Published : 10 Jan 2021, 06:11 PM
পারষ্পারিক ভালোলাগা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরতা, থেকেই মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে যদি কেউ কাউকে লাঞ্ছিত বা হয়রানি করে, যদি ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হয়, সেটা আর সম্পর্ক থাকে না। সেটা হয় জবরদস্তি বা ধর্ষণ। আর ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা কিংবা কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের যৌন সংসর্গ মাত্রই দণ্ডনীয় অপরাধ। আমাদের দেশে এখন এ ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতা সীমাহীন বাড়ছে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় একটি নামজাদা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের এক কিশোরীর বন্ধুর বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনা তারই সর্বশেষ উদাহরণ।
নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে একটা নান্দনিকতা আছে, যা দিয়ে অনেক অমর কাহিনি লেখা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের যে মচ্ছব চলছে, তাতে তাতে আমরা শিউরে উঠছি। আত্মীয়তা কিংবা বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে নারীকে ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির ঘটনা নারী-পুরুষ সম্পর্ককেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
মনে পড়ে ২০১৭ সালের ৪ জুলাই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ডেকে নিয়ে বনানীতে ন্যাম ভিলেজের ফ্ল্যাটে এক তরুণীকে ধর্ষণের কথা। তার আগে ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ধর্ষণের শিকার হন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ছাত্রী। বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের এ ঘটনা ঘটে। এই দুটি ঘটনা নিয়ে অনেক তোলপাড় হলেও এখনও বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তির মুখ দেখেনি।
ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো আমাদের কেমন গা-সওয়া হয়ে গেছে। শহরে, মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধিদের ওপর জুলুম-নির্যাতন হলে কিছুটা হা-হুতাশ করি। ফেসবুকে পোস্ট দিই। কয়েকদিন তপ্ত আলোচনা হয়। মিডিয়া-কাভারেজ দেখা যায়। থানা-পুলিশও কিছুটা তৎপরতা দেখায়। তারপর সব থিতিয়ে আসে। মামলা কোথায়, কী অবস্থায় আছে, এসব নিয়ে আমরা আর মাথা ঘামাই না। আর আমাদের মাথাও তো একটা! এক মাথা আর কত, কতবার ঘামানো যায়?
ওদিকে সেই আক্রান্ত মেয়েটি কী কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেল, আদৌ মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে পারল কিনা সে সব জানার প্রয়োজন আছে বলেও কেউ মনে করি না৷ এই ফাঁকে দুর্বল তদন্ত, তথ্য-প্রমাণ-সাক্ষীর অভাবে অনেক ক্ষেত্রে সবার অলক্ষে অপরাধী জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। সে আবারও হয়তো আর একটি ধর্ষণের জন্য প্রস্তুতি নেয়, এই বাস্তবতা আমরা মেনে নিয়েছি৷
এ ভাবেই হয়তো চলবে৷ মাঝে মাঝে মিটিং, মিছিল, স্মারকলিপি দেওয়া হবে৷ আবার ধর্ষণও হবে৷ সমাজকে ঘাড় ধরে পিতৃতন্ত্র এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য করেছে৷ এই সহাবস্থানকে আমরা নিয়তিবাদী বাংলাদেশের মানুষ ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মেনেও নিয়েছি৷
তবে বন্ধুত্ব বা সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে তরুণী ধর্ষণের ঘটনা অনুভূতিকে ভয়ানক নাড়া দিয়েছে। শিহরিত হয়ে উঠছি এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত বন্ধুরাও? বড় হয়ে উঠতে উঠতে নানা ভাবে নানা সম্পর্কের মোড়ক ভেদ করে পরিবারের মধ্যে মেয়েদের যৌন হয়রানির ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। তা হলে বন্ধুজনরাই বা কী দোষ করল? পরমুহূর্তে এ প্রশ্নও মনে এসেছে।
মানুষের সঙ্গে মানুষের (বায়োলোজিক্যালি ছেলে ও মেয়ে হতে পারে, আদতে তো উভয়ই মানুষ) সম্পর্ক কী কেবল কামের, ভোগের, লালসা নিবৃত্তির? নির্ভরতার, বিশ্বাসের, একে-অপরের সহমর্মী-সমব্যথী সম্পর্ক কী হারিয়ে যাবে? ছেলেরা কেবল সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে, একটি মেয়েকে সম্ভোগের জন্য নানা রকম ছলের আশ্রয় নেবে, মাছ-শিকারের মতো 'টোপ' ফেলবে, 'ফাঁদ' পাতবে? তাহলে সমাজে মেয়েরা নিজের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে বাঁচবে কীভাবে?
ধর্ষণের অভিযোগে যে ছেলেগুলো ধরা পড়ছে, গণমাধ্যমে তাদের মুখগুলো দেখে নিজের কৈশোর-যৌবনের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়! এক সময় এমন মুখ তো আমারও ছিল, ছিল আমার বন্ধুদের। হালকা-দাড়ি-গোঁফ, পৃথিবীকে জিতে নেওয়ার একটা সতেজ সপ্রতিভ আদল! কালের নিয়মে সেই সব মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে, কিন্তু মনে হয়, বয়স আর বাড়েনি৷ সেই কলেজের প্রথম বর্ষের অবয়বটাই স্থির চিত্র হয়ে আছে৷
সেই সব মুখের সঙ্গে 'ধর্ষণ', 'যৌন-হয়রানি' এই সব কুৎসিত শব্দাবলি এতটাই বেমানান যে, সুদূর কল্পনাতেও আসে না যে, ওই বয়সের একটি ছেলে তারই পরিচিত জানাশোনা একটি মেয়েকে ফাঁদে ফেলে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ করতে পারে! যাকে চিনি-জানি, যার সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, ফেসবুকে নিয়মিত ভাববিনিময় হয়, তার প্রেমে পড়তে পারি, হিংসে করতে পারি, প্রতিযোগী মনে করতে পারি৷ কিন্তু 'ধর্ষণ'?
