Published : 31 Dec 2020, 06:28 PM
২০২০ সাল ছিল আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা মোহাম্মদ নাসিম এর চলে যাওয়ার বছর। বেশ কয়েকদিন থেকে তাগিদ অনুভব করছিলাম, প্রয়াত নাসিম ভাই এর রাজনীতি, উত্থান, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছু না জানা তথ্য দেশবাসীর কাছে তুলে ধরব।
গত ২২ নভেম্বর স্বাধীনতা চত্বরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পাবনা গিয়েছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল স্মরণে পৌর মিলনায়তন অর্থাৎ টাউন হলের পুনঃসংস্কার করে স্বাধীনতা চত্বর হিসেবে নামকরণ করে শুভ উদ্বোধন করেন। বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা, স্বনামধন্য স্কয়ার গ্রুপের অন্যতম পুরোধা বীর মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু এই সংস্কারকাজের পৃষ্টপোষক, অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের অগ্রনায়ক। পাবনা পৌরসভার এই সম্পত্তিটি পুন:সংস্কার ও নামকরণ বিষয়ে সকল সম্মানিত কমিশনার ও মেয়র মিন্টুর সার্বিক সহযোগিতা ও সম্মতি আছে মর্মে জানতে পারলাম।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার উদ্বোধনী ভাষণে বকুলের স্মৃতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে উল্লেখ করছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা বকুল প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কোন প্রেক্ষিতে বা কেনই বা বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন, তা উল্লেখ করে তার দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগের থাকার সময় কীভাবে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের প্রতি তার আন্তরিকতা এবং স্বয়ং জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেছে, তার একটি বিবরণ তুলে ধরেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সবশেষ বিএনপির একজন নেতা হওয়া সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অকপটে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিদানের বিষয়টি পাবনার আপামর জনগণকে মুগ্ধ করেছে।
মোহাম্মদ নাসিমের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বর্ণিত কথাগুলো উল্লেখ করলাম, এই কারণে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার উদ্বোধনী ভাষণে নাসিম ভাইয়ের পাবনার রাজনীতির বিষয়টিও উল্লেখ করেছিলেন। মোহাম্মদ নাসিমের জন্ম সিরাজগঞ্জ শহরে নানার বাড়িতে ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে। নানার কর্মস্থল শহরে হওয়ার সুবাদে বেগম আমেনা মনসুর পিতার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। পিতা দেশবরেণ্য নেতা জনাব এম মনসুর আলীর বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থানার কুড়িপাড়া গ্রামে। জনাব এম মনসুর আলী পেশাগত কারণে ছেলে সেলিম ও নাসিমকে নিয়ে সপরিবারে পাবনা সদরে চলে আসেন এবং মোক্তারপাড়ায় 'বশির কটেজ' নামক এক ভাড়া বাসায় ওঠেন। এর আগেই তিনি পাবনা অ্যাডভোকেট বার সমিতিতে তালিকাভুক্ত হয়ে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস করতেন। জনাব মনসুর আলী ৮-১০ বার পাবনা বারের কখনও সাধারণ সম্পাদক আবার কখনও সভাপতি পদে জয়ী হয়েছিলেন। স্বনামধন্য আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হয়ে তিনি স্নাতকোত্তর ও আইনে ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত এই সাথী পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর ঘাতক মোস্তাকের প্রেরিত খুনিদের হাতে কারাগারের ভেতরে নিহত হন।
