Published : 07 Apr 2021, 11:09 PM
এক
চোখ আটকে গেল একটা খবরে- যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে এক বাড়ি থেকে ৬ বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ, যাদের মধ্যে পাঁচজনই একই পরিবারের সদস্য। 'বিষণ্নতা থেকে' পরিবারটির দুই তরুণ সহোদর তাদের মা-বাবা, নানী ও একমাত্র বোনকে হত্যার পর নিজেরাও আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশের ধারণা করছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ টেক্সাসের সচিব নাহিদা আলী জানিয়েছেন, ঘটনার সময় ওই বাড়িতে তৌহিদুল ইসলাম (৫৬), তার স্ত্রী আইরিন ইসলাম নীলা (৫৫), দুই ছেলে তানভির তৌহিদ (২১) ও ফারহান তৌহিদ (১৯), মেয়ে পারভিন তৌহিদ (১৯) ও তার তৌহিদের শাশুড়ি আলতাফুন্নেসা (৭৭) ছিলেন। তারা সবাই মারা গেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকের সংবাদাতাকে তিনি বলেন, "পারভিন পড়তেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। সপ্তাহখানেক আগে তাকে নিউ ইয়র্ক থেকে বাসায় নেওয়া হয়। ফারহান গত বছর ভর্তি হয়েছিলেন অস্টিনের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে। তানভিরও পড়তেন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের অস্টিনে। তার এবারই গ্র্যাজুয়েশনের কথা। ফারহান আর পারভিন ছিলেন জমজ। আর আলতাফুন্নেসার গত সপ্তাহে বাংলাদেশে ফেরার কথা ছিল। করোনাভাইরাস জটিলতায় তা স্থগিত হয়ে যায়।"
এ সংবাদটিতে আপাতত পরে আসছি। তার আগে অন্য কিছু পরিসংখ্যানের দিকে বরং নজর দেই।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেড় বছরেরও কম সময়ে পৃথিবীব্যাপী মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ২৯ লাখ ছুঁইছুঁই করছে। রোগের প্রকৃতি মারাত্মক ছোঁয়াচে হওয়ার কারণে আতঙ্কের পরিমাণ আরও বেশি। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এক বছর এক মাসে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার মানুষ মারা গেছেন।
পরিসংখ্যানে ভোগান্তি সবসময়ই অনুপস্থিত। কোভিড সংক্রমণ হওয়ার পরে পৃথিবীতে যতো মানুষ মারা গেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ হয়েছেন ভোগান্তি ও হেনস্তার শিকার। দেশে দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পড়েছে একেবারেই ভেঙে।
করোনাভাইরাস সরব ব্যধি। সারাবিশ্বের মিডিয়া এর পেছনে আঁটঘাট বেঁধে ছুটছে। কিন্তু একটি নীরব ব্যধি ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে একটি প্রজন্মকে। সেটি হলো- আত্মহত্যা প্রবণতা।
২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম দশমাসে দেশে চলমান মহামারীর মধ্যে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ৫ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেই সময় ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন বলে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী।
করোনাভাইরাসে মৃত্যুর থেকে আত্মহত্যায় মৃত্যু দ্বিগুণের বেশি!
এবার শুরুর খবরে আবার ফেরত যাই। আত্মহত্যার ঠিক আগ দিয়ে টেক্সাসে নিহত বাংলাদেশি পরিবারের একজন ১৯ বছর বয়সী ফারহান ফেইসবুক পোস্টে তাদের মৃত্যুর বর্ণনা দিয়েছেন।
সেখানে তিনি লিখেছেন- সেখানে তিনি ২০১৬ সালে নবম গ্রেডে পড়াবস্থায় 'বিষন্নতায় আক্রান্ত' হয়েছিলেন। এজন্য তার শিক্ষাজীবন বির্পযস্ত হয়। অবস্থা গুরুতর হলে বন্ধুরা তাকে ত্যাগ করে। এক পর্যায়ে জীবন দুর্বিষহ হলে তিনি আত্মহত্যার কথা ভাবেন। কিন্তু তিনি মারা গেলে পরিবারের অন্যরা কষ্ট পাবেন। তাই তাদেরও হত্যার পরিকল্পনা করেন। এর সঙ্গে ভাইকে যুক্ত করে তারা বন্দুক কেনেন।
তিনি আরও লিখেছেন, "আমি যদি আত্মহত্যা করি তাহলে গোটা পরিবার সারাটি জীবন কষ্ট পাবে। সেটি চাই না। সেজন্যে পরিবারের সকলকে নিয়ে মারা যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বড় ভাইকে শামিল করলাম। দুই ভাই গেলাম বন্দুক ক্রয় করতে। আমি হত্যা করব ছোটবোন আর নানীকে। আমার ভাই হত্যা করবে মা-বাবাকে। এরপর উভয়ে আত্মহত্যা করব। কেউ থাকবে না কষ্ট পাবার।"
সাম্প্রতিক ঘটনা বলে আত্মহত্যার ঘটনটি নিয়ে এখনো মনোবিদদের বিশ্লেষণ আসেনি। তবে একটা ব্যাপার কিন্তু বলাই যায়, ফারহানের বিষণ্ণতা কোনও না কোনওভাবে তার বড়ভাইকে স্পর্শ করেছিল। তাকেও বিষণ্ণতায় আক্রান্ত করেছিল। শেয়ার্ড পারসোনালিটি ডিজওর্ডার কি!
