Published : 07 Jan 2021, 03:32 PM
সাম্প্রতিক সময়ে চীনকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে একটি খবর বেরিয়েছে। সেটি হল- পূর্ব এশিয়ার দেশটির নেতৃত্বে ১৫টি দেশকে নিয়ে গঠিত হয়েছে একটি বড় অর্থনৈতিক জোট। 'রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি)' নামের নতুন এই জোটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোট আসিয়ানের ১০ দেশের সঙ্গে চীন ছাড়াও থাকছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ড। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই মুক্ত বাণিজ্য জোট আগামী দিনের বিশ্ব বাণিজ্যে বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের অর্থনৈতিক জোট গঠন অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় না থাকলেও দেশটি নেই এই জোটে। যদিও ভারতের এই চুক্তিতে আসার কথা ছিল। কিন্তু সস্তা চীনা পণ্যে বাজার ভরে যাওয়ার শঙ্কায় দেশটি গতবছর এ আলোচনা থেকে বেরিয়ে যায়। এরপরও নয়া দিল্লির জন্য দরজা খোলা রাখা হয়েছে, বলছেন আসিয়ান নেতারা। (https://bangla.bdnews24.com/business/article1826902.bdnews)
'আগ্রাসী' চীনের নেতৃত্বে এ ধরনের জোট গঠনের অনেক উদ্দেশ্যের অন্যতম অবশ্যই অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার, তা বলাই বাহুল্য। এখানে বরং চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলবে, এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
আপাতদৃষ্টিতে চীনের 'মহৎ, জনহিতকারী' হওয়ার চেষ্টা, সেটা বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন দূরে। কারণ অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি- তা কৌশলগতভাবে হোক আর গোপনেই হোক, যেখানে যেমনটা দরকার, তা দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সার্বভৌমত্বে নাক গলাতে চীনের প্রচেষ্টা নতুন কিছু নয়। কারণ চীনা নেতৃত্ব ভালো করেই জানে, বৈশ্বিক নিরাপত্তার রূপ বদলে দিতে হলে অঞ্চল হিসেবে কৌশলগত দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
এ অঞ্চলে চীনের 'প্রতিপক্ষ' কিংবা 'ভীতি' যাই বলা হোক না কেন, তা হচ্ছে ভারতের 'সুপারপাওয়ার' হয়ে ওঠা। আর এজন্য চীনের দরকার পাকিস্তানের ঘাড়ে চেপে বসা। উদ্দেশ্য হল, ভারতের রাশ টানতে পাকিস্তানকে ব্যবহারের সুযোগ খোঁজা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাও চীনকে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়তে রসদ হিসেবে কাজ করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সব সময় ভারতের পাশেই থেকেছে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগের প্রভাব হিসেবে বিশাল ঋণের ভারে ডুবতে শুরু করেছে পাকিস্তান। ধীরে ধীরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) 'হাতের পুতুলে' পরিণত হচ্ছে দেশটি। বিশেষ করে, চীন গতবছর থেকে কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তানের 'দাবির' প্রতি সমর্থন দেওয়া শুরু করেছে। দুইটি ফ্রন্টে লড়াইয়ের হুমকি জিইয়ে রেখে ভারতকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে দেশটি। ভারতীয় ভূখণ্ডের কিছু অংশ নিজেদের বলে ভিত্তিহীন দাবির পক্ষে একে অপরকে সমর্থনও দিচ্ছে দেশ দুটি (চীন ও পাকিস্তান)।
অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, গালওয়ান উপত্যকায় ভারতকে সংঘর্ষে জড়াতে চীনই উসকানি দিয়েছে। এর কারণও রয়েছে। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে ধীর ধীরে বিশ্বের মনোযোগ হারায় চীন। অনেক প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে পাততাড়ি গোটাতে শুরু করে, যার কয়েকটি ভারতেও চলে যায়। চীনের পক্ষে বিষয়টি হজম করা কঠিনই হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভারতের শক্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক অবস্থানের ফলে এই অঞ্চলে ব্যবসার সুযোগ হারাতে থাকে চীন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে চীন যে শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে, সেখানেও তাদের উদ্দেশ্যটা অন্যরকম বলে মনে করনে বিশ্লেকরা। তাদের মতে, সত্যিকার অর্থেই চীন সেখানে শান্তি চায়, তা কিন্তু নয়। বরং আফগানিস্তান যাতে আর ইসলামি জঙ্গিদের স্বর্গভূমি হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্যই এই প্রক্রিয়ায় এসেছে তারা।
বর্তমানে চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এটি বাস্তবায়নে নিজের স্বার্থেই অন্য দেশগুলোকে দলে টানার চেষ্টা করছে তারা।
চীনা বিনিয়োগের একটি কৌশল হচ্ছে মূলত বিভিন্ন দেশে তাদের অর্থায়নে অবকাঠামো নির্মাণ হয়, সেসব জায়গায় তাদের নির্ধারিত মান অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয়। এই সুযোগে চীনও মোটা অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে এসব দেশকে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলে। জালে আটকে যাওয়া দেশগুলো তখন বিভিন্ন বৈশ্বিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে চীনকে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়।
উদাহরণ হিসেবে নেপাল, মালদ্বীপের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর কথা বলা যায়, যারা নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের সহযোগিতার মুখাপেক্ষি হয়েছে। প্রকারন্তরে যা তাদেরকে চীনা ঋণ এবং দেশটির কর্তৃত্ববাদী একনায়কতন্ত্রের জালে আটকে ফেলছে।
ফলে এটা বলাই যায় যে, উন্নয়নের পথে চীনকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলার যে ভাবনা সেটা এখনও মিথের পর্যায়ে রয়ে গেছে। দেরিতে হলেও, বিষয়টি বুঝতে শুরু করেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। ফলে কিছু দেশ আবারও ভারতের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে, একটি নির্ভরযোগ্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আশায়।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ নিয়ে চীনের ভূমিকার কথা তোলা যেতে পারে। শুরুতে এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে বাংলাদেশের আর্থিক সংশ্লেষ না থাকলেও পরবর্তীতে অর্থায়ন (কো-ফান্ডিং) চাওয়ায় বিষয়টি কেঁচে যায়। কো-ফান্ডিংয়ের জন্য কারণ হিসেবে অর্থের স্বল্পতার যে কারণ দেখানো হয়, চীনের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশের ক্ষেত্রে তা বেশ অস্বাভাবিকই বটে।
বিপরীতে অক্সফোর্ডের টিকার জন্য দ্রুততার সঙ্গেই ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করতে পেরেছে বাংলাদেশ। সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত এ টিকা বাংলাদেশ টাকা দিয়েই কিনে নেবে। তারপরও দ্রুততার সাথে চুক্তি করার ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়টি অবশ্যই অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলা যায়। প্রতিবেশীদের সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে এখানেই চীন ও ভারতের মধ্যে পার্থক্য।
হাতড়ালে এমন আরও অনেক কারণ খুঁজে বের করা যাবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বন্ধু বাড়াতে হলে চীনকে যে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।