নাসিম ভাই পাবনায় তাদের বাড়ির পাশের মহিমচন্দ্র জুবিলী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৬৫ ইংরেজি সালে। আমি একই মহল্লায় বাস করলেও স্কুল ছিল ভিন্ন, এসএসসি পাস করি এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে। ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের উভয়ের মধ্যে পারষ্পারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি ১৯৬৬ সালের শেষভাগে এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হই। মোহাম্মদ নাসিম তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বলাবাহুল্য, আমি কলেজে ভর্তির সাথে সাথে ছাত্রলীগের কর্মী হলেও মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সাথে স্বল্পকালীন সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন পাবনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে 'বশির কটেজ' এর বাসাতেই। ১৯৬৭ ইংরেজি সালে আমি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন মোহাম্মদ নাসিম ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। ওই বছর ছাত্র সংসদের সকল পদে ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) গ্রুপ বিজয়ী হয়। ছাত্রলীগের একমাত্র প্রার্থী মোহাম্মদ নাসিম বিজয়ী হয়ে ছাত্র নেতৃত্বে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
পাকিস্তানি শাসনামলে রেশন ব্যবস্থায় জনগণকে ভুট্টা খাওয়ানো হত। ১৯৬৭ সালে রেশনে প্রাপ্ত ভুট্টার বিষক্রিয়ায় পাবনায় দুইজন ছিন্নমূল পরিবারের সদস্য মারা যান। এ ঘটনার পর মুহূর্তেই সমগ্র পাবনার মানুষ বিক্ষুদ্ধ হয়ে পাবনায় তৎসময়ে বসবাসরত পূর্ব পাকিস্তান পার্লামেন্টারি বোর্ডের খাদ্য বিষয়ক সদস্য ক্যাপ্টেন আজগর হোসেন জায়েদীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এক সময় মিছিলের ওপর গুলি বর্ষণ করলে একজন ভিক্ষুকের ছেলে ঘটনাস্থলে মারা যায়।
আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা আজগর হোসেন জায়েদীর বাড়ি ঘেরাও করলে মিছিলের একাংশে কতিপয় ব্যক্তি আগুন ধরিয়ে দেয়। সমগ্র পাবনা জেলা পুলিশ ও বিক্ষুদ্ধ জনতার সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, তখন অস্ত্রের দোকান পর্যন্ত লুট করে অস্ত্র দ্বারা আত্মরক্ষা করা হয়েছিল। এ আন্দোলন 'ভুট্টা আন্দোলন' হিসেবে পরিচিত। সেই রাতেই পাবনার নেতাদের ওপর গ্রেপ্তারি হুলিয়া জারি করা হলে আমরা কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যাই। তবে মোহাম্মদ নাসিমসহ ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা এবং আওয়ামী লাগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির সকল নেতাই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হন। এম মনসুর আলী ও পুত্র মোহাম্মদ নাসিম পাবনা কারাগারে বন্দি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে জেলা জজ কোর্টে মামলার শুনানি হলে সাক্ষ্যের অভাবে সকলেই খালাস পান। উল্লেখ্য যে, পাবনায় ছাত্রলীগের সঙ্গে সব সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সংঘর্ষ লেগে থাকত।
পাবনা আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা আহমেদ রফিক ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে খুবই প্রিয় মানুষ ছিলেন। আহমেদ রফিকসহ অন্যান্য নেতাদেরকে হত্যা করার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের (পরর্বতীতে নকশালবাড়ী সর্মথক) নেতৃত্বে একটি টিম সবসময় সক্রিয় ছিল। আহমেদ রফিক বারবার তাদের হামলার শিকার হন। এরূপ অবস্থা চলাকালীন পাবনার তৎকালীন টাউন হল ময়দানে ছাত্রলীগের এক জনসভায় ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সদস্যরা হামলা চালালে আহমেদ রফিকসহ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা ছুরিকাঘাতে আহত হন। এই সংঘর্ষের ব্যাপকতা প্রচণ্ড আকার ধারণ করলে ছাত্রলীগের সহযোগী শ্রমিক লীগের লুরে নামক একজন কর্মী ছুরিকাঘাত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সংঘর্ষের