আফ্রিকান একটি প্রবাদে আছে– একটি শিশুকে গড়ে তুলতে লাগে একটি গ্রাম। আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে বলতে পারি– একটি শিশুকে গড়ে তুলতে লাগে একটি রাষ্ট্র।
Published : 20 Mar 2025, 05:51 PM
ধর্ষণ ও নির্যাতন বিশেষ করে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা আজ যে বিরাট আকার ধারণ করেছে তা খুবই আশঙ্কাজনক। মাগুরার ছোট্ট সেই শিশুটির মৃত্যু স্তম্ভিত করেছে সারা দেশকে। কিন্তু তারপরও তো থেমে নেই ধর্ষণ, নির্যাতন ও সহিংসতা। এর প্রতিবাদ করতে গিয়েও জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এক পক্ষ প্রতিবাদ করলে আরেক পক্ষ তাকে দুরভিসন্ধিমূলক বলে মনে করছে। ফলে শুরু হয়েছে মিছিল-পাল্টা মিছিল, প্রতিবাদের প্রতিবাদ, হামলা-পাল্টা হামলা ইত্যাদিসহ অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। কিন্তু মানুষের নৈতিক অবক্ষয় দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে, আর সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে এসব ভয়ঙ্কর ঘটনাও। এসব ঘটনার দায়দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদের ওপরই বর্তাবে।
আগের আমল থেকে দেখা গেছে শিশু ও নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, সহিংসতা ইত্যাদির সঙ্গে ক্ষমতার একটি যোগ থাকে। নির্যাতক, ধর্ষক ও সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের সঙ্গে ক্ষমতার যোগসাজশটা মোটেও কাকতালীয় নয়, পরিকল্পিত। কোনো না কোনোভাবে শাস্তি এড়ানোর ও আইন কিংবা তার প্রয়োগকে বুড়া আঙুল দেখানোর একটা সুযোগ থেকেই সাধারণত এ ধরনের অপরাধীরা উৎসাহিত হয়ে থাকে। লক্ষণীয়, এ ধরনের বড় বড় ঘটনার ক্ষেত্রে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি উল্লেখযোগ্য নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধী কিছুদিন পর বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ানো শুরু করে। এই জন্য বিকৃত কামনাবাসনা যেমন দায়ী, ক্ষমতার সঙ্গে সংযোগ বা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ উপায়ে তার ছায়ায় আশ্রয় পাবার সুযোগ যে এ ধরনের ঘটনায় ইন্ধন জোগায় তাতে সন্দেহ নেই। অন্তর্জালের মাধ্যমে যে এসব মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে তা-ও সত্য, এর সঙ্গেও ক্ষমতার সম্পর্কটা বিচ্ছিন্ন নয়।
লুণ্ঠনের অবাধ সুযোগ তৈরি করে দেয় যে– তার নাম রাষ্ট্রক্ষমতা। রাষ্ট্র সৃষ্টির শুরু থেকে পৃথিবীতে ধনসম্পদ তৈরির যত রকমের সুযোগ আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো রাষ্ট্রক্ষমতায় কোনোরকম ভাগ পাওয়া। যে দেশ যত পশ্চাৎপদ সে দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা তত বেশি লুণ্ঠনবৃত্তিতে নিয়োজিত। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে তো সম্পদ আহরণের অন্যতম, অনেকক্ষেত্রে একমাত্র উপায়ই হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা।যার প্রতিক্রিয়ায় বহুদেশে গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতিও তৈরি হয় ও ঘটে থাকে। রাষ্ট্রসম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার করে কোটিপতি হওয়ার নজির এ দেশেও হাজার হাজার। রাষ্ট্রক্ষমতাটা যেখানে যত বেশি লুণ্ঠনবৃত্তিক, সেখানকার সমাজেও ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়ে লুণ্ঠনের মনোভঙ্গি। এই মনোভঙ্গি মানুষকে বিকৃতমনস্ক করে ধনসম্পদকে ছাপিয়ে নারী ও শিশু পর্যন্ত হাত বাড়াতে প্রবৃত্ত করে। সমাজে এই মনোভঙ্গির উপস্থিতি ও তার বিস্তার লুণ্ঠনবৃত্তিসম্পন্ন ক্ষমতাসীনদের জন্য সহায়ক। মানুষের নৈতিক স্খলন অন্যায়ের প্রতিবাদের শক্তি ও ইচ্ছা কেড়ে নেয়, আখেরে যা সবদেশে সবকালে ক্ষমতাসীনদের জন্যই লাভজনক।
