Published : 15 May 2021, 03:01 PM
ঘরে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে একটা বিশাল কমলা রঙের মুখোশ যার মাথার উপর আগুনের লেলিহান শিখা। এর আশেপাশে কিছু রঙিন কাগজের মালা, প্লাস্টিকের হাত মোজা, পোশাক, গহনা, চুলের বেণীসহ আরও নানান সামগ্রী দেয়ালজুড়ে আটকানো। তার পাশে এক কোণে একটা কাচের দরজার সামনে রাখা একটা খোল। তার উপরে কমলা, গোলাপি ও নীল রঙের মিশ্রণে তৈরি একটি নাচের কস্টিউম। বিপরীত দিকের দেয়ালে শিল্পী রজনী রাউজা তার কাজের অংশ হিসেবে অনেকগুলো ছোট ছোট বই তৈরি করেছেন যা মূলত কুষ্টিয়ার একজন ছুকরি নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে তার কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। দর্শকরা চাইলে দেয়ালে সাজিয়ে রাখা বইয়ের তাক থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন বিনামূল্যে।
এর পাশে রয়েছে একটি ফটো অ্যালবাম যেখানে শিল্পী বলতে চান- তিনি নারী নন, কিন্তু তার যোনি বা ভ্যাজাইনা রয়েছে। তিনি তার ঠোঁটকে তুলনা করেছেন যোনির সঙ্গে, এরসঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন যৌন বৈচিত্র্যময় মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন মন্তব্য। তার পাশে একটি পারফরমেন্সের ভিডিও চলতে থাকে, যার শুরুতে শিল্পী রজনী রাওজা অনেকগুলো রাখি বেঁধে দেন দর্শকদের হাতে। রাখিগুলো খুললে দর্শক আবিষ্কার করবেন ডেটিং অ্যাপ্স থেকে শিল্পীর সংগৃহীত বিদ্বেষপূর্ণ বিভিন্ন কথোপকথন, যেখানে প্রয়াসই দেখা যায় মানুষকে কেবল একটা যৌন বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, এর বাইরে আর কিছু না। আর এখানেই পুরাণের চরিত্র অগ্নি দেবতার সঙ্গে শিল্পী রজনী রাওজার প্রথম সম্পর্ক।
রান্নার ক্ষেত্রে যেমন মানুষের লিঙ্গ পরিচয় কোনও গুরুত্ব বহন করে না, ঠিক তেমনি কারও শাড়ি পড়তে ভাল লাগতেই পারে কিন্তু তাকে অবশ্যই যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে হয় তা হল "তুমি কে? নারী না পুরুষ? না ক্রস ড্রেসার? না তৃতীয় লিঙ্গ? অথবা তুমি কি হিজড়া?" এ স্থাপনা শিল্পের মাধ্যমে শিল্পী রজনী রাউজা পুরুষ তন্ত্র এবং এর নির্মাণ সম্পর্কে দর্শকদের কাছে সেই প্রশ্ন নিয়ে আসেন। করোনাভাইরাস মহামারী চলাকালীন, নিজের একাকিত্ব, দ্বৈত সত্ত্বা এবং ডেটিং অ্যাপস এর এমন নানা অভিজ্ঞতার আলোকে এ পুরো কাজটি সাজান তিনি।
শহরে একরকম 'জেন্ডার রোল' নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা মানুষ সচরাচর করে থাকলেও গ্রামে এর স্বরূপ কেমন, শিল্পী তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। তিনি নিজে যখন তার গ্রামে দেখতে গাউনের মতো একটা পোশাক পরে কাজে যাচ্ছিলেন, সেখানেও তাকে একইরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তিনি যেন মুহূর্তেই জনপদ থেকে আলাদা হয়ে পড়েন, কেবল তার পোশাক আর জীবন ধারণের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে। তাহলে আমরা যে হাজার বছরের সৌহার্দ্য আর সহাবস্থানের কথা বলি তার অস্তিত্ব আসলে কোথায়? এ প্রশ্ন থেকেই ছুকরি নাচ নিয়ে তার গবেষণার শুরু। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় তাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করার এক পর্যায়ে শিল্পীর মনে হল তাদের অভিনীত মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণের বিষধর সাপের মতই এসব শিল্পীদের জীবনেও অনেক টানাপড়েন রয়েছে, তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। এ অভিজ্ঞতাগুলোই তার লেখা 'শাড়ি উপাখ্যান' পালায় নানাভাবে চলে আসে। শাড়ি তাদের সুখ-দুঃখ আর জীবনের চরাই উৎরাইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও গ্রামীণ পটভূমিকায় লৈঙ্গিক পরিচয়ের বেড়াজালে সেই শাড়িকে অস্বীকার করবার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তাদের। শিল্পী শেরেবুলের গানের কথায় বিষয়টা অনেকটা এরকম:
