Published : 29 Jan 2021, 02:06 AM
এলিজাবেথ কিশ্চিনোভস্কি মাসুর ১৯২৭ সালে সাবেক চেকশ্লোভাকিয়ার একটি ছোট গ্রামে ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীবাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে পোল্যান্ডের কুখ্যাত অশউইৎজ (Auschwitz) ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন তিনি এবং ১৯৪৫ সালে হিটলার পতনের পর মুক্তিলাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীবাহিনীর গণহত্যা ও নির্মম অত্যাচার সহ্য করেও হাতেগোণা যে কয়েকজন কালের সাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে আছেন, এলিজাবেথ মাসুর তাদের মধ্যে একজন।
২৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক হলোকাস্ট বা গণহত্যা স্মরণ দিবস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটিত বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার একজন মূর্তমান সাক্ষী হিসেবে এলিজাবেথ মাসুরের এই সাক্ষাৎকারটি নেন লেখক ও সাংবাদিক সাব্বির খান।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এলিজাবেথের স্মৃতিতে অনেক কিছু ঝাপসা হয়ে এলেও প্রায় সব প্রশ্নের জবাবই তিনি স্পষ্টভাবে দিয়েছেন। প্রাসঙ্গিক আলাপে উঠে এসেছে তার শৈশব, তৎকালীন সমাজে ইহুদীবিদ্বেষ ও তার অনুভূতি, যুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধোত্তর বিশ্ব, অশউইৎজ-এ বন্দীজীবন ও অত্যাচার এবং যুদ্ধোত্তর জীবনযাপনের কথা ছাড়াও ভবিষ্যত নিয়ে তার আশা-নিরাশার কথা।
সাব্বির: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পূর্বের আপনার শৈশবের একটি স্মৃতির কথা বলুন, এখনো যা ভাবলে আপনার ভাল লাগে।
এলিজাবেথ: সুখস্মৃতি বলতে যা বোঝায়, আমি তা বলতে পারব না। জীবনে সুখস্মৃতি বলতে আসলে তেমন কিছুই নেই। আমার শৈশব ও কৈশরে যা ছিল, তার সবটুকুই দুঃস্বপ্নের মতো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই আমাদের জীবন কেটেছে দুঃসহ কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে। ইহুদীবিদ্বেষের বিষ ছড়ানো ছিল সর্বত্রই। সমাজের ঘৃণা আর বিদ্বেষের মাঝেই আমার জন্ম হয়েছিল সাবেক চেকোশ্লোভাকিয়ার একটি গ্রামে। আমরা পাঁচ ভাইবোন ও বাবা-মা সেখানেই থাকতাম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ভাই এমেরিচ রোথ সবার বড়। তারপর বোন এডিথ, আমি ও আমার ছোট দুই বোন। বাবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আহত হয়ে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়েছিলেন। অসচ্ছল সংসারে অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে ভাইবোনেরা তেমন কিছুই করতে পারতাম না। আসলে তা সম্ভবও ছিল না। আমরা চেকশ্লোভাকিয়ার যে অংশটিতে ছিলাম, তা ছিল মূলত হাঙ্গেরির অধীনস্ত ছোট একটি গ্রাম। যে কারণে বাড়িতে আমরা হাঙ্গেরিয়ান ভাষাতেই কথা বললেও আমি চেকশ্লোভাকিয়ান স্কুলেই যেতাম।
সাব্বির: আপনার বয়স কত ছিল যখন অশউইৎজ-এ আনা হলো?
এলিজাবেথ: তখন আমার বয়স ষোল বছর ছয় মাস। সে বছর ডিসেম্বরে সতেরতম জন্মদিন অশউইৎজ বন্দীশিবিরে পালন করেছিলাম। ক্যাম্পে আমার কিছু বন্ধু ছিল। আমরা একই গ্রাম থেকে এসেছিলাম। বন্দীশিবিরের ছোট ছোট ক্যাম্পখাটে আমরা ঘুমাতাম। একটা খাটে তিনজন। খাটে জায়গা স্বল্পতার জন্য সবাই এক দিকে মুখ করে পাশকাত হয়ে শু'তাম, যাতে পড়ে না যাই। ঘুমের মধ্যে একজন পাশ ফিরলে বাকি দু'জনকেও একই দিকে পাশ ফিরতে হতো। ঘুমের মধ্যেও প্যারেডের মতো এই অভ্যাসটা আমাদের তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, সেই বন্ধুরা আমার সতের-তম জন্মদিনটি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় আমরা ভান করেছিলাম সুখি এবং খুশি হওয়ার। একসাথে গান গেয়েছিলাম। সেদিন আমার জীবনের সবচেয়ে দামী উপহারটি পেয়েছিলাম সেই বন্ধুদের কাছ থেকে। ওরা আমাকে একটুকরো রুটি উপহার দিয়েছিল জন্মদিনে। ক্ষুধার তীব্র কষ্টে যে যন্ত্রনা আমরা বয়ে বেড়াতাম প্রতি মূহূর্ত, তা তুলনা করার মতো কিছু পৃথিবীতে আমি আজও খুঁজে পাইনি। খাবার নিয়ে ক্ষুধার্ত বন্দীদের মাঝে মারামারির ঘটনা ছিল বন্দীশিবিরের নৈমিত্তিক বিষয়। অথচ সেদিন তাদের দেয়া একটুকরো রুটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার, যার সাথে আমি কোন কিছুর তুলনা আজও করতে পারিনি।
সাব্বির: মুক্ত হয়েছিলেন কবে?
