Published : 27 Dec 2020, 03:20 AM
ঢাকার স্ট্রাকচার প্ল্যান (২০১৬-৩৫) এর আওতায় প্রস্তুত ঢাকা মহানগর বিশদ পরিকল্পনা (ড্যাপ) এখন গণশুনানিতে আছে। অনুমোদনের পর এই ড্যাপই নির্ধারণ করবে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার নগর উন্নয়ন কিভাবে হবে। প্রস্তাবিত ড্যাপ শহরকে মানুষের বসতি আর আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ ড্যাপের মতে শহরের প্রধান কাজ নাগরিকের কল্যাণ নিশ্চিত করা, আর বাকি সবকিছু, যেমন অর্থনীতি, প্রশাসন, অবকাঠামো, মূল কাজের সর্বোচ্চ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিকল্পনার মূলনীতি ধরে মানুষের জীবন ও জীবনমানের উন্নতি ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন ড্যাপে পরিকল্পনার লক্ষ্যে পরিণত হয়। একটি মানবিক শহর গড়ার চিন্তায় ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তি পরিকল্পনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। চারটি লক্ষ্য হয়ে ওঠে ড্যাপে পরিকল্পনার মূল নির্দেশনা: (১) বিনিয়োগের সার্বজনীন স্বাধীনতা, (২) উন্নত জীবনমান, (৩) সহনশীল শহর, (৪) বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবন।
লক্ষ্যগুলো অতি বিস্তৃত। খুব বেশি বিস্তৃত লক্ষ্যের একটা বড় ধরনের সংজ্ঞা সম্পর্কিত সমস্যা আছে। এ ধরনের লক্ষ্যগুলো যেকোনো কিছুর মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব। যখন সব কিছুই সাধারণ লক্ষ্যের উপাদান হয়ে যায়, লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমগুলো হয়ে যায় সীমাহীনভাবে প্রশস্ত, অনির্দিষ্ট এবং যার ফলে অকেজো। আমরা দিক হারিয়ে ফেলি, হয়ে যাই বিভ্রান্ত।
যে সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সুস্থ রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে থেকে আমলাদের মাধমে সম্পন্ন হয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কোনো স্থান নেই, গণতন্ত্রে কোনো গণতান্ত্রিক অনুশীলন নেই, বেশিরভাগ পেশাজীবী ও সুশীলসমাজ ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক, নৈতিকতাহীন লেনদেনের মাধ্যমে ঠিক হয়, মতাদর্শন সমাজবিরোধী, হুমকি এবং ভয়- বাকস্বাধীনতার সীমা, সেখানে সীমাহীনভাবে বিস্তৃত লক্ষ্য সমাজের কাজে আসতে পারে না।
যুক্তির খাতিরে বলা যেতে পারে, এসব লক্ষ্যে সমস্যা নয়, বরং লক্ষ্যার্জনে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমস্যা। আসলে দুইটাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই- যে লক্ষ্য বাস্তবতাকে এড়িয়ে চলে সেটা গ্রহণযোগ্য লক্ষ্য হতে পারে না। অর্থাৎ পরিকল্পনার লক্ষ্য এবং লক্ষ্যার্জনের মাধ্যমগুলো কতটা বাস্তবতার বিশ্লেষণে তৈরি, তার উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনাটা কতটা বাস্তব ও গ্রহণযোগ্য।
লক্ষ্য বাস্তবতার বাইরে হলে, সেটার বাস্তবায়ন স্বপ্নই থেকে যাবে। এ ধরনের লক্ষ্যকে বলা যেতে পারে বাগাড়ম্বর বা অলঙ্করণ (rhetoric)। আর বাগাড়ম্বর নির্ভর আখ্যান বা বর্ণনা (narrative) যখন পরিকল্পনার অংশ হয়, তখন সে পরিকল্পনা অবর্ণিত স্বার্থের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বেশি সম্ভাবনা থাকে। একারণে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত ড্যাপের লক্ষ্যগুলো আর লক্ষ্য অর্জনে প্রস্তাবগুলো মূল্যায়ন করা দরকার। আসুন দু-একটা লক্ষ্য আর লক্ষ্যার্জনের প্রস্তাবনা বিশ্লেষণ করা যাক।
