Published : 16 Jun 2021, 12:22 AM
আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ায় শত শত বছর ধরে মুসলিম শাসনাধীন ছিল। দেশগুলো ছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ, অপরাধমুক্ত শান্তির দেশ ছিল। সত্যিকারের ইসলামী অনুশাসন ছিল। কিন্তু ওই সব দেশে যখনই ইসলাম হেফাজত করার নামে তথাকথিত ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে তালেবান, আলকায়দা, আইসিসের মত জঙ্গি গোষ্ঠীর আবির্ভুত হয়, তখনই সেখানে লাখ লাখ মুসলিমের লাশ পড়েছে। মসজিদ–মাদ্রাসা ধ্বংস হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। একেকটি দেশ আজ মৃত্যু উপত্যকা।
এ উপমহাদেশে দুই শ বছরের ব্রিটিশ ও খ্রিস্টান শাসনামলে ইসলামের তেমন কোনও ক্ষতি হয় নাই। তখনো মুসলিম ছিল, মসজিদ ছিল, মসজিদে আজান হতো, নামাজ পড়া যেত, হজ পালন করতে যেতে পারতেন মানুষ, শত বছরের প্রাচীন মসজিদ, পীর আউলিয়ার দরগাহ বা মাজার ছিল। ভারতের দেওবন্দ কওমী মাদ্রাসা, কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসা, হাটহাজারী, পটিয়ার কওমী মাদ্রাসা বা ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসাসহ শত শত অনেক প্রাচীন মসজিদ,মাদ্রাসা, ব্রিটিশ বা খ্রিস্টান আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তখন মাওলানা কাসেম নানতুবি, রশিদ আহম্মেদ গাঙোহী, হোসাইন আহমেদ মাদানী, আবুল কালাম আজাদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মত বিখ্যাত আলেম, মুফতি এবং ইসলামী স্কলার বা গবেষকরা ছিলেন। কিন্ত তারা আজকের কাঠমোল্লাদের মত ইসলাম হেফাজতের নামে, জেহাদের নামে- তাণ্ডব করেননি, সন্ত্রাসে জড়াননি। রক্তপাত ঘটাননি। উল্টাপাল্টা মনগড়া ফতোয়া দেন নাই। নামের আগে 'আল্লামা' লাগানোর প্রয়োজন ছিল না তাদের।
এখন তো আমাদের দেশে অধিকাংশ কাঠমোল্লাদের নামের আগে 'আল্লামা' লাগানোর হিড়িক পড়ে গেছে। যদিও যারা নামের আগে 'আল্লামা' লাগান, তারা 'আল্লামা' শব্দের ভারিক্কি বোঝেন বলে মনে হয় না। 'আল্লামা' শব্দের অর্থ মহাজ্ঞানী, বা শিক্ষাবিদ। উপমহাদেশে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে পরিচিত ও পাকিস্তানি জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কবি ইকবালকে পাকিস্তানের কায়েদ–ই– আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ 'আল্লামা উপাধি দিয়েছিলেন। তার আগে উপমহাদেশে আর কোনও ব্যক্তি বা আলেম, উলামা,পীর, মাশায়েখ নামের আগে এ 'আল্লামা' শব্দটি জুড়ে দেন নাই। বাংলাদেশে প্রথম এই 'আল্লামা' শব্দটি নামের আগে বহুলভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত স্বঘোষিত 'আল্লামা' দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী। সেই থেকে বাংলাদেশের কাঠমোল্লারা বুঝে, না বুঝে- নামের আগে 'আল্লামা' শব্দটি লাগাতে থাকেন ।
ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। ইন্দোনেশিয়ার পরেই বেশি মুসলিম বাস করেন ভারতে। ভারতে ১৩২ কোটি মানুষের মাঝে মুসলিমের সংখ্যাই কেবল ৩০ কোটি। ভারতে আছে শত শত মাদ্রাসা, হাজার,হাজার মসজিদ, আছে আজমীর শরীফ ও নিজামউদ্দিনের মাজার, দিল্লির জামে মসজিদ, তাজমহল সহ শত শত বছরের প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্য, কওমীদের সদর দপ্তর দেওবন্দ কওমী মাদ্রাসাসহ, কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসা এবং দিল্লিতে তাবলীগ জামাতের সদর দপ্তর নিজামুদ্দিন মারকাজ ইত্যাদি। এখন হিন্দু মৌলবাদীরা বাবরী মসজিদ ভেঙে ফেলেছে বলে সমস্ত ভারতে মসজিদ মাদ্রাসাগুলো ভেঙে ফেলা হয়নি। বাবরী মসজিদও ভারতের মাটিতে ৫০০ বছর দাঁড়িয়ে ছিল। ভারতে লেখাপড়া করতে যাওয়া বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মাদ্রাসার ছাত্র। উন্নত চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের ধনীরা যান সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক অথবা ইউরোপ আমেরিকাতে। বাংলাদেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা উন্নত চিকিৎসার জন্য যান ভারতে। বাণিজ্য ক্ষেত্রেও ভারতের পিঁয়াজ, ডাল, রসুন, আদা, গরু ইত্যাদি ভোগপণ্য ছাড়া বাংলাদেশের বাজার ঘাটতি পূরণ হয় না।
ভারতে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় গরুর জন্য ধর্মান্ধ হিন্দু উগ্রবাদীরা 'জয় শ্রীরাম' বলে কোন কোন সময় মুসলিম গরু ব্যবসায়ীদের উপর হামলা করে, এমনকি হত্যাও করে। বাংলাদেশেও কোন কোন সময় স্বার্থান্বেষী মুসলিম মৌলবাদীরা হিন্দুদের জায়গা জমিন দখল করে নেয়। এগুলোর সঙ্গে একাত্তরে পাকিস্তানিদের মত বাঙালি নিধন (সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিমদের হত্যা হয়েছিল তখন ) মেলানো যাবে না। এগুলোর সাথে অবশ্যই ইসরায়েলের ফিলিস্তিন আগ্রাসন, বার্মার রোহিঙ্গা বিতাড়ণ বা চীনের উইঘুর নির্যাতনের মত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস গুলিয়ে ফেললে হবে না। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় হয়তো বা কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ বা সাম্প্রদায়িক প্রশাসনিক কর্মকর্তার মদদ এবং অবহেলা থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জঙ্গি মৌলবাদীরা শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপাসনালয়, বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট করে বা জ্বালিয়ে দেয়না, পাশাপাশি তারা মসজিদও আক্রমণ করে, কোরান শরীফ জ্বালিয়ে দেয়, নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করে।