অর্থাৎ বিষণ্ণতা ও মানসিক রোগও ছোঁয়াচে। কোভিডের মতোই এটাও একটি পরিবারকে এবং একটি সমাজকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার হলো- মনোরোগের কোনও ভ্যাক্সিন নাই, কখনো হবে কিনা কে জানে!
বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশও। তবুও কমছে না আত্মহত্যা।
একটি হিসেব বলছে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বের কোথাও না কোথাও, একজন মানুষ আত্মহত্যা করছেন। অর্থাৎ বছরে প্রায় ১০ লাখের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করছে বছরে।
আত্মহত্যা করার কারণগুলোও বেশ অদ্ভুত! হাতখরচ, জামা, মোবাইল, মোটরবাইক কেনার টাকা দেয়নি বলে, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল, জিপিএ ৫ না পাওয়ায়, প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদ, হতাশা… ইত্যাদি ইত্যাদি। অভিমান কত ঠুনকো অথচ ভয়াবহ বিষয় ভাবতে পারেন!
কার্টুন কিংবা নাটক সিরিয়াল দেখতে দেয়নি বলেও আত্মহত্যা করেছে, এমন শিরোনামের খবর পত্র-পত্রিকায় এসেছে। সাইবার বুলিং, হ্যারাজমেন্টের জন্য মানুষ আত্মহত্যা করেছে।
প্রতিবছর বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার পর, বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে আত্মহত্যার। কারণ, ফলাফল খারাপ, অকৃতকার্য হওয়া নয়তো জিপিএ ৫ পায়নি!
আমরা কি আত্মহত্যা নিয়ে যথেষ্ট কথা বলছি? সচেতন হয়েছি? কেন মানুষ নিজের জীবন দিয়ে দেয়? কেন মানুষ এত সুন্দর পৃথিবীতে আর বেঁচে থাকতে চায় না? কিসের এত ডিপ্রেশন? একাকিত্ব?
বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের মধ্যে কেউ আত্মহত্যা করলে আমরা তখন সেই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলি। দুই এক কলম লেখাও লিখি।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে প্রতিবাদ করি। আত্মহত্যা নিয়ে পোস্ট দেই। কয়েকটা লাইক-কমেন্ট পাই, এই আর কি।
এর বেশি আর কিছু হয় বলে, অন্তত আমি মনে করি না।
প্রতিবছর বেশ ঘটা করে ১০ সেপ্টেম্বর 'বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস' পালন করে থাকি। এরপর সারা বছর আমরা সব ভুলেই বসে থাকি।
দুই
এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্যক্তিগত একটি কাজে গিয়েছিলাম গুলিস্তান এলাকায়। সেখান থেকে শাহবাগ যাচ্ছিলাম, ভালবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুনের প্রতিবেদন করতে। বাসে ওঠার পর পরিচয় হয় দুইটি ছেলের সাথে।
বাচ্চা ছেলে, গুলিস্তান থেকে এয়ারপোর্টে যাচ্ছে। বয়স ১২ পেরোয়নি। উদ্দেশ্য, মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করবে। টাকা চাইবে। সারাদিন ভিক্ষা করে যা টাকা উপার্জন করবে, সেটা দিয়েই দুইজন কোনমতে খাবার খাবে। ঘর বাড়ি নেই, থাকে রাস্তাঘাটে।
গল্প গল্প করতে আমার সাথে ওদের খুব ভাব হলো। ওরা দুইজনও আমার সাথে নেমে পড়লো শাহবাগে। একটি হোটেল থেকে সিংগারা, সমুচা কিনে দিলাম। কিন্তু খেতে চাইলো না। বললো, খুব ক্ষুধা লেগেছে, ভাত খাবে।
সে মুহূর্তে আমার পকেটে বাস ভাড়া বাদে বাড়তি টাকা খুব সামান্য। ওদের দুইজনকে সামান্য ডাল-ভাত খাওয়ানোর সামর্থ্য সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেয়নি। নিজের কাছে খুব অপরাধী মনে হলো নিজেকে।
আশেপাশে কতশত মানুষ আনন্দ করছে। ভালবাসা দিবস উদযাপন করছে। ফাল্গুনের আনন্দ করছে। ফুল কিনছে, বেলুন কিনছে, ফুচকা-চটপটি, বাদাম-কোক-চা আরও কত কিছুই না খাচ্ছে। অথচ, আমার সামনে থাকা বাচ্চা দুইটা গতরাত থেকে না খাওয়া। অথচ আমি ওদেরকে একবেলার খাবারও কিনে দিতে পারবো না। হায়, কি আফসোস।