আশা করি লেখাটি ড্যাপের সংশোধন, পরিবর্তন বা পরিমার্জনের কাজে লাগবে। ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন মহলের সাথে আলোচনা করে যাচ্ছেন, শুনে যাচ্ছেন তাদের উদ্বেগ আর পরামর্শ। শুরুতেই বলা দরকার যে, তার অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাব, অক্লান্ত পরিশ্রম আর আন্তরিকতা প্রশংসার দাবিদার।
আবাসন, ইমারত বিধিমালা ও উন্নত জীবনমান
ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা ২০০৮ অনুসারে ইমারত নির্মাণের অনুমতির জন্য রাস্তার প্রস্থ ন্যূনতম ৬ মিটার (প্রায় ২০ ফুট) হওয়া প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য, নাগরিক অবকাঠামো সুবিধা আর দুর্যোগব্যবস্থাপনা এ ন্যূনতম ৬ মিটার প্রস্থের বিধানের পেছনের কথা। নগরীতে বিদ্যমান এ ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা আবাসন সংকটের কারণ হিসেবে এই খসড়া ড্যাপে দেখানো হয়েছে। আর এই ধারণার ভিত্তিতেই ন্যূনতম রাস্তার প্রশস্ততা, ইমারতের উচ্চতা এবং ভবনে পার্কিং সম্পর্কিত আইনগুলি সহজ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো মেনে নিলে ২০ ফুটের কম প্রশস্ত রাস্তার পাশেও গড়ে উঠবে পার্কিং বিহীন বহুতল ইমারত, বেড়ে যাবে সাধারণ রাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের হিড়িক। দশমিক ২২ থেকে ৫ একর জমির মধ্যেই গড়ে উঠবে ১০ থেকে ১৫ তলা ভবন। আর কোনো রকমে কয়েকটা প্লট একত্র করে জমির পরিমাণ পাঁচ একর পার হলেই কম প্রশস্ত রাস্তার পাশেই সম্ভব হবে সীমাহীন উচ্চতায় ইমারত নির্মাণ। যদিও ৬০ শতাংশ জমি ছেড়েই গড়তে হবে এইরকম সীমাহীন উচ্চতার ইমারত, সামাজিক কাজে কী ব্যবহার হবে এই ৬০ শতাংশ জমি? আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও জমির মালিক কী ছাড়বেন এ ৬০ শতাংশের উপর দখল? তবুও যুক্তির খাতিরে ধরেই নিলাম জমির মালিক দখল ছেড়ে দিলেন- এইভাবে এখানে সেখানে ছেড়ে দেওয়া জমি কী রাস্তার সার্বিক উন্নতিতে আসবে? ভূমি পুনর্বিন্যাস করে এ জমি সামাজিক কাজে লাগানো কি সম্ভব হবে? আমাদের কি ভূমি পুনর্বিন্যাস বিষয়ক প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক, সাংগঠনিক শক্তি আর অভিজ্ঞতা আছে? সরু রাস্তায় অবকাঠামো তৈরি করে সম্ভব হবে কি বহুতল ইমারতে পানি, গ্যাস পৌঁছানো? জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো কি থাকবে এসব ইমারতে জীবদ্দশায়? আমরা কি ভুলে গেছি পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ড আর বিল্ডিং ধসের পরের অবস্থা, সেই চিরচেনা শোকের কথা, মুছে গেছে কি চোখের কান্না? স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবান্ধব অবকাঠামোর আশা দিয়ে কি তার উল্টোটাই করা হচ্ছেনা? এটাকে কি বলে জীবন ও জীবনমানের উন্নতি, এরকম কি হয় সহনশীল ও টেকসই শহরের ব্যবস্থা ও অবকাঠামো? একেবারেই না।