এলিজাবেথ: ১৯৪৫ সালের মে মাসে যখন আমার বয়স হয়েছিল সতের বছর ছয় মাস। আঠারোতম জন্মবার্ষিকী আমি সুইডেনে পালন করেছিলাম।
সাব্বির: আপনার বড় ভাই এমেরিচ এখনো বেঁচে আছেন। আপনার বাবা, মা এবং বাকি তিন বোনের কি হয়েছিল যদি একটু বলতেন।
এলিজাবেথ: গ্রাম থেকে ধরে ট্রেনে তোলার পর আমরা জানতাম না আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। শুধু বুঝতে পারছিলাম, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমাদের যখন মালবাহী ট্রেনের বগি থেকে নামানো হলো, তখন দেখলাম আউশউইৎজ, শ্রমশিবির এবং মানুষ পোড়ানোর শ্মশান। খুব ভয় পেয়েছিলাম আমরা। তারা আমাদের বিভিন্ন দলে ভাগ করেছিল। আমি আর আমার বোন এডিথ ছিলাম এক গ্রুপে, মা ও ছোট দুইবোন অন্য গ্রুপে। বড় ভাই ও বাবাকে তখন দেখিনি কোথাও। তারাও সম্ভবত আলাদা কোন গ্রুপে ছিল। আমাদের নিয়ে যাওয়ার সময় মা ও ছোট দুইবোনকে শুধু হাত নেড়ে বিদায় জানাতে পেরেছিলাম। তারপর তারা হারিয়ে গিয়েছিল। আর কোনদিন দেখিনি।
বন্দীশিবিরে বিভিন্ন অত্যাচারের মধ্যে "ডেথ-মার্চ" ছিল ভয়ংকর একটা। ডেথ-মার্চ হচ্ছে বিরতিহীন হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে মুখ থুবড়ে পড়ে মরে যাওয়ার নাম "ডেথ-মার্চ"। বাঁচার জন্য হাঁটা। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে, সে হাঁটা যেন শেষ হতো না। একদিন ডেথ-মার্চ চলাকালীন অসুস্থ, পঙ্গু বাবাকে যখন আর পিঠে বইতে পারছিল না, তখন পথে ফেলে রেখে আমার বড় ভাই এমেরিচ চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর বাবার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
আমার সাথে থাকা বড়বোন এডিথের মৃত্যু আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। তার মৃত্যু আমি কখনো ভুলতে পারি না এবং এজন্য আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারিনি। একদিন এডিথ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে সুস্থ বন্দীদের থেকে আলাদা করতে তাকে বন্দীশিবিরের ভিতরেই অন্য একটা জায়গায় নিয়ে যায়। তখন কেউ অসুস্থ্য হলে তার মৃত্যুকে তরান্বিত করার জন্য আলাদা করে ফেলাই ছিল মূল লক্ষ্য। আমার বোনকে যখন সৈন্যরা নিয়ে যায়, তখন আমিও পেছনে পেছনে গিয়েছিলাম। সেখানকার অবস্থা দেখে ভয়ে আমি দৌড়ে চলে আসি। তারপর থেকে আমার মনে হতো, অসহায় বোনকে মৃত্যুর দুয়ারে রেখে সেদিন আমি পালিয়েছিলাম। তারপর থেকে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারিনি, কোনদিন পারবও না!
