Published : 23 Jan 2021, 06:58 PM
বাংলাদেশের নাগরিকদের মতোই পাকিস্তানের সিন্ধ ও বালুচিস্তানের মানুষ পাক-বাহিনীর অমানবিক অত্যাচারের শিকার। দখলদার পাক-সেনারা বালুচদের ওপর প্রতিনিয়ত বর্বর আক্রমণ চালাচ্ছে, এবং হরণ করছে মানবাধিকার। এমনই অভিযোগ বালুচ নেতাদের। সিন্ধ থেকেও উঠছে পাকিস্তানি বর্বরতার নানা অভিযোগ। বালুচিস্তানের মানুষও আজ বিদ্রোহী। তারাও চাইছেন পাকিস্তানি দখলদারির থেকে মুক্তি। নতুন করে সেখানকার মানুষরাও প্রস্তুত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের জন্য।
সম্প্রতি পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের বালুচিস্তান প্রদেশের হরনাল জেলায় আধা সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আক্রান্ত হয়। সীমান্ত বাহিনীর বহু সেনা এই আক্রমণে প্রাণ হারান। পাক-সেনা মিডিয়া উইং ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশন (আইএসপিআর) ঘটনার কথা স্বীকার করেছে। তাদের বিবৃতি অনুযায়ী, সীমান্ত বাহিনীর ঘাঁটি মধ্য রাতে আক্রান্ত হয়। এই ঘটনায় নতুন করে অশান্তির কালো মেঘ দেখা দিয়েছে পাকিস্তানে। কারণ বালুচিস্তান পাকিস্তানে সবচেয়ে সম্পদশালী রাজ্য। আয়তনে সবচেয়ে বড় হলেও লোকসংখ্যা অবশ্য এখানে অনেক কম। বালুচিস্তানের মানুষদের বঞ্চিত করে পাক-সরকার বহুদিন ধরেই শোষণ আর বঞ্চনা চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছর কোরবানির ঈদের দিন, ৩ অগাস্ট বিদেশে নির্বাসিত বালুচরা পালন করেন তাদের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু ভারত সরকার কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় পাক-সরকারের চেঁচামেচিতে স্বাধীনতা দিবস পালনের খবর চাপা পড়ে যায়।
১৪ অগাস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস পালনের দিনই ক্ষুব্ধ বালুচ নাগরিকরা পালন করেন বালুচিস্তান সংহতি দিবস। সামাজিক গণমাধ্যমে তারা সকলকে স্মরণও করিয়ে দেন, বালুচিস্তানিরা কেউই পাকিস্তানি নন। বরং পাকিস্তানিরাই বালুচদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে পদদলিত করে রেখেছে। পাকিস্তানি দখলদারদের ওপর নিজেদের ক্ষোভ উগরে দেন বালুচরা।
আসলে ঐতিহাসিকভাবেও বালুচিস্তান কখনওই পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল না। ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙে পাকিস্তান তৈরির আগে ব্রিটিশ জমানায় কালাট, লাসবেলা, খারান ও মাকরান এই চার রাজন্য শাসিত রাজ্যকে নিয়েই ছিল বালুচিস্তান। ব্রিটিশ জমানায় লাসবেলা ও খারানের শাসনভার কালাতের খানদের হাতে ন্যস্ত ছিল। আর মাকরান ছিল কালাতেরই একটি জেলা। কালাত আরও আগে ছিল দিল্লির মুঘল সম্রাট আকবরের অধীনে। ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশদের শাসনে চলে আসে।
উল্লেখ্য, বালুচিস্তানের মানুষদের সঙ্গে প্রথম থেকেই প্রতারণায় সামিল হন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ স্বয়ং। পাকিস্তান গঠনের মাত্র ৩ মাস আগে থেকে বালুচিস্তানের স্বাধীনতা নিয়ে বিশেষ তৎপরতা শুরু করেন জিন্নাহ। বেশ কয়েকবার দিল্লিতে বৈঠকও করেন ব্রিটিশ ভাইসরয়ের সঙ্গে। আলোচনা হয় পাকিস্তান ও কালাটের ভবিষ্যত সম্পর্ক নিয়েও। ১৯৪৭ সালে ১১ অগাস্ট চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। কিন্তু জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানি মুসলিম লিগ বেঈমানি করে বালুচ নেতাদের সঙ্গে। ১৯৪৭ সালের ১২ অগাস্ট বালুচিস্তান স্বাধীন বলে ঘোষিত হলেও ১৯৪৮-এর ২৬শে মার্চ পাকিস্তান দখল করে নেয় গোটা বালুচিস্তান।