খুব ভুল ও অন্যায়ভাবে এসব আচরণকে আমরা বর্বর, পাশবিক ইত্যাদি নামে অভিহিত করি। তথাকথিত বর্বর, সভ্যতাপূর্ব কিংবা জঙ্গলের সমাজে এসব আচরণ থাকেই না। বাংলা নাটকের দিকপাল পুরুষ উৎপল দত্ত বেশ আগে তার একটি সাক্ষাৎকারে এ কথাই বলেছিলেন। কারণ তাদের থাকে না লুণ্ঠনবৃত্তিক কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রচরিত্র। এসব স্পষ্টভাবেই সভ্যতার তথা বিকৃত, ক্ষয়িষ্ণু বা নষ্ট সভ্যতারই চিহ্ন। আমরা কেউ এ সমাজব্যবস্থাকে ছুঁড়ে ফেলে কিং লিয়রের মত জঙ্গলে ফিরে যেতে পারব না, ঠিক। তবে দার্শনিক রুশোর পরামর্শ শুনে প্রকৃতির প্রতি আরও সশ্রদ্ধ হওয়ার শিক্ষাটা নিতে পারি। প্রকৃতির প্রতি সমীহ আমাদেরকে শিশু ও নারীর প্রতি সমীহের শিক্ষা দেয়। কেননা সমগ্র প্রকৃতি প্রতিষ্ঠিত এই স্বভাবের ওপর। শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতা আধুনিক সভ্যতার দান, যে সভ্যতার সামাজিক-অর্থনৈতিক চরিত্র হচ্ছে চৌর্যবৃত্তি– ও লুণ্ঠনবৃত্তিমূলক, অর্থাৎ অবাধ বাজারি পুঁজিবাদ।
তবে উন্নত পুঁজিবাদও গঠন করা সম্ভব যেখানে রাষ্ট্র অনেক বেশি সমাজ ও নাগরিকের প্রতি দায়িত্বশীল, ইউরোপে এরূপ রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে সম্প্রতি আমাদের দেশে পানি অনেক ঘোলা করা হয়েছে, কাজ তেমন কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। সম্প্রতি নারী ও শিশুর প্রতি যে অমানুষিক সহিংস মনোবৃত্তির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে তা বন্ধ করা আমাদের অস্তিত্বের জন্যই প্রয়োজন। অতএব একে অন্যতম রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সেজন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে একটি ছোট্ট পরিবর্তন বিরাট প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বাংলাদেশকে একটি শিশু-বান্ধব রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা ও প্রতিজ্ঞা– ঠিক সুকান্তের ঘোষণার মত: এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
বর্তমানের যুদ্ধবাজ ও দখলদারিত্বের পুঁজিবাদ এ বিশ্বকে জন্মমাত্র শিশুর সামনে যে উপহার দিচ্ছে তা নরকের চেয়ে ভয়াবহ– প্রতিদিন লাইভস্ট্রিমে পাওয়া ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীর। স্পষ্টতই ট্রাম্প-মাস্ক ও নেতানিয়াহুর আমলে পুরো বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলা অসম্ভব। নিজ দেশটিকে অন্তত আমরা শিশু-বান্ধব করে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে পারি। বিশেষত বর্তমান অন্তবর্তী সরকার এ পদক্ষেপ নিতে পারে যেখানে দেশের ইতিহাসে এই প্রথম তরুণরা শাসনভার হাতে তুলে নিয়েছেন এবং একটা অংশ সরাসরি সরকারে অংশগ্রহণ করেছেন। বৃদ্ধদের চেয়ে তারা মোটেও খারাপ করেনি, অনেকক্ষেত্রে বরং ভাল করছে। এটি চব্বিশে আবির্ভূত বাংলাদেশের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। এখানে স্মরণীয় যে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের চালিকাশক্তিই ছাত্রতরুণরা। অতএব এই সময়ে একটি শিশু-বান্ধব বাংলাদেশ গড়ে তোলার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি যদি তা জানি ও কাজে লাগাই।