সাব্বির: বন্দীশিবিরে সকাল থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত পূর্ণ একটা দিনের বর্ণনা বা চিত্র যদি তুলে ধরতেন…
এলিজাবেথ: সেখানকার অনেক কিছুই এখন স্মরণে নেই। অনেক কিছু বলাও সম্ভব হয় না। প্রায় প্রতিদিনই আমাদের নিয়ে যাওয়া হত খোলা মাঠে। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের দিয়ে ঘাস কাটানো এবং আগাছা পরিষ্কার করানো হতো। কোনদিন হয়ত কোন কারখানায়। সেখানে পেরেক মারার কাজ ছাড়াও বিভিন্ন যন্ত্রাপাতিতে স্ক্রু লাগানোর কাজ করতাম আমরা। হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। অবশ হয়ে যেত সারা শরীর। কিন্তু কোন টু-শব্দটিও করতে পারতাম না। সেখানে জার্মান মহিলারা হিংস্র প্রকৃতির ছিল। তাদের মনে কোন দয়ামায়া ছিল না। আমাদের ঘৃণা করত তারা। খারাপ ব্যবহার ছাড়াও শারীরিকভাবে অত্যাচার তো নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। একদিন এক মায়ের একমাত্র শিশু সন্তানটি মারা গেলে পাগলপ্রায় মা তখন চিৎকার করে কান্না করছিলেন। তখন জার্মান এক মহিলা সেই মায়ের পা শেকল দিয়ে বেঁধে একটা গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। তারপর আমাদের সেখানে জড়ো করে শোকে মূহ্যমান চিৎকাররত ঝুলন্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে। সেই মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখা যে কতটা মানসিক অত্যাচার, তা কেউ না দেখলে বুঝতে পারবে না। জার্মান মহিলারা যখন এরকম আচরণ করত, তখন আক্ষরিক অর্থে তারা পশুর চেয়েও হিংস্র হয়ে যেত। প্রতিদিনই এরকম ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমরা বেঁচে থাকতাম। আমরা যখন মাঠে কাজ করতাম, তখন মাঝে মাঝে আকাশে প্লেনের আওয়াজ পেতাম। তখন দেখতাম সেই জার্মান মহিলারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে ক্যাম্পের ভিতরে আশ্রয় নিত। আমরা দৌড়াতাম না, ভয়ও পেতাম না। বাঁচা-মরার অনুভূতি ছিল না আমাদের।
সাব্বির: বন্দী অবস্থায় বাইরে যুদ্ধের কোন খবর পেতেন? শত দুর্দশার মধ্যেও এমন কিছু কি ছিল, যা আপনাদের আশাবাদী করে তুলত?
এলিজাবেথ: না, বাইরের কিছুই অশউইৎজ-এর কঠিন দেয়াল ভেদ করে ভিতরে পৌঁছত না। আমার বয়স তখন খুবই কম। অনেক মা ছিলেন, তারা খুব দুঃসহ সময় কাটাতেন। প্রতিমুহূর্তেই তারা ভয়ে থাকতেন, কি হবে বা ঘটতে চলেছে…। আমাদের কোন আশাই ছিল না বাঁচার। প্রতিমুহূর্ত ক্ষুধার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে মরে যাওয়াকেই শ্রেয় ভাবতাম। প্রচণ্ড ক্ষুধায় যুদ্ধ বা অন্যকিছু মাথায়ই আসত না তখন। প্রতিদিন খাবার পেতাম না। একদিন খেলে জানতাম না পরে আবার কবে খাবো। খাবার বলতে পানিতে ফোটানো স্যুপ জাতীয় কিছু একটা।
প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে রাতে যখন আমরা ঘুমাতে যেতাম, তখন মনে পড়ত মায়েদের হাতের সুস্বাদু খাবারের কথা। আমরা মুখে মুখে সে খাবারগুলো রান্না করতাম, ঠিক রান্নাঘরে যেভাবে মায়েরা রান্না করতেন। তারপর কিভাবে জানি না, কিন্তু মুখে মুখে রান্না শেষ হলে বাতাসে সে খাবারের চমৎকার ঘ্রাণ পেতাম, অনুভব করতাম সে খাবারের স্বাধ। 'মুখে রান্না' করা খাবারগুলো তখন মনে মনে খেতাম। বেশ তৃপ্তি পেতাম তখন। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে যেতাম জানি না।
আসলে খাবার যে কি, তা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। না খেতে খেতে আমাদের চিন্তাশক্তিও কাজ করত না। প্রতিদিনকে 'একটি দিন' হিসেবে নিতাম এবং দিনটা কোনভাবে পার করতাম। তারপর আবার একটা দিন আসত। এভাবেই কাটত দিনগুলো। একসাথে 'অনেকগুলো দিন' আমরা ভাবতে পারতাম না।
সাব্বির: আপনার মুক্তির অনুভূতির কথা বলুন। মনে আছে সেদিনের কথা?