২০১৯ সালের জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬৯ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে।
অর্থাৎ, বিশ্বে ৬৯ কোটি মানুষ খাবার খেতে পায় না। তাদের কাছে টাকা নেই, খাবার নেই। না খেয়েই এরা অনাহারে রাত কাটিয়ে দেয়। করোনাভাইরাসের কারণেই এ সংখ্যা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি বাড়তে পারে বলে আশংকা জাতিসংঘের।
২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে যে পরিমাণ খাবার তৈরি করা হয়েছে, তার ১৭ শতাংশই অপচয় করেছে মানুষ। দ্য ফুড ওয়াস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২১ জানাচ্ছে এ তথ্য।
দেশের প্রথম অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, মহামারীর কারণে সাহায্য-সহায়তা কমে যাওয়া, ব্যাপক বেকারত্ব, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন- এসব কারণে এ বছর প্রায় ১২ কোটি ২০ লাখ মানুষ অনাহারে পড়তে পারেন।
জাতিসংঘের আরেকটি প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বছরে পরিবারপ্রতি খাদ্য অপচয় হয় গড়ে ৬৫ কেজি। এছাড়াও গৃহস্থালী থেকে দেশে প্রতি বছর ১ কোটি ৬ লাখ টন খাবার অপচয় হচ্ছে।
আমি, আপনি, আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণ খাবার অপচয় করি তা দিয়ে হয়তো এ মানুষগুলোর পেট ভরতো। কিন্তু না, আমরা তাদের নিয়ে ভাবিনি। এত ভাবনার সময় কোথাও আমাদের। আমরা সকলেই ব্যস্ত৷
তবে কিছু সামাজিক সংগঠন, ফাউন্ডেশন, সংস্থা রয়েছে যারা এই অনাহারী, অর্ধাহারী মানুষগুলো খাবার খাওয়ায়। তাদের জন্য অপচয় কিছুটা হলেও কম হয়। তবে এমন মানুষ খুবই কম।
কিছু মানুষ 'স্বাধীনতা' বোঝে না, কিছু মানুষ 'উন্নয়ন' বোঝে না। এরা বোঝে না সহিংসতা, ধর্ম-বর্ণ-জাতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, হিংসা-বিদ্বেষ। তারা শুধু জানে এক বেলা আধ-পেট খেয়ে হলেও দিন কাটাতে হবে। পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে।
কে খেলো, কে না খেলো, কে মরলো-বাঁচলো এতে যেন আমাদের কিছুই যায় আসে না। নিজে খেয়েছি, বেঁচে আছি এই যেন আমাদের কাছে অনেক কিছু।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে চলে এসেছি আমরা। অথচ এখনো এই আত্মহত্যা, খাদ্য সমস্যা, মৌলিক চাহিদা নিয়ে ভাবছি না। এইগুলোকে আমরা আমাদের প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচনায় নিচ্ছি না।
তিন
পৃথিবীর মানুষ করোনাভাইরাসকে যতটা প্রাধান্য দিয়েছে, যতটা মাথা ব্যথার কারণ এটি, এটি প্রতিরোধে যেমন সচেতন হয়েছি, ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করেছি, ঠিক তেমনি এই বিষয়গুলোও নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। খাদ্য অপচয়, সংকট, আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ এ সমস্যাগুলোর সমাধান করা উচিত।
আত্মহত্যা, খাদ্য অপচয়, সংকটে প্রতিদিন হাজারেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। আত্মহত্যাও ছোঁয়াচে, খাদ্য সংকটও ছোঁয়াচে- অস্থির করে তোলে মানুষের এগিয়ে যাওয়া।
কোভিড-১৯ যেমন আমাদের জন্য সমস্যা, ঠিক তেমনি এই বিষয়গুলোও যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ। এর ভয়াবহতা বিশাল।
সমাধান আছে। মানুষ চাইলেই পারে, এমন নীরব ঘাতক থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে। মানুষ চাইবে কি? নীরব ব্যধি দমনে মানুষের ভূমিকা নিয়ে ইতিহাস বড় নিরাশ করে যে!