ঢাকায় জমির দাম যে আকাশচুম্বী এটা কারো অজানা না। বিদ্যমান আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে সরু রাস্তার পাশের জমিতে অনুমতিসহ ইমারত নির্মাণের সুযোগ না থাকা এ মূল্যবৃদ্ধির একটি কারণ। এই পরিস্থিতিতে, সীমাবদ্ধ আইন অপসারণের ফলে জমির দাম কমার সাথে সাথে অধিক পরিমাণ নতুন জমির উপর (প্রধানত ডেভেলপারদের) বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হবে। এটা সত্য যে, আইনি শিথিলতা হলে বাজারে ভবন নির্মাণের জমির পরিমাণ বাড়বে, কিন্তু তাই বলে তো জনস্বাস্থ্য, অবকাঠামো আর দুর্যোগ ব্যবস্থার কথা ভুলে গেলে চলবে না। এরই মধ্যে ঢাকার অনেক এলাকাতে কমিউনিটি পর্যায়ে রাস্তা প্রশস্ত করার অনেক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। আইনি বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নিলে এইধরণের এলাকাভিত্তিক উদ্যোগকে, যার মাধ্যমে একটা বসবাস যোগ্য পরিবেশের ফিরে আনা যেতে পারে, সেগুলো অনুৎসাহিত হবে ।
ঢাকায় এক টুকরো জমি থাকার অর্থই এই নয় যে জমির মালিক ভবন বানাতে পারবেন। জমি ছাড়াও লাগে অর্থায়ন, পরিকল্পনা, আইনি অনুমতি, প্রকৌশলী, মিস্ত্রি, নির্মাণ কাজের শ্রমিক, তদারকি, ইত্যাদি। সর্বত্র আলোচনা, লেনদেন আর চাঁদাবাজদের ঝামেলা। স্থানীয় ডেভেলপারদের কাছে ফ্লাট ভাগাভাগিতে বিল্ডিং বানানোর সাবকন্ট্রাক্ট দেওয়াই এখন একটা প্রচলিত সহজ সমাধান। এই পরিস্থিতিতে আইনি বিধানের পরিবর্তন কেবল ভূমির মালিক এবং ডেভেলপারদের উপকারে আসবে। যতক্ষণ না কোন ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর হবে আর সামাজিক বৈষম্যের পরিবর্তন আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই আইনি শিথিলতা ঢাকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠির (ভাড়া বাড়িতে বসবাসকারীদের) কোনো উপকারে আসবে না। অর্থাৎ ড্যাপের সাফল্য নির্ভর করে বিদ্যমান বাস্তবতাকে কিভাবে ড্যাপের পরিকল্পনার আনা হয়েছে তার উপর।
নিম্নবিত্তের আবাসন
ঢাকার এক তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ অমানবিক বস্তি জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। প্রস্তাবিত ড্যাপের মতে নিম্নবিত্তের প্রায় ৮০ শতাংশ আর মধ্যবিত্তের প্রায় ৭০ শতাংশের জন্য আবাসন সামর্থ্যের সীমার বাহিরে। ঢাকায় আবাসনের অবস্থা আর তাতে আনুষ্ঠানিক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার) আর অনানুষ্ঠানিক ব্যক্তি উদ্যেক্তাদের ভূমিকা সঠিকভাবে ড্যাপের এক পাতার বর্ণনাতে ফুটে উঠেছে:
সরকারি সাধারণ আবাসন (ভূমি উন্নয়ন/ Site and Service) প্রকল্পগুলোর খুব নগণ্য অংশই বরাদ্দ থাকে স্বল্প ও নিম্নবিত্তের আবাসনের জন্য কিংবা অনেক ক্ষেত্রে থাকেই না। আবার এই শ্রেণিকে লক্ষ্য করে যেসব প্রকল্প প্রণীত হয়, তাতে তৈরি আবাসন ইউনিটের খুব সামান্য অংশই সত্যিকার অৰ্থে নিম্নবিত্তের নাগালে থাকে। আবার অন্যদিকে মুনাফার সম্ভবনা সামান্য হওয়ায় বেসরকারি আনুষ্ঠানিক খাত যেকোনো প্রণোদনা ছাড়া স্বল্প আয়ের জন্য আবাসন তৈরিতে উংসাহী হবে না, তা বলাই বাহুল্য। তাই সামগ্রিকভাবে এই দুই খাতে নির্মিত আবাসন ইউনিটের সংখ্যা যথেষ্ট বাড়লেও উচ্চমূল্যের কারণে তার বড় অংশই স্বল্প ও নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে থাকবে […] স্বল্প ও নিম্নবিত্তের আবাসন চাহিদার প্রায় পুরোটাই মেটে অনানুষ্ঠানিক ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি আবাসনের মাধ্যমে।" (প্রস্তাবিত ড্যাপ ২০১৬-৩৫, ভলিউম ১, পৃষ্টা ৪-৭)।