এই প্রসঙ্গে শিশু নিয়ে কহলিল জিবরানের একটি পৃথিবীবিখ্যাত কবিতার কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করতে চাই (তবে আমার ভাষায়):
“তোমার সন্তান তোমার সন্তান নয়
তারা জীবন-কামনার একান্ত ছেলে ও মেয়ে
তোমার মাধ্যমে এলেও তারা তোমার থেকে নয়
তোমার সঙ্গে থাকে তারা, তবু তোমার সম্পদ নয়।”
অর্থাৎ শিশু কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। শিশু সমাজের, সবার। তাকে নিজের ইচ্ছে মতো তৈরি করা যায় না। তার বিকাশের নিজস্ব নিয়ম আছে, সে নিয়মকে মানতে ও শ্রদ্ধা করতে হয়। কবি জিবরানের শিশুচিন্তার সঙ্গে ইতালীয় শিক্ষাবিদ মারিয়া মন্তেসরির শিশুভাবনারও মিল আছে। মারিয়া মন্তেসরি তার ‘আপনার শিশু সম্পর্কে আপনার যা জানা উচিত' বইতে বলেছেন: “মানুষের ভোগ্যবস্তুগুলোই যদি শ্রমিক উৎপাদন করে এবং সে যদি সকল বাহ্যবস্তুর নির্মাতা হয়, তাহলে তো শিশু খোদ মানবজাতিকেই উৎপাদন করে, আর এ কারণেই সমাজ রূপান্তরের প্রশ্নে তার অধিকার প্রবলতর।” আমাদের রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকেও এ বিষয়ে অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
আফ্রিকান একটি প্রবাদে আছে– একটি শিশুকে গড়ে তুলতে লাগে একটি গ্রাম। আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে বলতে পারি– একটি শিশুকে গড়ে তুলতে লাগে একটি রাষ্ট্র, অথবা আরও সঠিক ও স্পষ্টভাবে– রাষ্ট্রের প্রধান, অন্যতম ও একমাত্র কাজই হলো সে দেশের প্রত্যেকটি শিশুকে সুন্দর জীবনের জন্য গড়ে তোলা। সমাজের ও রাষ্ট্রের বোধোদয় হতে হবে যে, শিশু মানবজাতির ভবিষ্যৎ। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তবে শিশু জাতির হৃদপিণ্ড, তার প্রাণ। হৃদপিণ্ড সুস্থ না থাকলে শক্ত মেরুদণ্ডও কোনো কাজে আসবে না।
আমরা আমাদের একশ বছর পরের ভবিষ্যৎ চোখে দেখতে পারি না, কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু ২০-৩০ বছর পরের ভবিষ্যৎ নিতান্ত অন্ধ না হলে সবসময়ই দেখতে পাই। সে ভবিষ্যৎ বর্তমানেই আছে, শিশুরূপে। ২০-৩০ বছর পরের বাংলাদেশ যদি কল্পনা করি, তাহলে যে মানুষজন দেখতে পাব, তারা আমাদের চারপাশেই আছে, আমাদের শিশুরা। তাই আমাদের প্রশ্ন করতে হবে– আমাদের শিশুরা কি ভাল আছে? তারা কি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপদ আশ্রয়ের অধিকার লাভ করেছে? তারা চারপাশের বয়স্কদের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ? এর উত্তর হ্যাঁ হলে আমাদের ২০-৩০ বছর পরের ভবিষ্যৎ ভাল থাকবে এবং তা হবে শিক্ষিত, সুস্থ ও নিরাপদ। তবে এ উত্তরের জন্য যার যার নিজের শিশুর দিকে তাকালে চলবে না, কহলিল জিবরানের চোখ থেকে যতটা সম্ভব ধার নিয়ে তাকাতে হবে শিশুর প্রতি, যে আমার-তোমার-তার নয়, যে সমাজের ও সবার। প্রতিজ্ঞা হোক যাকে গড়ে তুলতে কেবল একটি গ্রাম নয় আমাদের এই পুরো রাষ্ট্র নিবেদিত হবে, আগামীকাল থেকেই।