সামরিক শক্তিবলে পাক-সেনা দখল করে বালুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা। কালাটের খান আহমেদ ইয়ার খান আহমেদজাই-এর প্রাসাদ দখল করে শুরু হয় অত্যাচার। বালুচিস্তানের মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন সেদিন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা যেমন বর্বরতা দেখিয়েছিল বাংলাদেশে, তেমনি অত্যাচার শুরু করে বালুচিস্তানেও। চলে গণহত্যা। লুটপাট। নিরীহ মানুষরা প্রাণ হারাতে থাকেন পাক-সেনার অত্যাচারে। সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে পাক-হানাদার বাহিনী। পাক-হানাদাররা বালুচিস্তান দখল করে রাখলেও বালুচ নেতারা আজও স্বপ্ন দেখেন সেই স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী বালুচ নেতারা দুনিয়ার মানবাধিকার কর্মীদের কাছে আবেদন জানিয়ে চলেছেন, তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির। হাজার হাজার বালুচ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। বহু লাশ গায়েব করা হয়েছে। এই অত্যাচারে বিচার চান তারা।
এদিকে, চীন পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) চুক্তি সম্পাদনের জন্য বালুচদের ওপর অত্যাচার আরও বেড়ে গিয়েছে। ওয়ার্ল্ড বালুচ উইমেনস ফোরামের প্রধান নায়লা কাদরি বালুচের অভিযোগ, পাকিস্তান বালুচিস্তানের সমস্ত প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদ লুঠ করছে। তার প্রশ্ন, বালুচিস্তানকে চীনের হাতে বিক্রি করে দেওয়ার অধিকার পাকিস্তানকে কে দিয়েছে? তার সাফকথা, পাকিস্তান দখল করে রেখেছে বালুচিস্তান। নিজেদের জন্মভূমিকে দখলমুক্ত করতে বালুচরা সরব হবেই। সেই সঙ্গে চীনের হাতে গওয়াদার বন্দর তুলে দেওয়ার কোনও অধিকার যে পাকিস্তানের নেই, সেটাও স্পষ্ট করে দেন তিনি। সিপিইসি-র বিরুদ্ধে বালুচরা লড়াই করবে বলেও হুমকি দিয়েছেন নায়লা। এদিকে, বালুচদের মুখপত্র ভয়েজ অফ মিশিং বালুচ পার্সনস-এ বলা হয়েছে, লক্ষাধিক বালুচ নাগরিককে হত্যা করে গায়ের জোরে পাকিস্তান তাঁদের মাতৃভূমিকে দখল করে রেখেছে।
সম্প্রতি, বালুচ ন্যাশনাল মুভমেন্ট লন্ডনে প্রতিবাদে সামিল হন। তাদের দাবি, বালুচ নারী ও শিশুদের ওপর পাক-সেনার অত্যাচারের বিচার করতে হবে। বালুচদের এই প্রতিবাদ সভায় তাদের দুই শীর্ষ নেতা ফারহাদ বালুচ ও ফরিদ বালুচ বলেন, পাক-সেনারা যে অত্যাচার নিরীহ নাগরিকদের ওপর চালাচ্ছে তাতে আমরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ। তারা বলেন, "পাকিস্তানি সেনা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল, নারী ও শিশুদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছিল, লক্ষাধিক মানুষ খুন করেছিল, ঠিক সেভাবেই বালুচদের ওপরও পাকিস্তানিদের জুলুম বেড়ে গিয়েছে।"
অনেকটা বালুচিস্তানের মতোই পরিস্থিতি সিন্ধেরও। সিন্ধ আনপ্রেসেন্টেড নেশনস অ্যান্ড পিপলস অর্গানাইজেশন (ইউএনপিও)-র সদস্য দেশ। সিন্ধকেও দখল করে রেখেছে পাকিস্তান। সিন্ধের সমস্যা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরছে বিশ্ব সিন্ধি কংগ্রেস। আওয়ামী তেহরিক নেতা রসুল বক্স পালিজো দুনিয়ার জনমতকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তার সাফকথা, বাংলাদেশ ও বালুচিস্তানের মতোই পাকসেনা সিন্ধেও অবৈধ দখলদারির স্বার্থে মানবাধিকার লুণ্ঠন করে চলেছে। সিন্ধিদের তুর্কি নেতা জিএম সৈয়দ প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক দল জে সিন্ধ-এর দাবি, স্বাধীন সিন্ধ।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সৈয়দ ও পালিজো সমর্থন জানিয়েছিলেন। দুজনকেই সেই কারণে জেলও খাটতে হয়। বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শকে পাথেয় করে বালুচ ও সিন্ধ-এর নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। বঙ্গবন্ধু এই দুই প্রদেশেই খুব জনপ্রিয়। অনেকেরই রোল মডেল বাংলাদেশের জাতিরপিতা। ১৯৭০ সালে নির্বাচনের পর বালুচ ও সিন্ধের মুক্তি নিয়েও সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু অপারেশন সার্চ লাইটের নামে পাকিস্তানি বর্বরতা সবকিছু বদলে দেয়। বালুচ নেতারা তবু আজও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে মুক্তির স্বপ্ন দেখছেন। তাদের বিশ্বাস পাক-সেনার অত্যাচারের হাত থেকে বাংলাদেশের মতোই তারাও একদিন মুক্তি পাবেন। চলছে তারই প্রস্তুতি। তাঁরা চাইছেন, পাকিস্তানের মানবাধিকার বিরোধী আচরনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠুক মানব বিবেক।