এত সমালোচনা কেন হয়? সমালোচনা যদি করতে হয়, তবে ঢিল এবং পাটকেল উভয়েরই করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যখন মাদ্রাসারও অধম বলা হয়েছিল, তখনতো যুক্তিযুক্তভাবে প্রতিবাদ করেনি কেউ। প্রতিবাদ না করা মানে অনেকটাই মেনে নেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার 'আলমা মাতের' নয়, তবুও ওই কুৎসার প্রতিবাদে ফেইসবুকে আমি পোস্ট দিয়েছি, পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নুন খাই বলে নয়- প্রথমত, ব্যক্তি ও মহলবিশেষের সেই কুৎসাকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করতে চেয়েছি বলে এবং দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-বিরোধী এক বা একাধিক কুচক্রী মহলের বিশেষ রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রতিবাদ করাকে জাতীয় কর্তব্য মনে করেছি বলে।
ভুল করতেই পারেন বুদ্ধিজীবীরা। সে ভুল ধরিয়ে দিয়ে একে অপরের সমালোচনা করবেন তারা, প্রয়োজনে বিদ্রুপ, ব্যঙ্গও করবেন- এটাই কাম্য পরিস্থিতি। বিংশ শতকের প্রথম দিকে রবীন্দ্ররচনা নিয়ে বিদ্রুপ করতেন বহু সাংবাদিক-লেখক, যার মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অন্যতম। দুজনের সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছেছিল। শনিবারের চিঠিতে সজনীকান্ত কার না সমালোচনা করতেন? জীবনানন্দের মতো নির্বিরোধী কবিকে তিনি কি 'গণ্ডার' বলে বিদ্রুপ করেননি? অথচ, ওই সময়ে, ধরা যাক কল্লোল যুগে, বাংলা সাহিত্যের ফলন আজকের তুলনায় অধিক ও উন্নততর ছিল। এ তিক্ততা, বিদ্রুপ, শ্লেষ কারও অপছন্দ হতে পারে, কিন্তু এটাই সুস্থ সংস্কৃতির লক্ষণ। পাবলিক ফিগার যদি হয়ে থাকেন আপনি, বিদ্রুপের পাত্র আপনাকে হতেই হবে, সবাই আপনার সঙ্গে একমত হবে না এবং আপনার প্রতিটি কথা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে সমাজে, হতে হবে।
বাংলাদেশের আমপাবলিকের অপোগণ্ড অংশটি দুই বা ততোধিক বুদ্ধিজীবী কিংবা বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর বাদ-প্রতিবাদকে 'কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি' মনে করে। কারণ নিজেরা যদিও তারা প্রচুর ঝগড়া করে, বুদ্ধিজীবীরা সকলেই এবং সহজেই একমত হবেন, এমনটা আশা করে তারা। বাচ্চাকাচ্চারা যেমন বাবা-মায়ের ঝগড়ায় কষ্ট পায় এটা ভেবে -বড়রা কেন ঝগড়া করবে, অনেকটা তেমনই বালখিল্য চিন্তা আর কি। একমত হওয়া সাধারণ মানুষের Doxal আচরণ। বুদ্ধিজীবীরা Paradoxal হতে পারেন বলেইতো তাদের আমরা 'বুদ্ধিজীবী' বলি। যদি তারা সেটি না হয়ে উঠতে পারেন, অতি সহজেই একমত হয়ে যান একে অপরের সঙ্গে, তবে 'বারমাইস্যা' আম (পাবলিক) এর সঙ্গে তাদের তফাৎটা রইল কোথায়?