নারীপুরুষ অবাধ মেলামেশার এ যুগে ঘনিষ্ঠতা বন্ধুত্বের জায়গা পরিবর্তিত হয়ে 'খাদ্য-খাদকে' পরিণত হবে, এ কেমন সমাজ আমরা নির্মাণ করলাম? আমাদের সময়েও মেয়েদের উত্যক্ত করার লোকের অভাব ছিল না৷ রাস্তায়, বাসে, সিনেমা হলে, এমনকি পাড়াতেও শুধু মেয়েরা থাকলে, বহু ছেলেই আকস্মিক 'পুরুষ' হয়ে উঠতে চাইত৷
কিন্তু সঙ্গে কোনো পরিচিতজন থাকলে সব অস্বস্তিকর দৃষ্টি সরে যেত। তখন বন্ধু হয়ে, ঘনিষ্ঠ হয়ে মেয়েদের প্রতি অসভ্যতা খুব একটা দেখা যেত না। এখন যদি পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব (যার মূল কথা আস্থা ও বিশ্বাস) একটি মেয়েকে ধর্ষণ করার উপায় হয়, তাহলে মেয়েরা বাঁচবে কী করে? আর যারা আদতেই মানুষ (শুধু 'পুরুষ' নয়), তারাই বা এ কলঙ্কের দায় নিয়ে কীভাবে বাঁচবে?
অনেকেই মনে করেন কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি হলেই বুঝি এই মানসিকতার অবসান ঘটবে৷ এটা সত্যি নয়। আমাদের দেশে লম্পট-ধর্ষকের যে একেবারে সাজা হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। অনেকের কারাদণ্ড হচ্ছে, যাবজ্জীবনও হচ্ছে। কিন্তু এই শাস্তি অপরাধীদের সংখ্যা কমাতে পারছে না।
এক জন শাস্তি পেলে, দশ জন রক্তবীজের মতো তৈরি হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে শাস্তির দরকার নেই। শাস্তি হতে হবে, একের পর এক শাস্তির দৃষ্টান্ত অবশ্যই ধর্ষকদের বেপরোয়া হতে নিরুৎসাহিত করবে। কিন্তু সেটাই শেষ নয়৷
মেয়েরা ঘরের মধ্যে বসে থাকবে, বাইরে বেরোবে না, পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে না, এটা অসম্ভব, অসঙ্গতও। এই পৃথিবীর আলো বাতাসের মতো, রাস্তা-ঘাট স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত থেকে বাসগৃহ সবখানেই নারীপুরুষ পাশাপাশি থাকবে৷ সেটাই স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিকতার মধ্যেই রয়েছে মঙ্গল৷ প্রগতি। তাই পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক যদি 'শিকার আর শিকারী'র হয়ে ওঠে, 'খাদ্য ও খাদকের' হয়, তা হলে আর যাই হোক, সহাবস্থান সম্ভব নয়৷ সভ্য সমাজ বিনির্মাণও অসম্ভব।
প্রতিবাদ মিছিল বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যাই হোক না কেন, মূল সমস্যার কাছাকাছিও যে আমরা যেতে পারিনি, এটা কবুল করার সময় এসে গেছে৷ এ বার প্রতিরোধ ভেতর থেকে তৈরি হওয়াটা জরুরি হয়ে উঠছে৷ কেবল মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, ভেবে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে যে, কেন আমাদের কিশোর-যুবকদের 'বড়' হয়ে ওঠার 'ক্ষমতাশালী' হয়ে ওঠার সমার্থক হয়ে দাঁড়াচ্ছে সম্পর্ক গড়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সেই বন্ধু তরুণীকে ধর্ষণ করা?
মেয়েরা কেন কিছু কিছু ছেলেদের কাছে শুধু 'শরীর' হয়ে উঠছে? সেকি নারীর পণ্যায়নের সংস্কৃতির কারণে, না, সুশিক্ষা আর মূল্যবোধের অভাব? ইন্টারনেটে সুলভ পর্নগ্রাফি? নাকি আরও কিছু? এসব বিষয়ে বিশদ গবেষণা ও বিস্তৃত আলোচনা হওয়া দরকার।
শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় তার চিড়িয়াখানা উপন্যাসে লিখেছিলেন, যে জাতি নিজেদের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছে তারা আর কাকে শ্রদ্ধা করবে? কথাটি ভাবার মত। নিজের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে আসে নিজের মেরুদণ্ডের জোর, প্রশ্ন করার ক্ষমতা, প্রতিবাদ করার সাহস। কিন্তু এই দেশের নাগরিক হিসেবে অনুভব করি যে, আমাদের নিজেদের প্রতিই আর কোনও শ্রদ্ধা নেই। থাকলে এত বেশি সহিষ্ণু হয়ে থাকতে পারতাম না আমরা। এত এত অমানবিকতা, পৈশাচিকতা এবং নৈরাজ্যে আমাদের সকলেরই পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু আমরা নির্বিকার। আমরা অনুভবই করতে পারছি না, শুধু নারীই নয়, আমাদের অনুভব-অনুভূতি, মানবিকতাও ঠিক কীভাবে, কীভাবে যেন প্রতি মুহূর্তে ধর্ষণের শিকার হয়ে চলেছে!