মধ্যে মোহাম্মদ নাসিম আমার ছোট ভাই ছাত্রলীগ কর্মী টুন্নুকে সাথে রিকশাযোগে হাসপাতালে দেখতে গেলে ছাত্র ইউনিয়নের (নকশাল পার্টির অনুসারী) সন্ত্রাসীরা মোহাম্মদ নাসিমকে ধাওয়া করে হাসপাতালের বারান্দায় জাপটে ধরে। পরে তাকে মাটিতে ফেলে পিঠে ধারালো ছড়ার ৬-৭টি কোপ দিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। মুমূর্ষু মোহাম্মদ নাসিমকে প্রথমে রাজশাহী ও পরে ঢাকা চিকিৎসা করালে তিনি সুস্থ হন। মোহাম্মদ নাসিম পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক পাস করেন।
আমি সহ মোহাম্মদ নাসিম, রফিকুল ইসলাম বকুল, বেবি ইসলাম, ফজলুল হক মন্টু, পাকন, লাল ও বিজয় আহমেদ রফিকের প্রিয়ভাজন ছিলাম। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আহমেদ রফিকের কিছুটা স্নায়ুযুদ্ধ থাকলেও তিনি এম মনসুর আলীর সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। আহমেদ রফিকের জনপ্রিয়তাও ছিল তুঙ্গে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আহমেদ রফিক প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে তরুণ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কিছুদিন পরেই সেই নকশালপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সন্ত্রাসীরা তাকে বাসার সামনে ছুরিকাঘাত করলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা হারিয়েছিলাম একজন দেশপ্রেমিককে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম পাবনা জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমরা পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাবনাকে হানাদারমুক্ত রাখতে পেরেছিলাম ৯ এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত। পরবর্তীতে প্রতিরোধ যুদ্ধে সামলাতে না পারলে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যাই। মোহাম্মদ নাসিমও ঢাকা থেকে তার পিতা ও পরিবারের সদস্যসহ ভারতে গিয়ে কলকাতায় অবস্থান নেন। কলকাতার এন্টালি এলাকার সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউয়ের আশুতোষ ঘোষের বাড়িতে মোহাম্মদ নাসিম তার মা-বাবা-ভাই-বোনের সঙ্গে আশ্রয় নেন।
উল্লেখ করা যেতে পারে, আশুতোষ ঘোষের এ বাড়িতেই মুজিবনগর সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীরাও থাকতেন। মোহাম্মদ নাসিমকে সীমান্তবর্তী কতিপয় যুব ক্যাম্প ও শরনার্থী শিবির পরিচালানার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমি সেখানেও তার সর্বকালীন সাথী ছিলাম। তবে মাঝে আমি প্রশিক্ষণ নিয়ে সাথী বীরমুক্তিযোদ্ধা ইকবাল ও বকুলদরে সাথে পাবনার আশেপাশে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেই।
কলকতার পার্ক সার্কাস এলাকায় তৎকালীন পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস ছিল। ওই হাইকমিশনে পাবনার কৃতি সন্তান হোসেন আলী কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছিলেন। তার সঙ্গে বাঙালি কর্মককর্তারাও ছিলেন। অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তখন হাইকিমশন অফিস ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। পুরো হাইকমিশনটি তখন মুজিবনগর সরকারের অধীনে ছিল এবং ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে অবস্থিত মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করত। এ অফিস থেকে পাবনা-কুষ্টিয়া-রাজশাহী অংশের শরণার্থী ক্যাম্পসমূহ এবং কেচোয়াডাঙ্গা ও জলঙ্গী যুব ক্যাম্পগুলো পরিচালিত হত। নাসিম ভাইয়ের দেশপ্রেম এত বেশি প্রখর ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠনে ও দায়িত্ব পালনে তিনি কখনও ক্লান্তিবোধ করতেন না। দেশ স্বাধীন হলে পুনরায় আমরা নিজ অবস্থানে ফিরে আসলে মোহাম্মদ নাসিমও পাবনায় চলে আসেন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন। পাবনায় মোহাম্মদ নাসিম কালক্রমে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে কৃত্রিম খাদ্য সংকটকালে পাবনায় পর্যাপ্ত খাদ্য শস্য নির্বিঘ্নে খাদ্য সরবরাহ করার ক্ষেত্রে তিনি তার পিতা এম মনসুর আলী সাহেবের সহযোগিতায় অনন্য ভূমিকা পালন করেন।
