Published : 11 Feb 2012, 09:58 PM
অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের 'চয়েজ, ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড মেজারমেন্ট' বইয়ের চতুর্থ পরিচ্ছদের 'র্যাশনাল ফুলস' শব্দটা আমার খুব পছন্দ। আমি অর্থনীতির ছাত্রী না, এবং অমর্ত্য সেন মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনীতির র্যাশনাল চয়েজ থিওরির যে সমালোচনা করেছেন, সেটাও আমার আলোচনার বিষয় না। কারও আগ্রহ থাকলে খুঁজে পড়ে নেবেন। কিন্তু অমর্ত্য সেনের ব্যবহৃত এ শব্দটা আমার মাথায় বসে গেছে, বর্তমান বাংলাদেশের অনলাইনে হাঁকিয়ে বেড়ানো কিছু স্বঘোষিত 'প্রগতিশীল' এর আচরণ দেখে।
আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথাকথিত কিছু প্রগতিশীলদের আচরণকে ব্যাখ্যা করতে এই শব্দটা প্রয়োগ করতে চাই, তাহলে আমাকে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটা গল্প দিয়ে শুরু করতে হবে।
হোজ্জা একদিন এক কেজি মাংস কিনে এনে দিলেন গিন্নিকে রান্না করতে। গিন্নি রান্নার পর সব মাংস খেয়ে ফেললেন। হোজ্জা খেতে বসে মাংস না পেয়ে জানতে চাইলে গিন্নি জানালেন, বিড়াল সব মাংস খেয়ে ফেলেছে। হোজ্জা তাড়াতাড়ি বিড়ালটাকে ধরে এনে ওজন করে বললেন যে, এটা যদি বিড়াল হয়, তবে আমার মাংস কোথায়? আর যদি মাংস হয়, তবে আমার বিড়াল কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে হোজ্জার গিন্নি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে, মাংস আসলে তিনি খেয়ে ফেলেছেন।
এখন প্রশ্ন হইলো, কোনও গিন্নি কেন একা একা এক কেজি মাংস খেয়ে ফেলবে? কোনও কারণে যদি খেয়েও ফেলেন, বিড়ালের ঘাড়ে কেন দোষ দিবেন? কোনও কারণে বিড়ালের ঘাড়ে দোষ যদি দিয়েও ফেলেন, বিড়াল ওজন করায় কেন গিন্নি কেন ঘাবড়ে যাবেন? এক কেজি মাংস খেলেই যে বিড়ালের ওজনও এক কেজি বাড়বে না, সেটা হোজ্জা যদি বুঝতে পারেন, গিন্নি কেন বুঝবেন না?
এরকম অসংখ্য অসঙ্গতিতে ভরা এ গল্পটা হোজ্জার বুদ্ধি আর বিচক্ষণতার প্রমাণ হিসেবে কীভাবে বিবেচিত হয় আমি বুঝি না। যেমন বুঝি না অনলাইনের কিছু প্রগতিশীলের বুদ্ধি আর বিচক্ষণতাকে। নিজেকে খুব চালাক বা বিচক্ষণ মনে করা হোজ্জা যেমন বিড়ালের ওজনের যুক্তি যে কতটা ফাঁপা আর হাস্যকর সেটা বোঝেননি, তেমনি বোঝে না এ যুক্তিতে মুগ্ধ হওয়া হোজ্জার গল্পের পাঠককূল। একদম ঠিক হেফাজতের মামুনুল হকের যৌন ব্যাভিচারকে মানবাধিকার বলা প্রগতিশীল আর তাদের ফ্যান ফলোয়ারদের মতো।
দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের যৌথ সম্মতিতে যৌন সম্পর্কের অধিকারের তত্ত্ব যে মমিনুল হকদের ক্ষেত্রে খাটে না, সেটা তারা এবং তাদের ফলোয়াররা বোঝেন না। এসব ভুলভাল যুক্তি দিয়ে মামুনুল হকদের করা অ্যাবিউস আর এক্সপ্লয়টেশনের বাস্তবতাকে উনারা আড়াল করার চেষ্টা করেন। তাতে অ্যাবিউসের শিকার নারীর কোনও উপকার তো হয়ই না, বরং অনাদিকাল ধরে টিকে থাকা পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সমাজকাঠামোকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। এবং অন্যদিকে বই পড়ে শেখা এসব পুঁথিগত তত্ত্বও গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
আবার যখন আরেক ক্ষমতাবান ব্যাভিচারী সায়েম সোবহান আনভীরের অপকর্ম প্রকাশ হয়েছে, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল একদিকে নেমেছেন মৃত মেয়েটার চরিত্র ব্যবচ্ছেদ করতে, আরেকদিকে নেমেছেন 'লিভ ইন রিলেশনশিপ' তত্ত্ব নিয়ে।
তাদের মতে, বাংলাদেশের মানুষ এতো অশিক্ষিত আর ব্যাকডেটেড যে যৌনকর্মের জন্য তাদের বিয়ে করতে হয় এবং বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করতে হয়। বাংলাদেশের মানুষ বিয়ের অসারতা আর 'লিভ ইন রিলেশান' এর সার্থকতা বোঝে না! ভাবখানা এমন যে, লিভ ইন রিলেশনশিপে কোন অন্যায় হয় না, নির্যাতন হয় না। বিয়েতে নারীকে এক্সপ্লয়টেশনের যে সুযোগ থাকে, প্রেমে বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে সেইটা থাকে না। এদের কাণ্ডকারখানা দেখলে আমার শুধুই 'র্যাশনাল ফুলস' মনে হয়। কোন যুক্তি কোথায় খাটে সেটা সেটা বুঝতে উনারা একেবারেই অক্ষম, অথবা হয়তো ইচ্ছা করেই না বোঝার ভান করেন। কেউ কেউ নারীবাদীর ছদ্মবেশ নিলেও তারা না বোঝেন নারীর জীবনের বাস্তবতা, না বোঝেন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর নির্মমতা। এ প্রগতিশীলরা নিজেরাও অবশ্য বিয়েই করেছেন তাদের ভাষায় 'যৌনকর্ম' করার জন্য, 'লিভ ইন রিলেশানশিপে' যাওয়ার আধুনিকতা দেখাতে পারেননি। অনেককেই আবার 'লিভ ইন' সম্পর্কে থাকা নিজেদের সহযোদ্ধাদের ব্যাভিচার আর নারী নির্যাতনের ঘটনায় চুপ থাকতে দেখা যায়।
যাই হোক, নিজেকে জ্ঞানী আর প্রগতিশীল দেখানোয় একধরনের নেশা আছে সম্ভবত। ব্যক্তিজীবনে তারা যাই চর্চা করুক না কেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে ব্যতিক্রমধর্মী প্রগতিশীল দেখানোর লোভটা মারাত্মক। মার্কেটে টিকে থাকার ব্যাপারস্যাপারও থাকে মনে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের এরকম বোকা বোকা যুক্তি দেওয়া, বাস্তবতা না বুঝে অপ্রাসঙ্গিক তত্ত্ব ব্যবহার করে আত্মতুষ্টিতে ভোগা বেশকিছু 'র্যাশনাশ ফুলস' উপহার দিয়েছে। যেকোন মারাত্মক অপরাধকে হালকা করে দেওয়ায়, মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ায় এবং অকারণ কুতর্ক তৈরি করায় এদের জুড়ি মেলা ভার।
'র্যাশনাল ফুলস' এ ভরা অনলাইন প্রগতিশীলতার স্কুলস, হায়!