ওরে আমার একি হইলো রে কপালে
আমি কি করিয়া পড়বো শাড়ীগো সন্তান করলো মানা
ছেলে নিষেধ করে বলে, আব্বু, এতো দিনতো করছ, এখন এই পথ বাদ দাও, অন্য গান বাজনা করো। শাড়ি পড়ে গেরাম অঞ্চলে আর এ গান করো না। এখন বন্ধুবান্ধব তো আমাকে হাসিঠাট্টা করে এই বলে যে তর আব্বু শাড়ি পড়ে নাচে।
আমি কি করিয়া ছাড়বো শাড়িগো শুনিয়া তার মানা
তুমি আছো সঙ্গে শাড়িগো-সুখে আর দুখে
থেক থেক সঙ্গে শাড়িগো, থেকো মোর অঙ্গে
মরণেরও কালে শাড়িগো, থেকো আমার সঙ্গে
বেশ কবছর আগে রজনী নিজে একজন নারী নৃত্যশিল্পীর বেশে শাস্ত্রীয় ভারতনট্যম পরিবেশন করার ইচ্ছে পোষণ করেন, তার নাচের গুরু বলেন, "এভাবে নাচ করা যাবে না। আমি কোন কিন্নর-কে আমার দলে রাখতে পারবো না।"
সেই অভিজ্ঞতার কথা ভেবে রজনীর ইচ্ছা ছিল 'ছুকরি নাচ'কে একটি পারফরমেন্স ফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে অগ্নিদেবতার আখ্যান উপস্থিত দর্শকদের কাছে তুলে ধরা। কেননা এ প্রথা শত বছর ধরে আমাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এ উপমহাদেশে অবস্থান করছে। কিন্তু এখনকার সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেখানে ধর্মের দোহাই দিয়ে হিজড়াদের তাদের পরিচয়ের জন্য জঙ্গি সংগঠনের টার্গেটে পরিণত করে, সেখানে এমন আয়োজন কতখানি সম্ভব সেটা আসলেই ভাবনার বিষয়।
এ শিল্পকর্মের অন্যতম প্রধান চরিত্র অগ্নি, যিনি একজন বৈদিক দেবতা, অদিতি ও কাশ্যপের পুত্র এবং স্বাহার স্বামী। অগ্নি আক্ষরিক অর্থে আগুন থেকে তৈরি। বেদের একটি শ্লোকে বলা আছে, দুই কাষ্ঠের ঘর্ষণে অগ্নির জন্মায় সেজন্য অগ্নি দ্বিমাতৃ। যা স্পষ্টত ইঙ্গিত করে দুটো কাঠের ঘর্ষণ আসলে নারী সমকামিতার প্রতীক।
অগ্নির স্ত্রী থাকার সত্ত্বেও শিবের সাথে একটা প্রণয়পূর্ণ স্পর্শকাতর সম্পর্কের কথা বলা আছে। দেবতা সোম দেবের সঙ্গে তার বৈবাহিক অবস্থার পাশাপাশি বহু গ্রন্থে তাকে উল্লেখ করা হয়েছে একজন উভকামী দেবতা হিসেবে। তবে উভকামিতা বা শিব-অগ্নির বর্ণনা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন গ্রন্থই এসব পরিচয়ের যথাযথ মূল্যায়ন করেনি। বরং একজন আন্তঃলিঙ্গের মানুষ হিসেবে চিন্তা করেও তার সম্পর্কে লেখা গুলো ব্যাখ্যা করা সম্ভব যা আসলে আমাদের লৈঙ্গিক দ্ব্যর্থবোধকতাকে সামনে এনে দাঁড় করায়।
রামায়ণ মহাভারতের লৈঙ্গিক দ্ব্যর্থবোধতাকে যেভাবে উদযাপন করা হয়েছে বা সমকালীন কুয়ার থিউরিকে যেভাবে মহিমান্বিত করা হয়, যখন তা আমাদের এ উপমহাদেশে বাস্তব জীবনে আসে তখন এর প্রতিক্রিয়া অন্যরকম। তাই হয়ত এ আয়োজনের কেন্দ্রে রয়েছে একটি মুখোশ, যা রূপান্তরের গল্পটিতে প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
বেদ এ বলা হয়েছে, অগ্নি শুভ্র বর্ণ আদিত্য বা সূর্যের ন্যায়। আবার কোথাও বলা হয়েছে সে কুচকুচে কালো। কখনো সে কমলা আবার কখনো সে নীল। ঠিক তার চরিত্রের মতোই যেকোনো রঙ বেছে নিয়ে তার চরিত্র বিনির্মাণ করা সম্ভব তাই মুখোশের উপরে কমলা রঙের আধিক্য চোখে পড়ে। এ মুখোশ নির্মাণে শিল্পী রজনী রাওজাকে সাহায্য করেছেন শিল্পী এস এফ রহমান এবং তার সহকারী এইচ আহমেদ। পুরানো ঢাকার চকবাজার এবং আশেপাশের এলাকাগুলো থেকে উপকরণগুলো সংগ্রহ করা। এ প্রসঙ্গে শিল্পী এস এফ রহমান বলেন, "অগ্নিদেব একই সঙ্গে নারী এবং পুরুষ, তাই মুখোশে এই বিষয়টাকে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের সমাজে এমন আরও অনেক মানুষ আছে যারা এই দ্বৈত বিষয়টিকে ধারণ করেন। এরকম অনেকেই আমাদের মুখোশ তৈরির কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন এবং নিজেদের মত করে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। তাদের অনেকের মতামত আমাদের এই মুখোশ নির্মাণেও ভূমিকা রেখেছে।"
