Published : 11 Apr 2021, 10:54 PM
কঠোর লকডাউন হলে হলে হয়তো জীবন বাঁচে, আবার ঢিলাঢালা লকডাউনে জীবিকা বাঁচে। এখন জীবন না জীবিকা, কোনটা বাঁচানোর চেষ্টা করা হবে? জীবন বাঁচানো এবং জীবিকা বাঁচানো– এ দুইয়ের মধ্যে সতর্ক ভারসাম্য রক্ষা করার বড় চ্যালেঞ্জ এখন আমাদের সামনে। সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে, কিন্তু স্থির কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। কাজটা সহজ নয় মোটেই। গোটা পৃথিবী এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এক ধরনের দ্বিধা–দ্বন্দ্বে ভুগছে। আমাদের দেশেও একই অবস্থা। তাইতো লকডাউন, কড়া লকডাউন, কঠোর লকডাউন, সর্বাত্মক লকডাউন ইত্যাদি নানা কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কোনোটাই কার্যকর হচ্ছে না।
জীবন–জীবিকার এ সংকটে ধনী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য যে মাত্রায় সহায়তার ব্যবস্থা করতে পারছে, ততটা করার সুযোগ বাংলাদেশের নেই। আসলে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে জয় পেতে হলে দায়িত্ব নিতে হবে সরকার থেকে জনগণ–সবাইকে। কিন্তু আমাদের দেশে উভয় পক্ষই চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। এখানে সরকারের দিক থেকে পরিকল্পিত উদ্যোগের যেমন অভাব রয়েছে, আবার সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ম মেনে চলার ইচ্ছারও ভীষণ রকম ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু সামাল দিতে যেভাবে, যা করার কথা ছিল, যা করা উচিত ছিল, সেটা সেভাবে আমরা করতে পারছিনা। ফলে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ রোধ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশে প্রতি চারজনে একজন এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে। নজিরবিহীন এ জনস্বাস্থ্য সংকটে এ দরিদ্র মানুষগুলোকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ মানুষগুলোর রুটি–রুজির ব্যবস্থা করার জন্য কোনওপরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। দিনে এনে দিনে খাওয়া এসব মানুষদের তাই কোনো ধরনের বিধিনিষেধের মধ্যেও আনা যাচ্ছে না। আবার কিছু ক্ষেত্রে খামখেয়ালিপনাও রয়েছে। ক্রমবর্ধমান করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর মধ্যেও বইমেলা চালু রাখার সিদ্ধান্ত আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনাহীনতা ও নির্বুদ্ধিতারই প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
করোনাভাইরাস মহামারী সরকারকে যেমন একদিকে কঠিন আর রূঢ় বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে, তেমনি এখন নাগরিকদের জীবন ও জীবিকার সমন্বয়ের চেষ্টাও আরেকটি বড় সংকট হয়ে সামনে এসেছে। কাজটা সত্যিই খুব কঠিন। মানুষ ব্যক্তিগত সুরক্ষার নিয়ম কতটা মানছে এবং মানুষকে তা মানাতে সরকার কতটা কী করতে পারছে– তার ওপরই নির্ভর করছে সব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে এবং সামাজিকভাবে মানুষ যাতে সতর্কতাগুলো মেনে চলতে পারে, সরকারকে সে ব্যবস্থা নিতেই হবে। কিন্তু ভাইরাসের বিস্তার সীমিত রাখতে ব্যক্তিগত সচেতনতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকরাও সীমাহীন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। আপনি, আমি, আমরা সবাই যদি নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি, নিজেদের পাশাপাশি অন্যদের সুরক্ষায় যেসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হচ্ছে, সেগুলো যদি মেনে চলি, তাহলে ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ থাকবে না। কিন্তু এ কাজটি দেশের বেশিরভাগ নাগরিকই করছে না। এতে করে ভাইরাসের বিস্তারও কমছে না।
কোভিড–১৯ সংকটে করণীয় নিয়ে গেল বছরের এপ্রিলে ভারতীয় গণমাধ্যমে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ দম্পতি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলোর অভিমত প্রকাশিত হয়েছিল। কোভিড মহামারীতে সব চাইতে বড়, সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা কী? এ প্রশ্নের উত্তরে তারা একমত হয়েছেন যে, "এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মানুষের জীবন বাঁচানো, অদূর ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে তাদের কাজে ফেরানো। তার পরবর্তী সময়ের সমস্যা– স্বাভাবিক অর্থনীতিতে ফিরে যাওয়া। আজ আমরা প্রাণ বাঁচাতে যা করছি, তার পরিণাম বড় হতে হতে যেন ভবিষ্যতে জীবিকা হারানোর কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, তা দেখতে হবে।"
আসলে বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এখন সব দেশের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত অবশ্যই মানুষের জীবন বাঁচানো। কারণ মানুষের জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই। সেই জীবন এখন করোনাভাইরাসের কারণে বিপন্ন। যতটা সম্ভব নিজেকে একা রাখা, সঙ্গ বর্জন করা, বার বার হাত ধোয়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনা চলাই সবচেয়ে বড় কর্তব্য। যাতে সংক্রমিত লোকের সংস্পর্শে এসে রোগ না ছড়ায়। পাশাপাশি যাদের মধ্যে করোনার লক্ষণ প্রকাশ পাবে, তাদের দ্রুত পরীক্ষা করানো এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে আমাদের চিকিৎসকের কথা শুনতে হবে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। কারণ এর বাইরে কারও হাতে নিরাময়ের অন্য কোনো উপায় নেই। মনে রাখা দরকার যে, বিশ্বজুড়ে টিকাদান কর্মসূচি চলার পরও কিন্তু থেমে নেই করোনার ভয়াবহ আগ্রাসন ! তাই স্বাস্থ্যমবিধি মেনে চলার বিকল্প কিছু নেই।