আমার শিক্ষক রাজেন্দ্র সিংহ বলতেন: Each intellectual must use his own toothbrush! একই মাজন দিয়ে আমজনতা দাঁত মাজতে পারেন, কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা কখনই তা পারেন না, তাদের প্রত্যেকের নিজের ব্রাশ লাগে। বুদ্ধিজীবী যারা, আমজনতার তুলনায় তাদের জানাশোনা বেশি, খেয়ে না খেয়ে সারাদিন তারা 'ভীষণ রকম' লেখাপড়া করেন বলে একটা বিষয়কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে পারার একটা ক্ষমতা তাদের হয়েই যায়। সুতরাং আঁতেলদের মধ্যে দ্বিমত থাকাটাই স্বাভাবিক এবং এই 'আঁতলামো' থেকে 'আমও' অনেক কিছু শিখতে পারে বৈকি।
বিস্মৃত হলে চলবে না যে এই দ্বিমত, বিদ্রুপ, শ্লেষ চলে পেশাগত পর্যায়ে, অবশ্যই ব্যক্তিপর্যায়ে নয়। পেশাগত দ্বিমতের প্রভাব যখন ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর গিয়ে পড়ার উপক্রম হয়, তখন বুঝতে হবে, অতিশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীগণ কিংবা তস্য সংক্রমিত অর্ধশিক্ষিত স্যাঙাৎরা তর্কযুদ্ধের নিয়ম মানছেন না, স্বভাবদোষে কিংবা রোগের প্রকোপহেতু বালখিল্য আচরণ করছেন। মুসলিম লীগের নূরুল আমিন কিংবা মোনায়েম খান বঙ্গবন্ধুকে আজীবন কষ্ট দিয়েছেন, কারারুদ্ধ করে রেখেছেন রাজনৈতিক কারণে, কিন্তু তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনও নষ্ট হয়নি।
বুদ্ধিজীবীদের অতি সহজে সহমত হওয়া সমাজের জন্যে ক্ষতিকর এ জন্যে যে 'তর্ক' সেক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে যাবে এবং তর্কহীনতার ফলে বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গির চর্চাভিত্তিক প্রকৃত শিক্ষার পথও চিরতরে রুদ্ধ হবে আমজনতার জন্যে। অমর্ত্য সেন ভারতীয় তথা বাঙালিদের 'যুক্তিবাদী', 'তর্কপ্রিয়' বলেছেন। প্যারিসে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে আমার এক শিক্ষক, মসিয়্য জোয়াইয়ো বলতেন: Chinese people are homogenous and pragmatic, Indian people are diverse and juridical.
নমস্য গুরুদের কথা যদি সত্য হয়ে থাকে, বাঙালি আসলেই যদি বৈচিত্র্যময় ও তর্কপ্রিয় একটি জাতি হয়ে থাকে, তবে ভিন্নমত আর বিদ্রুপের সংস্কৃতিতো জারি থাকতেই হবে। লক্ষ্যণীয় যে উপরোক্ত 'জুরিডিক্যাল' শব্দটি আইন ও বিচারের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং 'বিচার' মানেইতো দ্বিমতের 'ভাত', তর্কের 'তরকারি' এবং সেই সাথে বিদ্রুপের খানিকটা 'আচার'। বিচার করতে করতে মুখ যখন মেরে আনবে, তখন বিদ্রুপের আচার মুখে দিতেই হবে, অন্ততপক্ষে জিহ্বার স্বাদ ফিরে পাবার জন্যে। এই আচার নেই বলে আজকাল আলোচনা-সমালোচনায় স্বাদও কম মনে হয়।
বিচারের সঙ্গে ব্যঙ্গের আচার মেশাতে জানতেন যারা এবং সেই সাথে আলোচনার আহারের পর পাঠকের মুখে Pun তুলে দিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন যারা, যেমন- শিব্রাম চক্রবর্তী কিংবা মুজতবা আলী, বাঙালি সমাজে তেমন লেখক-বুদ্ধিজীবীর সরবরাহ আজকাল কম এ কারণে যে তাদের সমতুল্য রচনার চাহিদাও কম। এমন লেখক ও বুদ্ধিজীবীর কদর করতে জানার জন্যে পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষারও প্রয়োজন বৈকি। অনুরূপ অনুকূল পরিবেশের অভাবহেতু অন্য অনেক ভালো কিছুর মতো কৌতুকবোধসম্পন্ন, শিক্ষিত, সমজদার পাঠকও দিন দিন বিরলতর হয়ে উঠছে- এটাই আপাতত বিলাপযোগ্য পর্যবেক্ষণ বলা যায়। এমত পরিস্থিতির ফলে তর্ক, বিদ্রুপ ও দ্বিমতপোষণের চিরায়ত সুস্থ সংস্কৃতিও দিন দিন ক্ষীয়মান, অপসৃয়মান, যা কোনও বিচারেই সুখবর হতে পারে না।