তিনি যে কতটা কর্মীবান্ধব এবং কর্মীদরদী নেতা ছিলেন তার একটি উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে আমি পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতি এবং মোহাম্মদ নাসিম বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রিয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। তখন জাসদ গণবাহিনী ও মুজিববাদী ছাত্রলীগের সাথে মাঝেমধ্যেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হত। সেই সময়ে আমি এবং মোহাম্মদ নাসিম উভয়েই এলএলবি ফাইনাল পরীক্ষার্থী ছিলাম।
ফাইনাল পরীক্ষার প্রথম দিন পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার আগে নাসিম ভাই আমাকে একসঙ্গে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন। আমি যথারীতি সকাল ৯টায় নাসিম ভাইয়ের রাঘবপুরস্থ বাসায় হাজির হই। এ সময় তাকে গোসলরত অবস্থায় দেখি। আমি ডাকাডাকি করলে তিনি দরজা খুলে আমাকে পরীক্ষা না দিয়ে ঈশ্বরদী যাওয়ার প্রস্তাব করেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম- কেন? তিনি বলেন, "আজ সকালে খবর পেলাম ইশ্বরদীতে আমাদের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে গণবাহিনীর সদস্যরা গুলি করে হত্যা করেছে। আমাকে সেখানে যেতে হবে।"
আমি দুপুর ১টায় পরীক্ষার পর যাওয়ার প্রস্তাব করলে তিনি অখুশি হন এবং বলতে গেলে আমাকে কিছুটা তিরস্কারও করেন। আমি তার কথা না শুনে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হই। পরীক্ষা শেষে হোন্ডা-মটরসাইকেলে ঈশ্বরদী গিয়ে দেখতে পাই, মোহাম্মদ নাসিম কর্মীসহ নিহত ছাত্রলীগ কর্মীর বাসায় আছেন এবং জানাজার দেখভাল করছেন। আমি নিজেও জানাজাও অংশ নেই এবং এক সাথে পাবনায় চলে আসি। পরবর্তী আমি সব পরীক্ষায় অংশ নেই এবং কৃতিত্বের সাথে পাস করি। পক্ষান্তরে মোহাম্মদ নাসিম শুধু কর্মীদের প্রতি তার দরদের কারণে আর পরীক্ষায় অংশ নেননি। ১৯৭৫ সনের জানুয়ারিতে জাতির বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু পাবনায় মো. নাসিমকে জেলা কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল ও আমাকে যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে মনোনীত করেছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ঘাতকরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারের হত্যার ঘটনার সময় মোহাম্মদ নাসিম ঢাকায় তার পিতা অর্থাৎ সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীর ৩০ নম্বর হেয়ার রোডের বাসায় অবস্থান করছিলেন। ভোরে তার ফোনেই আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতে পারি। তিনিই আমাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে সময়ে আমি বারান্দায় গর্জনরত জনাব এম মনসুর আলীর কণ্ঠ শুনেছি। তিনি খুনি মোস্তাককে উদ্দেশ্য করে ইংরেজি ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। তার কন্ঠে সর্বশেষ যা শুনলাম তা হলো- 'দিস উইল নট গো আনপানিসড'। যা হোক, পরবর্তীতে যা না হওয়ার, তাই হয়েছে। সকলেই তা প্রত্যক্ষ করেছে। মোহাম্মদ নাসিম সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে গেলেন। প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠনের আশায় সেখান থেকে একটি চিরকূট পাঠিয়ে বুলগানী নামীয় এক ছাত্রলীগ কর্মীর হাতে দিয়ে কলকাতায় তার কাছে সাথীদের নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। আমি একেবারেই কপর্দকহীন হওয়ায় আশু সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তবে