আর এই বাস্তবতার ভিত্তিতে অনানুষ্ঠানিক ব্যাক্তি খাতকে সহায়তা ও প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে কার্যকর বিধিমালা, শর্ত ও বাধ্যবাধকতা যেমন FAR ও MGC শর্ত থেকে মুক্তি, কক্ষের সর্বনিম্ন আকারের শর্ত থেকে মুক্তি, প্লটের আকার যাই হোক না কেন সর্বনিম্ন সেটব্যাক প্রয়োগ, অনুমোদন সহজীকরণ, ইত্যাদি থেকে মুক্তিকে সহায়তা ও প্রণোদনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মানুষের জীবন ও জীবনমানের উন্নতি আর সহনশীল শহরের স্বপ্ন দেখিয়ে আমরা আসলে ঢাকাকে আরো বেশি বসবাসের অনুপোযুগী করতে যাচ্ছি। বিধিমালাই কি একমাত্র গলার কাঁটা? কিভাবে ঠেকাবেন এসব শিথিলতার অপপ্রয়োগ? বিধিমালা শিথিল করলেই বা সরিয়ে দিলেই কি আবাসনের অন্য সব উপাদান জোগাড় হয়ে যাবে, আর এইসব আবাসন নিম্নবিত্তের ভাগ্য পরিবর্তন করবে? আমার বিশ্বাস হয় না।
গতানুগতিকভাবে যেটা চলছে সেটা চলতে দেওয়া পরিবর্তনের যুক্তি হতে পারে না। প্রস্তাবিত ড্যাপের রিপোর্ট অনুযায়ী অতীত ও বর্তমানে বাস্তবায়নকৃত কোনো সরকারি বা বেসরকারি আবাসন প্রকল্প শহরের বেশিরভাগ মানুষের (স্বল্প ও নিম্নবিত্তের) উপকারে আসেনি। তাহলে সেসব প্রকল্প চলতে দেওয়ার যুক্তিটা কোথায়? জনগণের টাকায় বা প্রণোদনায় তৈরি প্রকল্প যদি বেশিরভাগ জনগণের উপকারে না আসে, তাহলে কেন এসব প্রকল্প? আর বেসরকারিভাবে তৈরি প্রকল্পের কোনো সামাজিক দায়িত্ব নেই? ড্যাপের রিপোর্ট নিজেই স্বীকার করেছে যে- স্বল্প ও নিম্নবিত্তের নামে তৈরি আবাসন নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে,তাহলে ড্যাপ এসব প্রকল্পে পরিবর্তন আনার কথা বলছে না কেন? হয় সেসব বন্ধ করতে হবে, অথবা সেগুলো যেভাবে চলছে তাতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রকল্প উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়ন সংস্থাতে বিশাল পরিবর্তনের সাথে থাকতে হবে বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন।
বন্যাপ্রবাহ, জলস্রোত ও কৃষি জমি
২০০০ সালে জলাধার সংরক্ষণ আইন ও ২০১০ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত) পাশ হওয়ার পর ঢাকার সীমান্ত এলাকায় বৈধভাবে উন্নয়ন খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় শ খানেক সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রকল্প অবৈধ চিহ্নিত হয়েছে। রাজউকের কয়টি আবাসন প্রকল্প সহ সরকারী প্রকল্পগুলো 'জনস্বার্থে' পেয়েছে বিশেষ বৈধতা। হাইকোর্টের নির্দশনা সত্ত্বেও সরানো সম্ভব হয়নি জলাশয় ভরাট করে নির্মিত ৭৫ এর উপর অবৈধ বেসরকারি আবাসন প্রকল্প। এরই মধ্যে অনেক কয়টি প্রকল্প কেবিনেট কমিটির সহায়তায় ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন করিয়ে নিয়ে পেয়েছে সরকারি অনুমোদন। ৮ জুন ২০১১ তারিখে বন্যাপ্রবাহ স্বার্থে হাইকোর্ট ৪১৮টি মৌজা রক্ষা করার নির্দেশ দেয়। ঢাকার সীমান্ত এলাকার এই বাস্তবতাটা জানা নতুন ড্যাপের জলাশয় সম্পর্কিত প্রস্তাবনা বুঝতে সহায়ক হবে।