এলিজাবেথ: যুদ্ধ যখন শেষ হলো এবং জার্মানরা বুঝতে পারছিল না যে, আমাদের নিয়ে কি করবে। তখন তারা শত শত বন্দীদের সাথে আমাকেও একটা মালবাহী ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। ট্রেন কিছুদিন পেছনের দিকে চলে, তারপর আবার সামনের দিক চলে। এভাবে সামনে-পেছনে একটানা দশ দিন চলেছিল। ট্রেনে কোন খাবার অথবা পানি ছিল না। কত মানুষ ট্রেনে মারা গিয়েছিল তার কোন হিসেব নাই। চোখের সামনে মরতে দেখেছি, লাশের স্তুপ দেখেছি। মৃত্যুও সেদিন আমাকে স্পর্শ করেনি। কোন ভয় বা কষ্টের অনুভূতি সেদিন আমার ছিল না। বাঁচা-মরার ভাবনা কি রকম হয়, তাও সেদিন ভুলে গিয়েছিলাম।
যুদ্ধের পরে যখন টিভিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন ডকুমেন্টারিতে হাজার হাজার উৎফুল্ল মানুষকে রাস্তায় বেরিয়ে আনন্দ করতে দেখেছি। রাস্তার দু'পাশে বিল্ডিংয়ের বেলকনিতে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে শিষ বাজিয়ে দু'হাত তুলে উচ্ছাস প্রকাশ করতে দেখেছি। বিজয়ের পতাকা হাতে নিয়ে রাস্তায় দৌড়াতে দেখেছি মানুষকে…। হ্যা, আমি মনে করতে পারি সে দিনটির কথা। শত শত মানুষ ছিলাম "ডেথ-মার্চ" ট্রেনের ভিতর। ট্রেনটি যখন জার্মানি থেকে ডেনমার্কের বর্ডারে এসে থামল, বগীর গেট খুলে দেয়া হলো। আমাদের গায়ে তখনও পরা ছিল অশউইৎজ-কয়েদীদের "নীল ড্রেস"। আমরা বাঁধহীন স্রোতের মত বগী থেকে লাফিয়ে নেমে পাগলে মতো দ্বিগবিদিক দৌড়াচ্ছিলাম। জীর্ণশীর্ণ, ক্ষুধার্ত শরীরের শেষশক্তি দিয়ে লাফাচ্ছিলাম। পাগলের মতো চিৎকার করছিলাম। কেউ আমার একটা জিনিস কেড়ে নিয়ে দৌড় দিয়েছিল। তার পেছনে ছুটেছিলাম। ধস্তাধস্তি করে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম আমার জিনিস। সবাই যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। স্বাভাবিক বোধহীন আমরা কোন কিছুতেই বিব্রত হচ্ছিলাম না। মনে আছে, ট্রেনটি পৌঁছেছিল খুব ভোরে, যখন আশেপাশের কেউ জেগে ছিল না। আমি দৌড়াচ্ছিলাম একটা পথ ধরে। এক ঘরের সামনে গোয়ালার রেখে যাওয়া এক বোতল দুধ দেখে দৌড়ে গিয়ে দুধটুকু এক চুমুকে খেয়ে ফেলেছিলাম। অন্য দরজার সামনে থেকেও আরো কিছু একটা নিয়েছিলাম, ঠিক মনে করতে পারছি না। এগুলো নিতে আমার তখন কোন লজ্জাবোধ হয়নি। আসলে নাৎসীদের অশউইৎজ বন্দীশিবিরে আমাদের বোধশক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। শরীরের উপরে চামড়া জড়ানো এক একটা মমিতে পরিণত করেছিল আমাদের। খুব সুস্থ মাথায় মুক্তির স্বাধ বোঝার জন্য যে মানবিকবোধের দরকার হয়, তা আমার ভিতরে সেদিন ছিল না।
সাব্বির: 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ', 'বন্দী শিবির', 'গণহত্যা' 'হিটলার'…শব্দগুলো শুনলে আপনার অনুভূতি কেমন হয়? ভয়, সংকোচ, ক্রোধ, কান্না অথবা অন্যকিছু?