কিছু টাকা জোগাড়ের পরপরই ভারতে যেতে উদ্যত হলে ২৫ অগাস্ট পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে আটক হই। জেলখানায় আটকরত অবস্থায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শারিরীকভাবে চরম নির্যাতনের শিকার হই। এ অবস্থাতেই জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। আমি তিন বছর কারারুদ্ধ থাকার পর ১৯৭৮ সালে একটি 'হেভিয়াস কর্পাস রিটে'র প্রেক্ষিতে মুক্তি পাই। মুক্তি পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই ভিসা সংগ্রহ করে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট যোগে কলকাতায় চলে যাই। সেখানেই নাসিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি এবং একসঙ্গে কয়েকদিন অবস্থান করি। নাসিম ভাই সপরিবারে সেখানে অবস্থান করছিলেন। ভারতে কংগ্রেস সরকারের পরিবর্তন হওয়ার পরবর্তী ভারতীয় সরকার সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করে যারা ভারতে গিয়েছিলেন, তাদেরকে আর রাখতে চাচ্ছিল না। আমি দেশে চলতে আসতে উদ্যত হলে নাসিম ভাই তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের আমার সঙ্গে দেশে পাঠাতে চান।
ওই সময় নাসিম ভাইয়ের দ্বিতীয় সন্তান কলকাতায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। ওই কোলের সন্তানকে সাথে নিয়ে আমি, জ্যেষ্ঠ পুত্র জয় ( র্বতমান সাংসদ), বিথী ভাবি এবং আমার স্ত্রী সীমান্ত পার হয়ে যশোর হয়ে ঢাকায় আসি। নাসিম ভাই কলকাতায় থেকে যান এ কারণে যে, তার অবর্তমানে পাবনায় সামরিক আদালত তাকে একটি মিথ্যা মামলায় ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। কাজেই সে সময় তার আসা হয়নি। ছয় মাস পর তিনি দেশে আসেন এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে আত্মসমর্পন করে কারারুদ্ধ হন। পরবর্তীতে তিনি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কারামুক্তি লাভ করেন। পরে তিনি কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন। কালক্রমে তিনি কার্যকরী পরিষদের সদস্য, প্রচার সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রেসিডিয়াম কমিটির সদস্যপদ লাভ করেছিলেন। তিনি যুব জননেতা যথাক্রমে শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ এবং আমির হোসেন আমুর আস্থাভাজন ছিলেন। পাবনা জেলার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তরের প্রতিযোগিতায় একই দলের দুই ধারা সৃষ্টি হয়। নাসিম-বকুল এ দুই ধারায় সংঘাতের কারণে অনেক নেতা-কর্মীকে অত্যাচার, জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি আস্থাশীল বকুল পাবনার রাজনীতিতে দলীয় কোন্দলের কারণে হতাশ হয়ে অন্য দলে যোগ দিলেও, তিনি র্সবদা স্বাধীনতার চেতনাকে অন্তরে লালন করতেন ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন বলেই আমি জানি। নাসিম ও বকুল- দুইজনেই সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন।
নাসিমের অকাল মৃত্যুতে আওয়ামী লীগ এমন এক দক্ষ নেতাকে হারিয়েছে যার ভার নেতাকর্মীদের সহনীয় নয়।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি তার ছিল গভীর আন্তরিকতা, বিশ্বাস ও মমত্ববোধ। তিনি কখনও হতাশাগ্রস্ত হননি। তিনি ছিলেন অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী। এরশাদ ও খালেদা জিয়া বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। চরম নির্যাতনে পুলিশি বর্বরতার শিকারও হয়েছিলেন তিনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালীন খুলনার সন্ত্রাসী এরশাদ সিকদার ও যশোর-খুলনা অঞ্চলে কথিত সর্বহারা দুর্বৃত্তদের দমনে তিনি সফল হয়েছিলেন। জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মূল্যায়ন করতে একটুও পিছপা হননি। তিনি নেত্রীর কাছে যথাযথ মর্যাদা পেয়েছেন।