বর্তমান পরিস্থিতি যদি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে তাহলে বড় ধরনের দুর্যোগ নেমে আসবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে একটা অস্বাভাবিক জীবন যাপন করা মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। মানুষ যদি অবাধে চলাফেরা করতে না পারে, কাজ করতে না পারে, তাহলে এক সময় বাঁচার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সব কিছু বন্ধ রেখে মানুষকে ঘরের মধ্যে রাখতে পারলে হয়তো কিছু কম লোক মারা যেতে পারে। আবার অন্য দিকে, দীর্ঘদিন বাড়িতে বসে থাকার, সব কিছু বন্ধ রাখার একটা আলাদা চাপ আছে। এটা অনেকদিন বহাল রাখলে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে।
বর্তমানে আমরা বাস করছি চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। এ ভাইরাস যেভাবে রূপ ও চরিত্র বদলাচ্ছে, তাতে কোনো কিছুই আগাম বলা সম্ভব হচ্ছে। কোনো কোনো গবেষক অনুমান করছেন যে, আগামী জুলাই-অগাস্ট নাগাদ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। গরম ও আর্দ্রতা বাড়লে ভাইরাস আরও বিপজ্জনক দিকে মোড় নিতে পারে। তবে এটা যে হবেই–এর কোনো বাস্তব পর্যবেক্ষণ নেই। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এই ভাইরাস সম্পর্কে আমরা আসলে প্রায় কিছুই জানি না। তবে নানা দিক থেকে আমাদের দেশ হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ। এখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, অনেকের ডায়াবেটিস, হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি উপসর্গ রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জীবনযাত্রার পার্থক্য রয়েছে। আমাদের দেশে ভেজাল ও দূষণের প্রভাব রয়েছে। এগুলোতে ফুসফুসের ক্ষতি হয়, তা সমস্যাকে আরও বাড়ায়। তাই এখানে কেউ স্পষ্ট করে জানে না এই সব কিছুর কী প্রভাব পড়বে।
আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল। ডাক্তারদের এ ধরনের রোগের চিকিৎসা দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। আবার চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে ডাক্তার–নার্সরাও নিয়মিত আক্রান্ত হয়ে ছুটিতে থাকছেন। হাসপাতালে বেড নেই, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর নেই। চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা–সরঞ্জাম নেই। অপ্রতুল চিকিৎসাসেবার এই দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে কীভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়–সেই চেষ্টাও নেই। এদিকে নিম্নবিত্ত–মধ্যবিত্তের আয় কমেছে। সামর্থ্যের অভাব এবং ভবিষ্যতের ভাবনায় অনেকে ব্যয়ও কমিয়ে দিয়েছে। এতে করে সামগ্রিক অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অত্যন্ত নির্দয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। গবেষকরা বলছেন, আক্রান্তদের ৬০ থেকে ৮০ ভাগ সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট! করোনার এই নতুন ধরনটি কীভাবে আমাদের দেশে এলো, কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল? এর জন্যও আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি ও গাফিলতি দায়ী। করোনাভাইরাসের ইউকে, সাউথ আফ্রিকা ও ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে পৃথিবীজুড়ে তোলপাড় ও আতঙ্ক শুরু হলেও আমাদের দেশে এ ব্যাপারে তেমন কোনো প্রস্তুতি বা বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মহামারীর প্রথম ঢেউয়ে আমরা ভেসে যাইনি বলে আমরা ঠিকই বিমানবন্দর খুলে রেখেছিলাম। যারা সতর্ক থেকেছে, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিয়েছে, তারাই রেহাই পায়নি। আর আমাদের উদাসীনতা বিমাবন্দর হয়ে বিশ্বের সব রকম ভয়াবহ স্ট্রেইন অবাধে প্রবেশ করেছে। ইচ্ছে মতো ছড়িয়েছে। সাউথ আফ্রিকা ও ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট মোটামুটি এখন অরিজিনাল স্ট্রেইন তো বটেই, ইউকে ভ্যারিয়েন্টকেও মুছে দিচ্ছে। 'দৈবক্রমে' বা প্রকৃতির সহায়তায় প্রথম ঢেউ এ রক্ষা হলেও, এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে কতটুকু রক্ষা হবে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে নতুন ভ্যারিয়েন্টকে নিষ্ক্রিয় করার ব্যাপারে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে, সন্দেহ, প্রশ্ন। আবার ভ্যাকসিনের জোগান নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। তাহলে আমাদের বাঁচার উপায় কী? আপাতত একটাই উপায়- তা হলো আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়া, স্বাস্থবিধি মেনে চলা।