এলিজাবেথ: না না, আমি মোটেও ভয় পাই না এসবে। তবে প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ হয়। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে অনেক টিভি চ্যানেল হিটলারের উপরে অনেক সিনেমা বানিয়েছে। এখনো দেখায় সেগুলো। নিজেকে প্রশ্ন করেছি, আমি কেন এসব দেখছি, কেন এই চেহারার দিকে তাকাচ্ছি। আমার অনুভূতিতে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই কখনো জায়গা পায়নি।
সাব্বির: আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের আলোকে বর্তমান বিশ্বকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
এলিজাবেথ: আগামী ডিসেম্বরে আমার বয়স হবে তিরানব্বই বছর। আমি এতটা আবেগপ্রবণ নই যে, দুনিয়াকে খুব সহজেই বিদায় বলব। যুদ্ধশেষে আমি খুব সুন্দর একটা জীবন পেয়েছি। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে চমৎকার একটা পরিবার আমি পেয়েছি। সবকিছুর পরেও আমি উদ্বিগ্ন হই যখন ভাবি, আমি চলে যাওয়ার পর আমার সন্তানদের জন্য কেমন ভবিষ্যত রেখে যাচ্ছি। যাপনের জন্য বর্তমান পৃথিবী কোনভাবেই নিরাপদ নয়। এ ভাবনা আমাকে বিচলিত করে। আমার মেয়ে মিরিয়ামকে যখন জন্ম দেই, সেটা ছিল একটা মিরাকল। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি যে আমি মা হতে পারব। কারণ নাৎসীদের বন্দীশিবিরের মেয়েদের স্যুপের সাথে কিছু একটা মিশিয়ে দিত, যাতে তারা প্রজননক্ষমতা হারায়। ধরেই নিয়েছিলাম, আমি মা হতে পারব না। কিন্তু আমার মেয়ের জন্মের পর আমি সত্যিকারের মুক্তির স্বাধ পেয়েছিলাম। কিন্তু মা হওয়ার পরেও সারাক্ষণ ভয় আমাকে তাড়া করে ফিরত। আমি ঘুমাতে পারতাম না, বাচ্চাকে ঠিক মত দুধও খাওয়াতে পারতাম না। বন্দীশিবিরে আমার উপর দিয়ে যে অসহনীয় নির্যাতনের ঝড় বয়ে গিয়েছিল, সে কথাগুলো মনে পড়ত। মনে হতো, মেয়েকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে। এসব কথা আমার স্বামীকেও বলতে পারতাম না। সেই থেকে আমি ভয়ে থাকি, আমি না থাকলে আমার সন্তানদের কি হবে!
সাব্বির: শুরুতে শৈববের কথা বলছিলেন। আপনি সে সময়ের সাথে বর্তমানের কোন মৌলিক পার্থক্য দেখেন?
এলিজাবেথ: না, তেমন কোন পার্থক্য দেখি না। তবে মনে হয়, আগের চেয়ে বর্তমানটা অনেক বেশি খারাপ। বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় ইহুদীবিদ্বেষের কথা। ছোটবেলায় স্কুলে যখন যেতাম, তখন অন্য ছেলেমেয়েরা আমার বই ছিড়ে ফেলত, ছুড়ে ফেলে দিত কলম-খাতা। আমাদের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করত। আমি সমাজের এই বিদ্বেষ আর ঘৃণা দেখে দেখে বড় হয়েছি, যার ঘ্রাণ বাতাসে আমি এখনো পাই। ধর্মীয় মৌলবাদ বিশ্বে এক ভয়াবহ এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। আমি খুব বিস্মিত হই ভেবে যে, ধর্ম কিভাবে মানুষকে চালিত করে! যে কারণে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়, একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
সাব্বির: ২৭ জানুয়ারি 'আন্তর্জাতিক হলোকাস্ট বা গণহত্যার স্মরণ দিবস'। মন্তব্য?
এলিজাবেথ: রাজনীতিতে ধর্মের সংমিশ্রণ এবং তা থেকে মানুষ হত্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি ঠিক বুঝি না, বিশ্বাস বা মতপার্থক্য কেন সংঘর্ষের কারণ হবে। আমি কোন রাজনীতিবিদ নই। তবে, রাজনীতির মানেই যদি হয় হানাহানি, যুদ্ধ বা হত্যা, তাহলে সে রাজনীতির প্রয়োজন নেই। তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য বিরাজ করবে, এটাই তো সুন্দর এবং আমারও চাওয়া। নতুন প্রজন্মের প্রতি আমার আহবান থাকবে, তারা যেন ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী হয় এবং সেই শিক্ষা থেকে বর্তমান বিশ্বটাকে বোঝার চেষ্টা করে। সুন্দরকে গ্রহণ করতে হবে এবং অসুন্দর-অমানবিকতাকে পরিহার করতে হবে।
সাব্বির: সময় এবং সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আমার এবং পাঠকদের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
এলিজাবেথ: তোমাকে এবং পাঠকদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাকে শোনার জন্য। সবার মঙ্গল কামনা করছি।