Published : 07 May 2021, 04:50 PM
সম্প্রতি দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে মুনিয়া নামের একটি মেয়ের আত্মহত্যার মামলা। যে মামলায় আত্মহত্যার প্ররোচনাদানকারী হিসেবে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে আসামী করা হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ মৃত মেয়েটির ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন। কেউ বা সব কিছুর জন্য মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দায়ী করছেন। আরেক দল আবার দুই পক্ষের ওপরই দোষ চাপাচ্ছেন।
অনেকেরই আশঙ্কা যেহেতু ঘটনাটির সঙ্গে দেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম আছে তাই এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হবে না। যা দেশের সাধারণ মানুষের আইনের শাসনের সুফল ও ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অশনি সংকেত। তবে এ ঘটনাটির ব্যাপারে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী সাংবাদিকদের যেসব কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত আশাপ্রদ। তিনি বলেন, "ফ্ল্যাট থেকে মরদেহ উদ্ধারের পর ভুক্তভোগী তরুণীর বোন পুলিশকে জানানোয় উৎসাহী ছিলেন না, তারা মামলা করতেও অতটা ইচ্ছুক ছিলেন না। বাড়ির মালিক পুলিশকে জানান।"
গুলশানের সে ফ্ল্যাটে গিয়ে দেয়ালে টাঙানো মোসরাতের সঙ্গে আনভীরের ছবি দেখা যায় এবং কয়েকটি ডায়েরি পায় পুলিশ। ডায়েরিগুলোয় 'সুইসাইডাল নোটের' মতো অনেক কিছু লেখা। এসব দেখে পুলিশ অনুমান করে, একজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণী মাত্র ২১ বছর বয়সে কোনো কারণ বা প্ররোচনা ছাড়া আত্মহত্যা করতে পারে না। সে রাতেই পুলিশ যা যা তথ্য সংগ্রহ করার দরকার, তার সব সংগ্রহ করে এবং তাৎক্ষণিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মামলা হয়। ওই রাতে তিনিসহ, গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার, সহকারী কমিশনার, গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) সব কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে ছিলেন। এ মামলায় যেন ন্যায়বিচার হয়, সে ব্যাপারে শুরু থেকেই পুলিশ উদ্যোগী ছিল (প্রথম আলো, ২৯ এপ্রিল)।
পুলিশের এ ভূমিকা যেন অব্যাহত থাকে, দ্রুত এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়, সেটাই প্রত্যাশা। কারণ কোনো জীবনই ফেলনা নয়। একটা জীবনের পেছনে অনেক ত্যাগ, সাধনা, পরিশ্রম, যত্ন থাকে। তা হত্যা বা আত্মহত্যার মাধ্যমে শেষ হওয়ার জন্য নয়। মেয়েটি সত্যি সত্যিই যদি আত্মহত্যা করে থাকে, তাহলে সে কেন করলো, কোন ঘটনাটি তার বেঁচে থাকার সকল ইচ্ছেকে ধুলিস্মাৎ করেছে- তা খুঁজে বের করা দরকার। আর এটা যদি হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তাহলেও দোষীদের খুঁজে বের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। দেশে আইন আছে, আইনের শাসন আছে এবং এই আইন সবার জন্য সমান–এটা প্রমাণের দায়িত্ব পুলিশবাহিনী তথা সরকারের।
ইতোমধ্যে ঘটনাটি নিয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের প্র্ররোচনায় এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। মেয়েটির চরিত্র নিয়েও ধারাবাহিকভাবে কুৎসা রটনা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় নারীর প্রতি আমাদের সমাজে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিই যেন আরেকবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেটা হচ্ছে, নারীকে যেকোনো অবস্থায় যৌনতার মোড়কে ঢেকে উপস্থাপন। এ দৃষ্টিভঙ্গির ধারক–বাহকদের কাছে পুরুষের প্রতিপক্ষ একা নারী, মন সেখানে অস্বীকৃত–উপেক্ষিত, কেবল আছে নারীর শরীরটুকু আর তাকে ঘিরে আদিমতার উল্লাস। 'ভোগের' সেই উৎসবে শামিল শত–সহস্র–লক্ষ জন! নিজেদের অতৃপ্ত যৌন লালসাকে একজন নারীর ওপর 'আরোপ' করে বিকৃত আনন্দলাভের চেষ্টা। এই নারীর বিরুদ্ধে যেহেতু 'বিয়ের আগে আরেকজনের সঙ্গে থাকার' অভিযোগ আছে, তাই তাকে নিয়ে আদি রসাত্মক কথা বলায় যেন অপরাধ নেই। এ মানসিকতা ও বিশ্বাসে কিছু কিছু গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার অনেকেই যেন বুঁদ হয়ে আছে।
ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীর বিচার চাওয়ার মতো মানুষ কমে যাচ্ছে। শাস্তি চাওয়ার নামে অনেকে আবার নিজেদের বিকৃতির প্রকাশ করছেন। এই পুরুষতান্ত্রিক বিকৃতির বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়নি বিষয়টি অনেক নারী মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু তারা প্রতিবাদ করারও সাহস পায়নি। প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক বিকৃতির যে সুনামি চলছে, তাতে একজন নারী আরেকজন নারীকে নিয়ে করা নিকৃষ্ট ট্রলের প্রতিবাদ করতে খুব একটা সাহস দেখায় না। প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি আবার তাকেও নিশানা করা হয়। তাকেও 'যৌনকর্মী' কিংবা 'রক্ষিতা' হিসেবে দেগে দেওয়া হয়। যদি তারও ব্যক্তিগত জীবন খুঁড়ে কোনো চরিত্রহীনতার আলামত হাজির করা হয়! মেয়েরা তাই ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। মানুষের জীবনে তো অনেক রকম ঘটনাই থাকে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেকের জীবনেই থাকে লুক্কায়িত নানা অধ্যায়। সেগুলো সব সময় যে 'চয়েস' থাকে, তাও নয়। 'সমাজসিদ্ধ' পথেও সব ঘটে না। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ সেই সব 'দুর্বলতা'গুলোকে সামনে তুলে এনে সামাজিকভাবে তুলে ধরার 'খেলো' চেষ্টা করেই যায়। এটা যে কত বড় অসভ্যতা, তা কে কাকে বোঝাবে?
আসলে আমরা এক ভয়াবহ বিকারের মধ্যে বসবাস করছি। এখানে এক শ্রেণির মানুষ ধর্মের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। কিন্তু নারীদের ব্যাপারে যারপরনাই অসংবেদনশীল। প্রবল নারীবিরোধী মানসিকতা লালন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষ যেন এখনো নারীকে কেবল 'ভোগ্য' বলেই মনে করে। চারদেয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে যারা বাইরে বেরোয় তাদেরই চরিত্রহীন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শিক্ষিত–সচেতন–আধুনিক নারী মানেই তাদের কাছে 'খেলুড়ে।' সমস্ত যোগ্যতা–দক্ষতাকে অস্বীকার করে তাদের 'দেহজীবী' হিসেবে দেখা হয়। তারা 'শরীর দেখিয়ে', 'বিছানায় শুয়ে' যাবতীয় সাফল্য অর্জন করেন বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। এই শ্রেণির পুরুষরা নারীকে অপমান–অপদস্থ আর হয়রানি করে আনন্দ পায়। তাদের কাছে নারীর অপমান, নির্যাতিত হওয়া, এমনকি ধর্ষণ বা মৃত্যু পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত আচরণ ও চরিত্রের 'সমস্যা'। তার পোশাকের সমস্যা। যুক্তি–বুদ্ধি–কাণ্ডজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে আমরা এক অদ্ভুত বিশ্বাসের জগতে বাস করছি। এ 'বিশ্বাস' কেবলই নারীকে 'ভোগ' করতে, 'দখল' করতে, 'নিয়ন্ত্রণ' করতে শেখাচ্ছে। এ মানসিকতার বিরুদ্ধে সামাজিক জাগরণ প্রয়োজন। তবে সবার আগে প্রয়োজন ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যুতি একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়। ন্যায়বিচার ছাড়া কখনোই সভ্য সমাজ ও উন্নত রাষ্ট্র গড়ার কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে সর্বক্ষেত্রে আমাদের ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার কায়েম করতে হবে।
প্রশ্ন হলো, তা কী করে সম্ভব? হ্যা অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা খুঁজে বের করা, যদি এটা আত্মহত্যার প্ররোচনা হয়, তাহলে প্রকৃত দোষীকে বিচারেরে আওতায় এনে কঠিন শাস্তি কার্যকর করা, উপযুক্ত তদন্ত–বিচার, পুলিশসহ বিচারিক কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের সংবেদনশীলতা, তদন্ত–বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা ইত্যাদি। কিন্তু ব্যক্তির চেতনা নির্মাণ বা নারী–পুরুষ–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি সমান সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের শিক্ষাটা আমরা কোথায় পাব? সম্পদ ও শিক্ষার উৎকট বৈষম্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা সমাজ যখন ভোগ আর লালসার সাধনায় মাতে, তখন বিকারের এমন মহামারী জন্ম নেওয়াই স্বাভাবিক! সেখান থেকে উদ্ধার পাবার পথ কী? সেই রাজনীতিই বা কোথায়?