ধরা যাক আমার চারিদিকে শত্রু, একজন মাত্র বন্ধু আছেন। সেই বন্ধু যদি হয় শারীরিক, মানসিক বা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল হন তাহলে আমিও দুর্বল। ভারতের চারদিকে দুইটি বৃহৎ শত্রু ও অন্যান্য বৈরী রাষ্ট্র। ভারতের ডানদিকে 'সিংহ চীন', বামদিকে 'বাঘ পাকিস্তান'। দুটোই পরমাণু শক্তিধর দুশমন। শক্তিধর শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান চীনের বন্ধু, আবার আরেকটি সীমান্ত ভাগাভাগি করা দেশ মিয়ানমারও চীনের দলে। ওদিকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সাথে দীর্ঘদিনের বৈরিতা। শত্রুর বন্ধুও শত্রু। চীন প্রভাবিত ৯৫ শতাংশ হিন্দু অধ্যুষিত নেপালের সাথেও রয়েছে ভারতের দীর্ঘদিনের বৈরিতা। তাহলে দেখা যাচ্ছে উপমহাদেশে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশ এবং ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপ ছাড়া ভারতের প্রকৃত মিত্র রাষ্ট্র নেই। মালদ্বীপ অর্থনৈতিক বা সামরিক শক্তিও নয়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ উপমহাদেশে দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি ও তৃতীয় সামরিক শক্তি। তাই বাংলাদেশের যত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামরিক শক্তি যত বাড়বে ততই ভারতের লাভ।
একটি রাজনৈতিক দল আর একটি রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে যে, একটি রাজনৈতিক দল বর্তমানে ক্ষমতায় আছে, ভবিষ্যতে অন্যদল ক্ষমতায় আসবে। ভারতে আজ মোদী বা তার দল বিজেপি ক্ষমতায় আছে। ভবিষ্যতে কংগ্রেস বা অন্য দল ক্ষমতায় আসতে পারে। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকেরা ভারতের নিজ স্বার্থে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক সেটাই চান এবং চাইবেন। বাংলাদেশ সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল হলে বা পিছিয়ে পড়লে ভারতেরই লোকসান। আর এগিয়ে গেলে সহায়ক মিত্র রাষ্ট্র হিসেবে ভারতেরই লাভ। তাছাড়া এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে ভারতের প্রচুর ত্যাগ ও অবদান রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনার মিলিত রক্তে রঞ্জিত মুক্ত বাংলাদেশ।
বাংলাদেশেরও সাড়ে তিন দিকে ভারত। দক্ষিণ পূর্ব কোণায় পাকিস্তানের বন্ধু চীন প্রভাবিত মিয়ানমার। সামনে বঙ্গোপসাগর। বার্মার গোপন মানচিত্রে আছে সমগ্র চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ফেনী পর্যন্ত বার্মার অংশ। শুধু রোহিঙ্গা আর মাদক দিয়ে নয়, পাশে ভারত না থাকলে বহু আগেই চীন–পাকিস্তানের সহযোগিতায় বার্মা বহু আগেই ফেনী পর্যন্ত দখল করে নিত। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তা বেষ্টনী হচ্ছে ভারত।
অর্থাৎ এ দুইদেশের একে-অপরের বন্ধুত্ব ছাড়া বিকল্প কোথায়? টানাপড়েন থাকলেও এ বন্ধুত্বে সহজে চিড় ধরবে না। যারা এ দুইদেশের সম্পর্কে ছোট ছোট মনকষাকষি নিয়ে রাজনীতির চেষ্টা করেন- তাদের এ বিবেচনা বোধ কখনো থাকে না। কিংবা এমনও হতে পারে তারা জেনেও নৈরাজ্য তৈরির অপচেষ্টা চালান।
না, বাংলাদেশ কখনও তালেবানি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হবে না। এ চিন্তাটা একেবারে উদ্ভট ও কাল্পনিক। বাংলাদেশে মাঝে মধ্যে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, সাইক্লোন মবা বন্যার মত ধর্মীয় মৌলবাদের উৎপাত হয়। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, সংখ্যাগরিষ্ঠ ৯০ শতাংশ অসাম্প্রদায়িক মুসলিম জনগোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (যেমন বাঙালি তার ভাষা বাংলার জন্য জীবন দিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ দাশকে বর্জন করেনি) এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী অবস্থানের কারণে পাকিস্তানের মত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র থেকে রক্তাক্ত সংগ্রাম করে জন্ম হয়েছে এদেশের। ধর্মের উপর নয়, বরং ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে এ রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। সুতরাং বাংলাদেশ কখনোই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের দিকে যাবে না। সেটার বাস্তব ভিত্তিও নেই। এমনকি কোনও বৃহৎ শক্তির মদদেও সেটি সম্ভব নয় বলেই মনে হয়।