১৯৭৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় জলাধারের পরিমান ২৯ বর্গকিলোমিটার থেকে ১০ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে (প্রস্তাবিত ড্যাপ ২০১৬-৩৫, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ২-২ ও ৪-৭)। মেট্রোপলিটন এলাকায় এ অবশিষ্ট ১০ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটার সহ ড্যাপের বিশাল এলাকায় সর্বমোট ১০১০ বর্গকিলোমিটার জলাধার রয়েছে । গত কয়েক বছরে অবৈধ আবাসিক প্রকল্প বৈধকরণের ফলে জলাধারের সত্যিকার পরিমাণ আরও অনেক কমে গেছে। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতে, এ অবশিষ্ট জলাধার রক্ষা না হলে ঢাকা শিগগিরই খাবার পানি নিয়ে বিশাল সংকটে পড়বে। জলাধারের অভাবে বৃষ্টির পানি বের হতে না পারায় ঢাকার বর্তমান জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগের কথা ঢাকাবাসীর চেয়ে আর কে বেশি জানে? এক কথায় এই অবশিষ্ট জলাধার ছাড়া ঢাকায় বসবাসের চিন্তাই করা যায় না। এই জরুরি অবস্থার কথা চিন্তা করেই 'জলাধার সংরক্ষণ আইন' করা হয়। জলাধার পূরণ করে উন্নয়নের উপর আছে পরিবেশ আইনের নিষেধাজ্ঞা । জলাধার আইনে সবধরনের জলাধারকে একইভাবে দেখা হয়েছে। অর্থাৎ জলাধারকে কোনোভাবে বিভক্ত করা হয়নি এবং সবধরনের জলাধারের জন্য এই একই আইন প্রযোজ্য। গতবারের ড্যাপ সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটিও যেকোনো মূল্যে জলাধারের শ্রেণিকরণ নিষিদ্ধ করার অনুরোধ করে।
বন্যাপ্রবাহ এলাকা ও জল ধারণ এলাকায় মোট স্থাপনার সংখ্যা ৭৫ হাজারের ওপরে, যার প্রায় শতভাগ অনুনোমোদিত (প্রস্তাবিত ড্যাপ ২০১৬-৩৫, ভলিউম ১, পৃষ্টা ৩-২)। এসব অনুনোমোদিত স্থাপনের কথা চিন্তা করে প্রস্তাবিত ড্যাপে সৃষ্টি হবে অনুমোদনের সম্ভাবনা। জলাধার আইন, পরিবেশ আইন ও সচেতন নাগরিকদের অনুরোধ উপেক্ষা করে জলাধারকে তিনটি ভাগে ভাগ করার প্রস্তাবনা করা হয়েছে। খসড়া ড্যাপে ব্যাপক পরিবর্তন না আনলে, চূড়ান্তকরণের পর সাধারণ প্লাবনভূমি ও সাধারণ জলস্রোত এলাকায় দেওয়া যাবে প্রকল্পের অনুমোদন, অবৈধ স্থাপনাগুলোও পাবে অনুমোদন। জলকেন্দ্রিক ও ইকো পার্কের নামে হবে স্থাপনা ও কাঠামো উন্নয়নের সূচনা, হবে বাণিজ্যিকীকরণ। অনেক জলধারকে দেখানো হয়েছে "ঐতিহাসিক ভাবেই কৃষি" জমি (ড্যাপ ২০১৬-৩৫, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা xiii), আর সেগুলোতে প্রস্তাব করা হয়েছে শর্তসাপেক্ষে স্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নের অনুমতি। এরই মধ্যে ড্যাপের নিজের হিসেবে জলধারার পরিমাণ কমিয়ে দেখানো হয়েছে ৭ দশমিক ৮৭ বর্গকিলোমিটার (প্রস্তাবিত ড্যাপ ২০১৬-৩৫, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা xvi)। অর্থাৎ চারভাগের এক ভাগ জলাধার উধাও হয়ে গেছে। এই বিভক্তিমূলক জলাধার প্রস্তাবনা পাশ হলে ঢাকা মহানগর এলাকা ৭৫০ বর্গকিলোমিটার বন্যাপ্লাবন এলাকা হারাবে। কিভাবে সম্ভব হবে উন্নত জীবনমানের, কিভাবে সম্ভব হবে জীবনধারণের পানির ব্যবস্থা, কিভাবে হবে জলনিষ্কাশন?
