Published : 13 Feb 2021, 12:39 PM
ক্রীড়াঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে
একাত্তরের রণাঙ্গনে ক্রীড়াঙ্গনের মানুষগুলোকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছরে ক্রীড়াঙ্গনের অর্জনগুলো কোনভাবেই পূর্ণতা পায় না। খেলার মাঠ থেকে দেশের মুক্তিকামী মানুষের কাতারে মিশে যাওয়ার বীরত্ব গাথার উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের খেলাধুলা।
কাল রাত্রি: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ
বিভীষকাময় রাত বললেও কম বলা হয়। নিরীহ বাঙালি হত্যার নারকীয় উল্লাসে মত্ত পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। আর বাঙালির ঘরে ঘরে স্বজনহারাদের আহাজারী। অনেকের মতোই নিখোঁজ হলেন ওই সময়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেট ক্লাব আজাদ বয়েজের অন্যতম সংগঠক মুশতাক আহমেদ। দুদিন পর তার ঝাঝরা হয়ে যাওয়া নিথর দেহ মিলল ঢাকা জেলা ক্রীড়া পরিষদ ভবনের সামনে। লাশ শনাক্ত করলেন পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে খেলা সাড়া জাগানো ওপেনার জুয়েল। প্রিয় সংগঠকের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে করণীয় ঠিক করে ফেললেন – আগে দেশ স্বাধীন, পরে ক্রিকেট খেলব। বাকিটা ত্রিশ লাখের একটি গল্প।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই
তখনও স্বাধীন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে 'স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল'-এর হয়ে মাঠে নেমে পড়লেন জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শংকর হাজরা, কাজি সালাউদ্দিনরা। ম্যাচের আগে বেজেছে 'আমার সোনার বাংলা', উড়েছে পতাকা। এরপর পুরো ভারত জুড়ে ম্যাচ খেলেছে 'স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল'। একে একে ১৫টি ম্যাচ। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মাঠে নামা মানেই মানুষের ঢল। স্বাধীন দেশের বার্তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি প্রবাসী সরকারের হাতে অর্থও তুলে দিয়েছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
১২ অক্টোবর ১৯৭১
স্মরণ করা যাক, বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের লেখক শওকত আলী'র 'স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর' বইটির কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিদিনের ঘটনাপঞ্জি সরল ভাষায় লিখেছেন শওকত আলী। ১২ ডিসেম্বর দিনলিপিতে তার লেখা হুবহু তুলে ধরা হলো- "সাঁতারু অরুন কুমার নন্দী বিশ্বরেকর্ড করে বসে আছে। কাছে গিয়ে এই বীরকে অভিনন্দন জানাতে হয়। তার কৃতিত্ব স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমূল্য অবদান। একটানা লাগাতার সাঁতারের বিশ্বরেকর্ড ছিল ৮৯ ঘন্টা ৩৫ মিনিট। অরুন নন্দী ৯০ ঘন্টা ৫ মিনিট সাঁতরে সে রেকর্ড চুরমার করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের অধিবাসীর এই তাক লাগানো ম্যাজিক এই দুর্দিনে বিশ্ববাসীকে আমাদের আরো কাছে টেনে আনবে।
৮ অক্টোবর ১৯৭১। সকাল ৮ টা ৩৫ মিনিট। কলকাতার কলেজ স্কয়ারের বাধাঁনো ঘাটে হাজারো মুক্তিকামী মানুষের ভীড়। মাইকে বাজছে 'আমার সোনার বাংলা'। কূটনীতিকদের মধ্যে প্রথম বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বনকারী হোসেন আলী ওড়ালেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন অরুন নন্দী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই সংবাদ জানানো হলো বিশ্ববাসীকে। এর আগে টানা সাঁতারের বিশ্বরেকর্ডটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবি মুনের। এই বিশ্বরেকর্ড ভাঙার ধনুকভাঙা পণ করে টানা চারদিন পুলে কাটিয়ে দিলেন অরুন নন্দী। ১১ তারিখ দিবাগত রাত ২ টা বেজে ৪০ মিনিটে পুল থেকে উঠলেন। ততক্ষণে বিবি মুনের ৮৯ ঘণ্টা ৩২ মিনিটের বিশ্বরেকর্ড এক মুক্তিপাগল বাঙালির দখলে। রাতের নিস্তবদ্ধতা ভেঙে হাজারো বাঙালির 'জয় বাংলা' স্লোগানে তখন কেঁপে কেঁপে উঠছে আকাশ -বাতাস।
অরুন নন্দীকে নিয়ে বেশ বড় কলেবরে একটা লেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বিশ্বরেকর্ড ভেঙে পুলে ওঠার সময়টা সঠিক মনে করতে পারেননি এই জলবীর। কেননা টানা চার দিন সাঁতার কাটার পর জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তবে জ্ঞান ফেরার পর বাকি অংশটুকু ভালভাবেই মনে করতে পেরেছিলেন। অরুন নন্দীর ভাষায়, "জ্ঞান ফেরার দেখি অনেকেই আমার শরীর ম্যাসাজ করছে। একজন সুদর্শন যুবকের দিকে চোখ পড়ল। তিনি বিখ্যাত সাংবাদিক আবেদ খান।"
এ বিশ্বরেকর্ড নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে স্বনামে রিপোর্ট লেখেন আবেদ খান। রিপোর্টের শিরোনাম ছিল- "বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী বাংলাদেশের ছেলে অরুন নন্দী।" ওই রিপোর্টে তিনি লেখেন, "এই সেই লোক যে প্রচণ্ড স্পর্ধার সঙ্গে ঘোষণা করছে, বাংলাদেশের মানুষ হিসাবে আমি প্রমাণ দিতে চাই, আমরা খেলো নই, তুচ্ছ নই।"
মুত্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জন্য ত্রাসে পরিণত হয় 'ক্র্যাক প্লাটুন"। এই ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য ছিলেন ক্রিকেটার জুয়েল। ২২ গজের এই পরীক্ষিত ওপেনার পরিণত হলেন জীবনবাজী রাখা গেরিলাযোদ্ধায়। ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের ভয়ে হানাদার বাহিনীর রাতের ঘুম হারাম হওয়ার যোগাড়। এরকম একটা সময়ে, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্লান্টেশনে অপারেশনের রেকি করতে গিয়ে রামপুরা বিলে হানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারের মুখে পড়েন জুয়েল। ডান হাতের তিনটা আঙ্গুল মারাত্মকভাবে জখম হয়। মগবাজারে আজাদদের বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেন। ২৯ তারিখে স্থানীয় রাজাকাররা ধরিয়ে দেন জুয়েলকে। এরপর তথ্য আদায়ের জন্য তার উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। টোপ দেয়া হয় পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলার। কিন্তু কোন কিছুই টলাতে পারেনি জুয়েলকে। ৩১ অগাস্টের পর আর কোন খোঁজ মেলেনি এই সূর্যসন্তানের।
স্বাধীনতার ডাকে জীবনকে হাতের মুঠোয় তুলে নিয়েছিলেন মাঠের যোদ্ধারা। দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছিলেন তারা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার মাঠে বাংলাদেশের অর্জন কতটা সমৃদ্ধ সেটা অন্য প্রসঙ্গ। তবে মাঠ থেকে পাওয়া বাংলাদেশের প্রতিটা গর্বের সঙ্গে যে জুয়েল, অরুন নন্দী কিংবা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যদের আশীর্বাদ আছে তা বলাই বাহুল্য।