এ বছরের ৩০ জানুয়ারি তেহাই-এর স্টুডিওতে 'অগ্নি মঙ্গল' এবং 'শাড়ি উপাখ্যান' পারফরমেন্স দুটো পরিবেশন করা হয়। 'অগ্নি মঙ্গল' পারফরমেন্সের শুরুতেই রূপান্তর বোঝাতে একটা ছোট কাচি দিয়ে রজনী রাউজা নিজের সাদা কস্টিউম কেটে কুচি কুচি করে ফেলেন এবং সেখান থেকে নানান রঙের ছোট ছোট কাগজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও ওই পরিবেশনাতে অনেকগুলো বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে যা মূলত অগ্নির বিভিন্ন রঙ-এর ধারণা থেকে নেওয়া। পারফরমেন্সের পোশাক পরিকল্পনায় রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে উজ্জ্বল কমলা এবং গোলাপি রঙ। আগুনের প্রচলিত রঙয়ের সঙ্গে চরিত্রটির মনোজাগতিক দর্শনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এ রঙ নির্বাচনের ক্ষেত্রে।
পুরো স্থাপনাটিতে দর্শকের সাথে যোগাযোগ সহজ করে তুলতে কিংবা আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছাতে অনেকবার লেখার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে কিন্তু কখনো গে, লেসবিয়ান, বাইসেক্সুয়াল, এলজিবিটি বা রংধনু পতাকা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করা হয়নি, যা এই কাজটির একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দর্শন। রজনীর মতে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আগে অনেক পরিচয়ের মানুষ কোনরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া এ উপমহাদেশে তাদের দ্ব্যর্থবোধকতা নিয়ে বসবাস করতেন এবং তখন কোন আইন ছিল না যা তাদের অপ্রাকৃতিক হিসেবে অন্য চোখে দেখত বা হিজড়া লিঙ্গ বলে গেজেট তৈরি করে আলাদা করে স্বীকৃতি আর উন্নয়নের গোলকধাঁধায় ফেলে দিত।
সমসাময়িক বাস্তবতায় যা বারবার আমাদের সামনে ধরা দেয় তা হল একটা নির্দিষ্ট ধরনের পোশাক পরিধান, কেশবিন্যাস আর বাচনভঙ্গি থাকলেই সুশীল সমাজে আর মিডিয়াতে এ সকল দ্ব্যর্থবোধক পরিচয়ের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। দর্শক হিসেবে তাই যে প্রশ্নটা থেকে যায় তা হলো শিল্পী তার এ গবেষণার মাধ্যমে যে ধরনের জ্ঞান তৈরি করতে চেষ্টা করেছে, তা কি আমাদের উত্তর ঔপনিবেশিক হেজিমনিক সংস্কৃতিকে আসলেই ভেঙ্গে সাজাতে সক্ষম হবে?
***
সমসাময়িক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে শিল্পের বিভিন্ন শাখা বা মাধ্যমগুলোর মধ্যে এক ধরনের সংযোগ তৈরির লক্ষ্যে ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে তেহাই। রাজধানীর পুরানো ঢাকার একটি স্থানে এ সংগঠনটি বিগত দুই বছরে আয়োজন করেছে নানা অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের পাশাপাশি জার্মানি এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত দুইজন শিল্পী তেহাই এর সঙ্গে কাজ করেছেন আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে। নিরীক্ষামূলক বিভিন্ন পরিবেশনা, কমিউনিটি আর্ট, চলচ্চিত্র, থিয়েটার, নৃত্য এবং সাহিত্যের পাশাপাশি নিয়মিত আড্ডার আয়োজন করে তেহাই। বিভিন্ন কর্মশালা, পাঠচক্র কিংবা রিহার্সালের জন্যও তেহাই স্টুডিও ব্যবহার করা হয়।
***
লিটল বক্সেস একজন সংগঠক এবং মাঝে মাঝে সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়ে লেখালেখি করেন। নিরাপত্তার স্বার্থে এই লেখায় কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের নাম উল্লেখ করা হল না।