বড় ও আঞ্চলিক উদ্যান এবং ইকোপার্কগুলি দ্বারা কমিউনিটি পর্যায়ের পার্কের প্রয়োজনীয়তা প্রতিস্থাপন করা যায় না। যখন কমিউনিটি পার্ক শহরে ফুসফুসের মত কাজ করে, সেখানে বাহির থেকে বড় ও আঞ্চলিক পার্ক দিয়ে ফুসফুস সৃষ্টি করে শহর বাঁচানো সম্ভব না। দখলের মহামারী জন্য আমরা আজ যে পার্ক ও জলাশয় হারাতে বসেছি, সেটা ঠেকানো না গেলে জীবন ও জীবনমানের উন্নতি সম্ভব না।
বন্যাপ্রবাহ, জলস্রোত ও কৃষি জমি রক্ষার জন্য জমির মালিকদের সুবিধার্থে রাখা হয়েছে 'উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়ের বিধান'। জমির মালিক থেকে উন্নয়ন স্বত্ব কিনে সম্ভব হবে অন্য এলাকায় ঘনত্ব বাড়িয়ে স্থাপন করা। জমির মালিকদের করুণ অবস্থা ড্যাপের রিপোর্টে সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে: "ভূমি অধিগ্রহণ এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই নায্যমূল্য পায়নি ভূমির মালিকরা। অধিগ্রহণের ফলে অনেক মানুষ ভূমি ও জীবিকাহারা হয়।" (প্রস্তাবিত ড্যাপ ২০১৬-৩৫, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ২-১৩)। ভূমিদখলের বিস্তারিত বর্ণনা ও জমি মালিকদের করুণ অবস্থা অনেক গবেষণাপত্রে পাওয়া যাবে। এরকম বাস্তবতায় উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়ের বিধান জমির মালিকের সত্যিকারের স্বার্থ রক্ষা না করে, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উপকারে আসবে।
ক্ষমতার অপব্যবহার বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত ড্যাপ নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছিল, অবৈধ প্রকল্প সরানোর দাবি জানানো হয়েছিল, জলাধার বাঁচানোর অনুরোধ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কেবিনেট কমিটি আলোচনা ও অনুরোধে কান না দিয়ে, জলধারার গুরুত্ব উপেক্ষা করে- অনেক অবৈধ প্রকল্পের অনুমতি দিয়েছে বা দিচ্ছে। ভূমিব্যবহার, জলাশয় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে বেশি লাভ হবে না, যদি রাজউক চেয়ারম্যান টাউন ইমপ্রুভমেন্ট আইন ১৯৫৩ এর ৭৫(১) ধারা ক্ষমতাবলে যেকোনো সময় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা না করেই ভূমিব্যবহার পরিবর্তন করতে পারেন। জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে কেবিনেট কমিটিও অতীতের মতন ভবিষ্যতেও ড্যাপের প্রস্তবনার বাহিরে ভূমিব্যবহার পরিবর্তন করবে বা অবৈধ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়ে যাবে।
নিয়ম প্রয়োগে ব্যর্থতা, নিয়ম ও নিয়ম প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ দুটার মাঝেই খুঁজতে হবে। কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য একদাগে নিয়মকে দোষারোপ করে নিয়ম উঠিয়ে দেওয়া যায় না। কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা শিকার করে, কর্তৃপক্ষে পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। নিয়ম যদি না থাকে, কর্তৃপক্ষের কী দরকার? জলাধার রক্ষা যখন অনিবার্য, তখন আইন শিথিল বা পরিবর্তন করে জলাধারের ক্ষতি করবেন, নাকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিবর্তন এনে জলাধার রক্ষা নিশ্চিত করবেন? প্রস্তাবিত ড্যাপে পরিকল্পনার লক্ষ্য যদি জীবন ও জীবনের মান উন্নতি আর জীবন ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্কের পুনর্স্থাপন করা, তাহলে সমাধান কোথায় খুঁজতে হবে?
আজ আমরা পারছি না মানসম্মত পরিকল্পনা করতে, সম্ভব হচ্ছে না নগর বাঁচানো, হচ্ছেনা জনস্বার্থ রক্ষা। অবাস্তব উপাদানের মাধ্যমে বাস্তব সাজানোর প্রতিযোগিতায় আমরা নির্দ্বিধায় অংশগ্রহণ করছি। যেটুকু অবশিষ্ট, আমরা আজ সেটাও হারাতে যাচ্ছি।